"উদাসী স্বপ্ন" তাকে একজন সম্মানিত ব্লগার হিসেবেই জানি, এবং ব্যাক্তিগতভাবে তাকে শ্রদ্ধাও করি।
তিনি "অক্টোবরে বাংলাদেশে আসছে ব্লকবাষ্টার সব হিন্দি মুভিজ! দেখতে ভুল করবেন না যেন!!!" নামক একটি পোস্টে মন্তব্য করেছেন এরকম,
"বলিউড মুভি দেখনের চাইতে সেই টিকিটের টাকা দিয়া রাস্তা থেকে একটা নেড়ী কুকুর পোষা উচিত! হলিউডি মুভি নিয়া আমার কোনো কথা নাই। দরকার হইলে ফ্রেন্ঞ্চ, সুইডিশ, জার্মান মুভিতেও সমস্যা নাই। কিন্তু হলে বলিউডি মুভি চললে সেই হল বোমা মাইরা উড়ায় দেয়া উচিত!"
সঙ্গত কারণেই মনে হচ্ছে যে তিনি এই মন্তব্যটি করেছেন রাগের বশবর্তী হয়ে। আক্ষেপ এবং দুঃখ থেকেই। তিনি আসলেও কোন হলে বোমা মারবেন না এটাই আমি বিশ্বাস করি, এবং এটা এই ব্লগের সবাই বিশ্বাস করেন।
হিন্দী ছবির পক্ষে আমি গুনগান গাইতে আসি নাই। হিন্দি ছবি, হিন্দি কালচার, এসবই আমার চক্ষুশূল। আমি শুধু বাস্তবতাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে এসেছি। সে জন্য আমার বেয়াদবি মাফ কইরেন।
এই আগস্ট মাসের কোন একদিন আমাদের বাসায় ইফতার পার্টি ও ডিনারের দাওয়াত ছিল পরিবারের সমস্ত আত্মীয়সজনদের সাথে। সেখানে প্রায় ৭-৮ জনের মত খালাম্মা, ফুফু গোছের মেয়েলোক ছিল। ইফতার আর নামাজটা শেষ কইরাই সব টেলিভিশনের উপর ভীষণভাবে ঝাপিয়ে পড়লেন। হিন্দী সিরিয়াল দেখবেন।
এবং এই সিরিয়াল চলাকালে, কারও যেন সাধ্যি নেই তাদের টেলিভিশন থেকে উঠায়। এই পার্টিতে ছোট একজন বাচ্চা ছিল। ৪-৫ বছর তার বয়স। তাকে পাশের ঘরের টেলিভিশন ছেড়ে দিতে হলো, সে "ডোরেমন" দেখবে। তাও সে এ কথাটা আমাকে হিন্দীতে বলল।
ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে উন্মুক্ত এটাই কিন্তু এসবের পেছনে একমাত্র কারণ নয়। কেননা, আমার মা, আমার খালা, আমার বোনদেরকেই দেখেছি, ঈদের সময় হুমায়ুন আহমেদের নাটক দেখতে আমাদের বাসায় সব দল বেঁধে চলে আসত। এই মহিলাগুলোর আজকে কেন এ দশা হলো?
খুব সিম্পল এর উত্তর। আমাদের বাংলাদেশিদের লোভ। মাত্রাতিরিক্ত লোভ। হুমায়ুন আহমেদ আর সেরকম নাটকও বানান না, আর আমরাও টিভির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি না। আর যদিও একটা ঈদে তিনি নাটক দেনও, সে নাটক মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপণের জ্বালায় দেখাই যায় না।
ভারতীয় চ্যানেলে আমি খেয়াল করে দেখেছি, তারা ঠিক টাইম মেইনটেন করে বিজ্ঞাপন, খবর, নাটক ইত্যাদি প্রচার করে থাকে। এমন কি নামী দামী সিনেমাও যখন টেলিভিশনে দেখানো হয়, বিজ্ঞাপণ আর সিনেমার মধ্যে সময় থাকে প্রচুর। ফলে বিজ্ঞাপনের আধিক্য থাকে কম, আর প্রগ্রাম দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রডিউসাররা কিছু জিনিস তৈরী করে নিয়েছেন তাদের স্বার্থের জন্যে। এগুলো হলো, ঈদ, পূজা, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মৃত্যুদিন, নজরুল ইসলামের জন্মদিন আর মৃত্যুদিন এগুলো উপলক্ষে চ্যানেলে চ্যানেলে চলে ৬-৭ দিন ব্যাপি অনুষ্ঠান মালা। আর মজার ব্যাপার হলো এইসব অনুষ্ঠান আসলে মূলা দেখানো। এর ভেতরের বিজ্ঞাপণ খাওয়াটাই হলো প্রডিউসারদের মূল টার্গেট।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নয় সব চ্যানেলে খবরের বিরক্তি তো আছেই। তা একবার একটা নাটক (খুব স্পেশাল!) দেখতে বসেছিলাম। সেই নাটকে জয়া আহসান অভিনয় করেছিলেন। এর বিজ্ঞাপণ দাতার সংখ্যা ছিল ২১ টি। নাটক শুরু হবার কথা ছিল ১১.০০ টায়, সে নাটক শুরু হয়েছে ১১.৩০ এ। শেষ হবার কথা ছিল, ১২টায়, সেটা শেষ হয়েছে, পৌণে একটায়। মাঝখানে আবার খবর ছিল।
এবার আমাকে বলুন, মানুষ কোনটা দেখবে? ১১ টায় শুরু হওয়া নাটক যদি রাত পৌনে একটায় যায়, আর কাহিনীর মাঝে বিজ্ঞাপণ বিরতি আর খবরের যন্ত্রণায় মানুষ কাহিনী থেকে দূরে সরে যায়। কাহিনীর যে একটা স্বতঃস্ফূর্তটা আছে সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
এবার আসা যাক, যারা বলেন, বাংলাদেশে হিন্দী চ্যানেল বন্ধ করে দিতে, তারা এই সাধারণ বাস্তবতাটা অনুভব করতে পারেন না। তারা মনে করেন এসব বন্ধ করে দিলেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু না, হিন্দী চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তাহলে মানুষ বিনোদনের জন্য কি করবে?
একটা প্রচলিত জিনিস টাস করে বন্ধ করে দেওয়াই কিন্তু সমাধান নয়। আমাদের নতুন কালচার, নতুন নাটক, নতুন নতুন অনুষ্ঠান তৈরী করতে হবে, যা আমরা তৈরী করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। নাটক, সিনেমা করতে গেলে আমরা শুরু করি সস্তা প্রেমের গল্প নিয়ে!
মনে আছে দীপু নাম্বর টু এর কথা? এই ছবিটি রিলিজ হওয়ার পরে, কিভাবে মানুষ হলে ঝাপিয়ে পড়েছিল? এরকম ছবি আর কেন কেউ বানাল না?
আমাদের দেশে সিনেমা হল গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এগুলোকে বাঁচানোর জন্য কোন ব্যবস্থাই আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নেন নাই। এখন ভারতীয় সিনেমা এনে এগুলোকে আবার চালু করার স্বপ্ন তারা দেখছেন। এর আগে এক টিকিটে দুই সিনেমা নামে, হলগুলোতে অশ্লীল ছবির একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। অন্তত সেটা থেকে এখন বাঁচা যাবে।
ভারতের সিনেমা নিয়ে আমরা আমদের হল বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজেরা মরলে, এটা ভারতের কাছে হাস্যকার ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই উদাসী স্বপ্নের কাছে আমার আহবান থাকবে, এসব ইমোশন পকেটে রাখেন, আর বাস্তবতার নিরীখে সব কিছু দেখেন। অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা যে মূর্খতার পরিচয় আমরা দিচ্ছি তা সহসাই আমাদের উপরেই অভিশাপ রূপে বর্তাবে।
আপনি অনেক ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ, স্প্যানিশ ছবি দেখেছেন। আপনার মন্তব্য পড়ে তাই বুঝা যায়। তা সেধরণের ছবি বানান না একটা আপনার দেশের মানুষের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এঁরা মিলে বাঙালিকে যে উচ্চ স্থানে উঠিয়েছিলেন, তারপরের কথা শুধুই পতন আর পতনের। আর এই পতন থেকে উত্তরণের নিমিত্তে কোন লেখক, পরিচালক, হলো না আমাদের দেশে। আমরা এখন ভারতীয় নায়িকার পায়ে নিজেদের চরিত্রকে মর্মার্থ দান করছি। ভারতীয় নেংটামি, নোংরা শব্দের গান আমরা আমাদের গায়ে হলুদ, পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে দেদারছে গেয়ে যাচ্ছি। সালমান খান, শাহরুখ খান, আমাদের আইডলে পরিণত হয়েছে। এর থেকে লজ্জার ব্যাপার আর কোন জাতির জীবনের হইছে কিনা আমি জানি না। আর বাকি ছিল ভারতীয় ছবি বাংলাদেশে আসা! এটাও হলো!
সরকারকে দোষারোপ আমি করি না। আমি নিজের জায়গা থেকে দেশকে কি দিলাম তাই এখন দেখার বিষয়। কোলকাতায়, যেখানে ভারতীয় ছবি বেশি চলে, সেখানে যদি "বাইশে শ্রাবণ" এর মত বাংলা ছবি হাউসফুল যেতে পারে, তাহলে বাংলাদেশেও তা সম্ভব। শুধু দরকার একটু ক্রিয়েটিভ চিন্তা, আর নিজেদের লোভকে সংবরণ করা।
বেসরকারী টিভি চ্যানেল হইসে ঠিকই, অথচ তার কোন নীতিমালা নাই। কারও কোন আদর্শ নাই। কোন টাইমিং নাই। তাদের কিছু বলাও যাবে না। তাদেরও আবার ইমোশন আছে!
বাংলাদেশের কোন সরকার আমাকে বলে নাই, ভারতীয় সিনেমা দেখ, কিন্তু আমি দেখি! বাংলাদেশের সরকার কখনও বলে নাই, ভারতীয় সিরিয়াল দেখে ব্লাউজ আর পেটিকোট বানাও, আমরা বানাই! বাংলাদেশের কোন সরকার কোনদিন বলে নাই, গায়ে হলুদের ভারতীয় গান বাজাও, কিন্তু আমরা বাজাই। এই লজ্জা আমাদের। আমার গর্ব হয়, ১৯৯০ সাল থেকে যতগুলো সরকার বাংলাদেশে ছিল, তারা কেউই নাগরিকদের স্বাধীনতার উপর হাত দেয়নি। অথচ, আমরাই বাঁকা পথে গিয়ে নিজেদের কু-চরিত্রকে চরিতার্থ করেছি। সুতরাং, আমার মনে হয় নিজেদের চিন্তা করার সময় এসেছে।
এবং সেইটাই করুন!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



