রুদ্রর ঘুম ভাংগতেই সে হুড়মুড় করে ঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়িতে ৯টা বেজে গেছে দেখেই সে চিৎকার করে উঠলো, ‘‘মা, তুমি আমাকে কেনো ডাকলা না?? অন্যদিন ৭টার সময় ঘুম থেকে উঠানোর জন্য ডাকো আর আজকে কেনো ডাকলা না”। চিৎকার করতে করতে রুদ্রর কান্না পাচ্ছিলো। পড়িমরি করে গায়ে পাঞ্জাবী জড়িয়ে রুদ্র বের হয়ে পড়লো। বের হতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। পহেলা ফাল্গুন তাই চারিদিকে হলুদ আর বাসন্তিতে সব একাকার হয়ে গেছে । বাসের জন্য বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না। ‘গুড লাক’ নামের একটা বাসে চড়ে বসলো রুদ্র। জানালার পাশে একটা আসনে বসলো । জানালা দিয়ে তাকিয়ে হাতে হাত ধরা উচ্ছল রঙ্গিন কপোত কপোতীদের দেখতে ভালোই লাগতেছিলো। এমন সময় রিমির ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করতেই রিমি খুব ধীরস্থীর ভাবে জিজ্ঞেস করলো, “ কই আছো তুমি”। রুদ্র বললো, “বাসে উঠছি রাস্তা , রাস্তা খালি বেশীক্ষন লাগবে না”। রিমি ধীরে ধীরেই বললো, “ তোমার কিন্তু আসার কথা ১১টার ভিতর”। রুদ্র বললো, “ ইনশাল্লাহ এসে পরবো”।
ফোন রেখে রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকালো।১০ টা বাজে, হিসেব মিলিয়ে দেখলো ক্ষিলখেত থেকে নিউমার্কেট যেতে খুব বেশী হলে দেড় ঘন্টা লাগবে। নিশ্চিন্ত হয়ে রুদ্র রিমির কথা ভাবা শুরু করলো। রিমিকে রুদ্র ভালোবাসে সেই স্কুল থেকেই। কতই না ঝামেলা পার হয়ে আজকে রিমির সাথে তার বন্ধুত্ব। রিমিকে ভালোবাসার কথা বলার পর ও তো কথা বলতেই আর রাজী হতো না আর। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখন বন্ধু হিসেবে রিমির পাশাপাশি আছে এখন রুদ্র। কম না প্রায় ৭ বছর ওদের বন্ধুত্বের এই সম্পর্ক বহমান। এই সাত বছরে দুইজন দুইজনের এমন কোন কথা নাই যা দুইজন শেয়ার করে নাই। প্রথাগত প্রেমের সম্পর্ক না হলেও প্রেমিক প্রেমিকার মতই ওরা দুইজন চড়ে বেরিয়েছে ঢাকার অনেক জায়গায়। আর দুইজন সময় পেলেই রিক্সা করে ঘুরে বেড়ায়। রিক্সা করে ঘুরতে দুইজনেরই ভালো লাগে। রুদ্র যে রিমিকে পাগলের মতো ভালোবাসে তা পরিস্কার কিন্তু রিমির ব্যাপারটা রুদ্রের কাছে পরিস্কার না। আরো ঘোলাটে হয়েছে যখন রিমির জীবনে আকাশের প্রবেশ ঘটছে। রিমি বলে আকাশ ওর বন্ধু। রুদ্রও তাই বিশ্বাস করে এবং রিমিকে সন্দেহ করা ওর রুচিতে ঠেকে। কিন্তু ইদানীং মাস খানেক রিমি একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এক মাস পুরো অস্থিরতা দিন কাটছে রুদ্রর।প্রতিটা মুহূর্তে ফোন হাতে রেখেছে যেনো ফোন আসলে মিস না হয়ে যায়। এমনকি ক্লাসেও যখনই ফোন আসছে সাথে ও রিসিভ করে দেখেছে কে ফোন দিয়েছে। রিমির সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায়ই নাই যদি সে নিজে রুদ্রর সাথে যোগাযোগ করে। তাই কাল যখন ফোন দিয়ে বললো দেখা করতে তখন থেকেই খুব খোশ মেজাজে আছে রুদ্র। ফোন বাজার শব্দে ঘোর কাটলো রুদ্রর। ফোনের স্ক্রিনে দোকানের নম্বর দেখেই রুদ্র বুঝলো রিমি ফোন দিয়েছে । ফোন রিসিভ করতেই রিমি বললো, কতদূর? জানালা দিয়ে তাকিয়ে বুঝলো বনানী পর্যন্ত আসছে। তাই উত্তর দিলো ‘‘বনানী’’। রিমি ধীরস্থির ভাবেই বললো “এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। আমি দেড়টা পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।“ রিমি একথা বলেই ফোন কেটে দিলো।
ফোনের দোকানে টাকা দিয়ে বের হয়ে আসলো। আকাশ রিমিকে জিজ্ঞেস করলো, “ কতদূর?। রিমি বললো, বনানী পর্যন্ত আসছে। রিমির মেজাজ খুব গরম হয়ে আছে। কাল ফোন দিয়ে বার বার বললাম যে এগারোটার ভিতর আসতে আর সে এখনো বনাণীতে। সবসময় এমন করে ও । একটুও গোছানো না,পুরাই ছন্নছাড়া।রিমির ব্যাপারেও উদাসীন , কোন অভিযোগ নেই, কোন আবদার নেই । মাঝে মাঝে মনে হয় রুদ্র যেনো রিমিকে একটুও ভালোবাসে না। এক মাস ফোন দেই নাই তাতে যেনো রুদ্রর কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। কালকে ফোন দেওয়ার পর অন্যসব দিনের মতই কথা বলা শুরু করছে যেনো এই একমাসে রিমির কথা ওর একবারো মনে আসে নাই। বিপরীতে আকাশ অনেক গোছানো। পড়ালেখার পাশাপাশি একটা চাকরি করছে, ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমাচ্ছে। সবসময় রিমির খেয়াল নেয়। রিমির বা রিমির পরিবারের কে কেমন আছে সেই সবও খোঁজ নেয়। একমাস তো দূরের কথা ১ সপ্তাহ যোগাযোগ বন্ধ করার সাথে সাথেই আকাশ কলেজের সামনে এসে উপস্থিত। সেইদিন আকাশকে দেখে কি যে ভালো লেগেছিলো তা বলার মতো না। এই মাসটা আকাশের সাথে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে রিমি । দুইজন একসাথে বুড়িগঙ্গায় নৌকায় চড়েছে, একসাথে চাইনিজ খেয়েছে। খুব মজায় কেটেছে সময় গুলো। কিন্তু গত দুইদিন ধরে রুদ্রর কথা খুব মনে পরছিলো । রুদ্র নাকি আকাশ এই দোটানা থেকে মুক্তি দরকার ওর। কাল সারারাত হিসেব করে দেখেছে আকাশ খুব গোছানো ,সংসারী, ভবিষ্যতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারনা এবং পরিকল্পনা আছে।আকাশ রিমিকে তার বাসার সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রিমিকে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, তাদের বাড়ী কেমন হবে এই সব নিয়ে কতই স্বপ্নময় গল্প করেছে আকাশ। আর অন্যদিকে রুদ্র ওর সামনে আসলে ভ্যাবলার মতো হা করে থাকে , কথা বলা শুরু করলে হয় রাজনীতি নতুবা ক্রিকেট এছাড়া কিছুই বলতে পারে না।এমনকি ওর ব্যাপারেও কোন মাথা ব্যাথা নেই যেনো রুদ্রর। মাঝে মাঝে ওকে প্রচন্ড দায়িত্বহীন মনে হয়। তবে রুদ্রর ভালোবাসা যে নিখাদ তা পরিস্কারই বুঝা যায়। তাই আজকে দুইজনকেই একসাথে ডাকা। আকাশ সময়মতো আসলেও রুদ্রের কোন খোঁজ নেই।
রুদ্র বার বার জানালা দিয়ে বাহিরের জ্যামের অবস্থা দেখতেছিলো । মেজাজ সপ্তমে উইঠা আছে তার । জীবনেও এমন জ্যামে পরে নাই। ১২টা বাইজা গেছে আর ও এখনো মহাখালী ফ্লাইওভারের উপরে। রিমিকে যে কি বলবে এখন ফোন দিলে বুঝতেছে না। এখন মাত্র মহাখালীতে আর ওর নিউমার্কেট থাকার কথা ১১টায়। নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলো। এতোদিন পর ওর সাথে দেখা করার সুযোগ হল আর তা যদি এমনভাবে নষ্ট হয়। একমাস তো কথা হয় না আর দেখাদেখি বন্ধ প্রায় আট মাস হতে চললো। কেনো যে ওর সাথে দেখা করার ব্যাপারে ওর এত অনীহা আল্লাহই জানে। কিন্তু এমন কোন রাত নাই যেদিন রিমিকে স্বপ্নে দেখে না রুদ্র। দেখবেই না কেনো রাত দিন মানুষ যা নিয়ে ভাবে স্বপ্নে তো তাই ধরা দেয় ।এমন সময় রুদ্রর মোবাইল বেজে উঠলো । দোকানের নম্বর দেখেই বুঝতে পারলো রিমি ফোন দিয়েছে। রুদ্র বুঝতে পারতেছিলো না কি বলবে। জ্যামের অবস্থা দেইখা বুঝা যাইতেছে ৩টা বাজবে ওর নিউমার্কেট যাইতে যাইতে। ফোন না ধরে আর উপায় কি তাই ফোন ধরলো। রিমি অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বললো, কই আছো এখন? রুদ্র বললো, “ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে। বিশ্বাস করো আজকে এমন জ্যাম হবে আমি কল্পনাও করি নাই”। রিমি বললো, “ আমিতো তোমাকে কোন অভিযোগ দেই নাই। শুধু বলতেছি দেড়টা পর্যন্ত আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবো”।রুদ্র ঘড়ির দিকে তাকালো ,এখন বাজে সাড়ে বারোটা। ভাবলো জ্যাম সামনে আর না পড়লে দেড়টার ভিতর পৌছতে পারবে তাই রুদ্র বললো, ইনশাল্লাহ, দেড়টার ভিতরে আমি চলে আসবো’’। রিমি ধীর পায়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসলো। বের হতেই আকাশ জিজ্ঞেস করলো, রুদ্র কই এখন?রিমি বললো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে। সাথে সাথেই আকাশ একটা মোক্ষম তীর মেরে বললো, “মানুষ এতো ইরেস্পন্সিবল হতে পারে? ওতো জানেও না যে আমি তোমার সাথে আছি । কি করে একটা মেয়েকে এতোক্ষন দাড় করিয়ে রাখতে পারে। রিমি একটু ডুকরে ওঠে। ওর বলতে ইচ্ছে করে রিমি মেয়ে বলে রিমির প্রতি আলাদা সজাগ দৃষ্টি ও কখনোই দেয় না। ও বিশ্বাস করে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবার ব্যাপারে। এমনকি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারেও আমি রুদ্রর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি । অস্ফুট কথা গুলো অস্ফুটই থেকে যায়।
ওইদিকে জ্যামে বসে থাকতে থাকতে চিন্তা না করে সমস্তটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়। বাস তখন আসাদ গেটের সামনে , দেড়টা বাজে এমন সময় রিমি ফোন দিলো। ফোন রিসিভ করতেই রিমি বললো, “ আমি চলে যাচ্ছি’’। রুদ্র চুপ করে থেকে বললো,“অনেকদিন দেখি না তোমাকে, আমি আসাদ গেট চলে আসছি’’ । এবার রিমি ক্ষেপে উঠলো, “দেখার যদি সত্যিই ইচ্ছা থাকতো তবে ১১টার আসার জায়গায় দেড়টার সময়ও আসাদগেট থাকতে না”। রুদ্র কিছু বললো না, কিই বা বলার আছে। সে চুপচাপ বাসে বসে থাকলো। সেইসময়ই আসাদ গেট সিগন্যাল পার হয়ে বাস এক টানে চলে আসলো নিউ মার্কেট। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পৌনে দুইটা বাজে। তড়িঘড়ি করে রুদ্র বাস থেকে নামলো। নিউ মার্কেটের দুই নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না । ঠায় তিন ঘন্টা একা একা দাঁড়িয়ে রইলো একবার রিমির দেখা কিংবা ওর একটা ফোন কল পাবার আশায়।
কিন্তু রিমিতো দেড়টার সময় ফোন দিয়েই আকাশের সাথে চলে গেছে। রিমির খুব কান্না পাচ্ছিলো আকাশের এমন আচরণে। রিমি আর আকাশ অনেকক্ষন পাশাপাশি হাটার পর আকাশই প্রথম মুখ খুললো, “ রিমি মন খারাপ করার কোন মানে নাই। রুদ্র কখনোই তোমার সাথে সিরিয়াস ছিলো না। এমন দায়িত্বহীন এর জন্য কস্ট পাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু না”। রিমির কাছেও ঠিক মনে হলো কথাগুলো। তারপর সারাদিন দুইজন ঘুরলো। আর রিমি দোদুল্যমান থেকে আকাশে আইসা স্থির হইলো।
চার বছর পরঃ-
আকাশ বিয়ে করেছে । না রিমিকে না, বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে।
রিমি সর্বস্ব হারিয়ে প্রতারিত হয়ে পুরুষ জাতিকে খুব ঘৃণা করে। পারতপক্ষে কারো সাথে দেখা বা কথা বলা এড়িয়ে চলে। একা একাই থাকতে ভালোবাসে।
রুদ্রর জীবন ঠিক আগের মতই গতিময় আছে। ক্রিকেট আর রাজনীতি নিয়ে এখনো সে খুব বেশী কথা বলে। এখনো আগের মতো অপেক্ষা করে রিমির ফোন কলের।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


