দেশে থাকতে শিশির ভাইয়ের টুকটাক সাংস্কৃতিক জগতে পা দেবার অভিজ্ঞতা ছিলো। ব্যাচেলর মানুষ। মুভি-গান-গাড়ি-নারী (ভাগ্যিস ব্লগ পড়েনা ) নিয়ে হইহই করে বেড়ায় সবসময়। সাথে আছে একমেয়ের বাপ আর সতী নারীর পতি সুমন ভাই। অফিস থেকে এসে দু'জনে গুটুর গুটুর করে ফোনালাপে সাব্যস্ত করে, নাহ, এবার একটা নাটক নামাতেই হবে। শিশির ভাই নিজেই দায়িত্ব নিলো, নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখবে। ৩/৪ মাস বসের চোখ ফাঁকি দিয়ে আর লাঞ্চটাইমে কাঁটাচামচ-ছুরির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে পাল্লা দিয়ে একটা 'বাংলিশ' স্ক্রিপ্ট দাঁড়ালো। বাংলা সংলাপ, টাইপ করা হলো ইংলিশে। নাটকের নাম 'অজি জীবন'। অস্ট্রেলিয়ায় বাংগালী তিনটা পরিবারকে কেন্দ্র করে নাটকের কাহিনী। বাস্তবের টুকটাক ঘটনাকে নাটকীয় করে তিন পরিবারে সেঁটে দেয়া হলো। একটা অজি পরিবারও দেখানো হবে। পরিচিত কিছু এদেশের ছেলেমেয়েকে বলতেই ওরা মহা উৎসাহে রাজি। এবার পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পাট। আমি যখন নাটকের কথা জানতে পারলাম তখন শুধু একটা মেয়ে চরিত্রই খালি আছে, কাজের মেয়ে জুলেখা। আমি তো শুনেই বেঁকে গেলাম। জুলেখা হয়ে আমার অভিনয় জীবনের অভিষেক ঘটাতে পারবোনা। বলা তো যায়না, একসময় বিখ্যাত হয়ে গেলে সাক্ষাৎকারে যখন সুন্দরী উপস্থাপিকা জিজ্ঞেস করবে, 'প্রথম চরিত্র নিয়ে কিছু বলুন'- তখন আমি জুলেখা উপাখ্যান পাবলিকের সামনে কীভাবে ফাঁস করবো? নাট্যকার-নির্মাতা শিশির ভাই আমার দুঃখ বুঝলো। চল্লিশোর্ধ মহা জাঁদরেল মহিলার চরিত্র করতে বললো। আমার সাথে নাকি ঝগড়াটে চরিত্র যায় ভালো তাও সই, জুলেখা থেকে তো রেহাই পেলাম। উপরের সেই সতী নারী আমারে বাঁচালো।
রিহার্সাল হচ্ছে একেকদিন একেকজনের বাসায়। বেশ উৎসাহ নিয়ে শুরু হলো। একেক রুমে একেক সিনের মহড়া চলছে। অফিস-ভার্সিটি সেরে বাসায় এসেই সবাই ঠিক সময়ে রিহার্সালে হাজির। ডিরেক্টর মহা সিরিয়াস। কোন ফাও প্যাঁচাল পাড়া যাবেনা, ইটিশ পিটিশ করা যাবেনা। পাত্রপাত্রীরা লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মত টানা তিন ঘন্টা মহড়া দিলো। কারো অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। বেশীরভাগই কোনদিন স্টেজে উঠেনি। তাও সে কী জ্বলন্ত পারফরমেন্স সবার। দ্বিতীয় দিন থেকেই আবহাওয়া অবশ্য একটু করে বদলে গেলো। ভুঁড়ি উলটানো খাওয়াদাওয়া আর বিরতিহীন আড্ডার পরে যদি কিছু সময় হাতে থাকে, তাহলে আমরা সেটা মহড়ায় ব্যয় করার মত বদান্যতা দেখালাম। ডিরেক্টর নাটকের ভবিষ্যত বিষয়ে আশংকামূলক কোন বক্তব্য রাখতে গেলেই সবাই তারে উলটা ঝাড়ি- আরে মিয়া বিনা পয়সায় যে নাটক করতে আসছি, এইটাই তো অনেক বড়। আবার কিসের রিহার্সাল । নাটক পরিশেষে কী রূপ নিবে সেটা নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত না। হাসির নাটকে দর্শক না হাসলে অবশ্য সব পরিশ্রম মাটি। সেটারও অবশ্য একটা ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। বিদেশে যেভাবে হাসির নাটকে ব্যাকগ্রাউন্ডে হো হো হাসি জুড়ে দেয়, আমরাও সেরকম টেপ বাজাবো ভাবছি
পুরা নাটকে আমার একটাই ধ্যান-জ্ঞান, স্বামীরূপী সুমন ভাইরে সি-শার্পে ঝাড়ি দেয়া। ঝাড়ির ছুঁতো তো আমার বাইর করা লাগবেনা, ওই কাজ নাট্যকারের। রিহার্সালের সময় আমি স্ক্রিপ্টের সাথে আরো কিছু যোগ করে সুমন ভাইরে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলতে লাগলাম। বেচারা এক পর্যায়ে ডিরেক্টররে বিচার দিলো। তার চরিত্রে থালা-বাসন মাজা, ঘর মোছা এসব করে এমনিতেই সে চাপের মুখে আছে, এর উপরে স্ক্রিপ্টের বাইরে ঝাড়ি তার নাকি ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে। শিশির ভাইরে এই আবেদন জানাতেই আরেক ধমক খেলো। বেচারা ।
মাসুম আমারে লাগাতার উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। আমার নাকি ঝগড়াটে চরিত্রে বাড়তি কিছু যোগ করতে হবেনা, তার সাজেশান হলো বাস্তব জীবনের আমি যেমনে সংসারধর্ম পালন করি, সেভাবে শুধু ডায়লগগুলা বলে গেলেই নাকি হবে । সে আবার আরেক তন্বী-তরুণীর ভ্যাবদা মার্কা স্বামী চরিত্রে করছে। নতুন অবিবাহিত বউ পেয়ে সে এমনিতেই আনন্দে আটশখানা। আমি লক্ষ্য করলাম রিহার্সালের সময় তার বউরূপী মেয়েটার সাথে বেশি বেশি ঘেঁষাঘেঁষি শুরু করেছে, মাঝে মাঝে হাতও ধরার চেষ্টা করছে যদিও এসব কিছু স্ক্রিপ্টে নাই। এটা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলে, আরে অভিনয়টা বাস্তবসম্মত করতে হবেনা? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতটুকু আবেগ তো থাকবে, নাকি? নাটকের সামগ্রিক সাফল্যের জন্য নাকি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে এই পথ বেছে নিয়েছে । তার একটা অংশ আছে যেখানে বাচ্চার ন্যাপি বদলাতে হবে। আমি ডিরেক্টরকে অনুরোধ করেছি নাটককে বাস্তবসম্মত করার জন্য তাকে আসল জিনিষভর্তি ন্যাপি দেয়ার ।
শওকত ভাই মাটির মানুষ। হাসি ছাড়া ভদ্রলোক কথাই বলতে পারেনা। তাকে দেয়া হয়েছে জিয়া বিমানবন্দরের কাস্টমস অফিসারের চরিত্র। পানের পিক ফেলতে ফেলতে যার কাজ হলো অস্ট্রেলিয়াগামী এক যাত্রীর কাছ থেকে ডলার ঘুষ নেয়া। এই জায়গাটা যতবার করতে যায়, শওকত ভাই কোনভাবেই হাসি আটকাতে পারেনা। আমরা মহা চিন্তিত নাটকের দিন কী হবে এ নিয়ে। সুমন ভাইকে আবার লুংগি পরে অজি প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়ার একটা সিন করতে হবে। সেও মহা চিন্তিত। কোন ভাবেই যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে এজন্য তাকে বেল্টসহ লুংগি পরতে বলা হয়েছে।
নাটক মঞ্চায়নের আর বেশী বাকি নেই। সবাই একসাথে বসা হলো কী কী জিনিষ জোগাড় করতে হবে, সেটা নিয়ে। দেখা গেলো আমাদের একটা শপিং কার্ট লাগবে। এটা কীভাবে পাওয়া যায়? অজি একটা ছেলে বললো তার উপরে এই ভার ছেড়ে দিতে। সে কোন একদিন শপিং করতে গিয়ে মনের ভুলে একটা কার্ট বাসায় নিয়ে আসবে। আরেকটা রেস্টুরেন্টের সিনে ওয়েটারের সাদা তোয়ালে দরকার। সেটাও আরেক অজি মেয়ে তার সত্যিকার কাজের জায়গা মানে রেস্টুরেন্ট থেকে সটকে নিবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করলো। একটা সিনে দরকার লাঠি। আমরা সেটা উর্মি আপার বাসার একটা পর্দা থেকে খুলে নিবো বলে যখন প্রায় ঠিক করে ফেলেছি, বেচারী প্রতিবাদ জানালো। নাটকের প্রতি তার কমিটমেন্টের অভাব নিয়ে আমরা সবাই যখন ধিক্কার দিতে লাগলাম, তখন সে পর্দার মায়া ভুলতে বাধ্য হলো। শওকত ভাই দাবী জানালো ঘুষ খাওয়ার সিনে সে যে চারশো ডলার পকেটে ঢোকাবে, সেটা কোনভাবেই নকল হওয়া চলবেনা।
এইতো, মহড়া চলছে। চলে আসুন ২রা আগস্ট নিউক্যাসেলে। আমাদের তেলেসমাতি ভরা হইহুল্লোড় দেখে যান!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:০৬