somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তপংকর চক্রবর্তীর ভাবনায় সমকাল

০৪ ঠা মার্চ, ২০২৫ রাত ২:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছড়া বলতে সাধারণত শিশুতোষ বুঝায়। কাল্পনিক জগতের নানান ঘটনা, চরিত্র অদ্ভুতুরেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় ছন্দে ছন্দে। প্রত্যাহিত অনুসঙ্গে মানুষ ছড়া কাটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মানুষের প্রাচীন সেই রেওয়াজ ভেঙে ছড়ার নতুন মাত্রা দিয়েছে ছড়াসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ সুকুমার রায়। তার ‘ননসেন্স লিটারেচার’ আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বি। সুকুমার রায়ের পরও অনেকে ছড়ায় বৈচিত্র্য এনেছেন। শুধু ভাষা প্রয়োগ, বিষয়বস্তু নির্বাচনেই না ভাব প্রকাশের মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।

তপংকর চক্রবর্তী তারমধ্যে অন্যতম। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার লেখা যেভাবে আলোচিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। নানান কারনে আলোচনার বাইরে থাকতে পারেন। হয়তো পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারেননি বা পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতায় নিয়মিত হাজির হচ্ছেন না দেখে আমরা পাচ্ছি না।

নানান বিষয় নিয়ে ছড়া লেখেন তপংকর চক্রবর্তী। তার ছড়ার পরিধি এত বিস্তৃত যে কোন বই খুলে বসলে ছড়ার দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে হয়। চরিত্র, বিষয়, উদ্দীপন এত সুন্দরভাবে মেলে ধরেন, পাঠক নিমিষেই ভাবতে শুরু করে এই বিষয়টি তারও বলার ছিল।



‘খেয়ালখুশির ছড়া’ তেমনি একটি ভালো মানের ছড়ার বই। সোহাগ পারভেজের প্রচ্ছদ আর অলংকরণে ২০১৩ সালে বইটি প্রকাশ হয়। প্রচ্ছদে শিশুদের চিত্রকল্প ফুটে উঠলেও আদতে বইটি শিশুদের বলে আমার কাছে মনে হয়নি। ওই যে বলেছিলাম তপংকর চক্রবর্তীর ছড়ার বিষয় এত বিস্তৃত যে নির্ধারিত ফ্রেমে তাকে আটকে রাখা যায় না। যেমন তফাৎ ছড়ায় লিখেছেন,
একটু তফাৎ আছে গরু আর গাধাতে
গরু যদি কিছু পারে, পারে না তা গাধাতে।
অথচ হঠাৎ যদি দেখো এই গাধারা
বড় বড় পদ পায়, ডেকে নেয় দাদারা
তখনই বুঝবে তুমি দেশ গেছে গোল্লায়
ভাগ্যের গুড়টুকু খেয়ে নিল বোল্লায়।

গরু আর গাধা দুটিই পশু হলেও তারা যে সমান নয় তা অত্যান্ত সুনিশ্চিতভাবে তুলে ধরেছেন। পশুকূলের এমন বৈপরিত্য থেকে যদি মানব সমাজের দিকে আসি এমন জটিলতার চিত্রই দেখা যাবে। ছড়াটি পশু সমাজের ভেতরকার কথাবার্তা নিয়ে শুরু হলেও তপংকর চক্রবর্তী আয়নাটি সেই মানুষ সমাজেই আলোকপাত করেছেন। গাধারা যখন বড় বড় পদ পেতে থাকবে তখন দেশ যে গোল্লায় যাচ্ছে তা তিনি বলেছেন এক দশক আগে।

লিমেরিক ছড়ায় লিখেছেন,
বাজারে আগুন তাই যান নাতো বাজারে
একটা ইলিশ মাছ দাম উঠেছে হাজারে
............................................
চাল আছে তো লবন উধাও থাকলে লবন চাল নেই
জেলাওয়ারি একটি রেট
চালাচ্ছে সব সিন্ডিকেট
তাদের পালেই লাগছে হাওয়া, জনগণের ছাল নেই।

তপংকর চক্রবর্তী প্রায়ই বলেন, আমি কাউকে ছেড়ে লিখি না। সমাজের অসাম্য, অন্যায় অবিচার সকলই আমার লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাই। একজন লেখকের এরচেয়ে ভারী ভারী গুনাবলি থাকাটা মনে হয় অতিরঞ্জিত। আমাদের চারদিকে কত শত লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থনের আলেখ্য শুনছি। আসলেই কি সেসব খুব প্রয়োজন? আমিও মনে করি লেখকের কাজ লিখে যাওয়া, সময়কে ধারণ করে।

মধ্যবিত্তের জীবনবোধের মর্মবাণী তুলে ধরেছেন জীবনযাপন শিরোনামের ছড়ায়। ছড়াকার লিখছেন,
আমরা যারা নিতান্ত আটপৌঢ়ে
টাকার পিছে বেড়াই না ঠিক দৌড়ে
পথ আটকে দাঁড়ায় বিবেক লজ্জা
ক্লান্ত হৃদয়, পাতছি শরশয্যা।

কলুর বলদ বোধহয় তবে আমরাই
সব দেখি আর নিজের আঙুল কামড়াই।

ছড়ার শেষ পয়ারে এসে প্রশ্ন তুলেছেন টাকার পিছনে না দৌড়ে মধ্যবিত্তদের জীবন নষ্ট হয়ে গেলো কিনা? আসলে এমন প্রশ্ন ছড়াকারের একার না, আমাদেরও। মধ্যবিত্ত সবগুলো মানুষের প্রশ্ন বিবেক, লজ্জা নিয়ে ক্লান্ত হতে হতে কি পেলো সে। সাহিত্যের স্বার্থকতা এভাবেই নিহিত হয় রচনায়। প্রাণীকূলে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তপংকর চক্রবর্তীর ছড়ায়ও হাস্যরসের ছলে মানুষ মূল ভূমিকায় চলে আসে।

ঢাকা সমাচারে লিখছেন,
ঢাকায় শুধু উড়ছে টাকা
কোটিপতিই কয়েক লাখ
দেশের এমন উন্নতিতে
দু’হাত খুলে বাজাও ঢাক।

উন্নয়নের জোয়ার-জলে
কর্তা থেকে কেরানী
কেউ পাচ্ছে দশ আনা ভাগ
কেউ পাচ্ছে দেড় আনি।

এমন আজব দেশে
নৈতিকতার বায়নাগুলো
সবাই ওড়ায় হেসে;
গরিব মরে মঙ্গা, খরায়
চোখের জলে ভেসে।

উন্নয়নের বার্তা ছড়িয়ে দেশে হঠাৎ আনপ্যারালাল যে প্রকরণ শুরু হয়েছিল তা এই ছড়ায় খুবই স্পষ্ট। একপক্ষ উন্নয়ন উন্নয়ন বলে ভাগবাটোয়ারা করছেন, বিপরীতে গরিব মানুষ চোখের জলে ভাসছে।

খেয়ালখুশির ছড়া গ্রন্থে শব্দ নিয়ে খেলেছেন ছড়াকার। শব্দের ছন্দ আর উপমায় চমকিত করেছে। যেমন, গঙ্গারামের গ্রামতুতো ভাই। এই চলো না এবার শীতে/অন্যকোন গ্যালাক্সীতে। সাতবার ফেল করে ঠিক একই কেলাসে/ ঢকঢক জল খায় বড় এক গেলাসে। বিজ্ঞানী জগদীশ/ দিয়েছেন যে হদিস। আহারে! আহারে! খগেন সাহারে/চাপা দিয়ে দিলো টাকার পাহাড়ে। নাম তার জাফরুল/বাড়ি শুনি কাফরুল, যারা তার সঙ্গী/ তারা থাকে টঙ্গী।

এভাবে শত শত শব্দের দোত্যনা মাধূর্যে আবিষ্ট করে রাখে পাঠককে। সত্তরের দশকের খ্যাতিমান ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী এখনো নিয়মিত লিখে চলছেন। বরিশালের মত মফস্বলে শহরে থেকে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা চালিয়ে নেয়ার দুসাধ্য সহাস্যে সফল করছেন। আমি তার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০২৫ রাত ২:১৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×