somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'স্কুলে যাবো'

১০ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ডিসেম্বর ২০১৯ এর শেষ থেকে শুরু। পুরো ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে আমরা শুধু দেখলাম। শুনলাম। চীনাদের জন্য হায় হায় করলাম। চীনের দেয়াল ভেঙে করোনা ছড়াতে থাকলো চারপাশে। প্রত্যক্ষ করলাম। মিডিয়াতে বললাম আমরা প্রস্তুত। করোনা বাংলাদেশে আসা মাত্রই ওর ঘাড় মটকে দেয়া হবে। আতংকিত হবেন না। গুজব রটাবেন না। করোনা কিচ্ছু না। সাধারণ সর্দি-জ্বর।

সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মোটামুটি সব পর্যায়ের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের 'করোনা কালীন প্রস্তুতি' প্রকৃতপক্ষে ছিল শূন্য। এবং আমরা তা গভীর মনোযোগের সহিত প্রত্যক্ষ করলাম যখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এর ইমিগ্রেশন-কাস্টমস্ পার হয়ে করোনার আগমন ঘটলো এবং তার মহা আগমন উপলক্ষে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

পেশায় আমি শিক্ষক। তাই জাহাজের খবর না হয় নাই দিলাম। ১৬ মার্চ সরকারের নির্দেশে প্রথম দফায় সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলো ১৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। চিৎকার চেচামেচি হলো, লেখালেখি হলো বিষয়টি নিয়ে - শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরো আগে বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল কি ছিলো না। তবে আমরা সবাই আঁচ করতে পারছিলাম যে, যেকোন সময় ঘোষণা হতে পারে। এবং তা অনিদৃষ্টকালের জন্য। ১৬ মার্চের পর দুই দফায় বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হলো। বর্তমানে যা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আছে। মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই আমরা নিশ্চিত হতে থাকলাম যে করোনার কালো থাবা এবার বাংলাদেশের আকাশ কালো করতে আসছে। তখনও আমাদের হাতে সময় ছিল প্রায় ১০/১৫ দিন।

প্রশ্ন হলো তখন আমাদের স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম? এই অনির্দিষ্ট আপদকালীন সময়টাতে ওদের পড়াশুনার কি হবে? ক্লাসরুমের বাইরে 'হোম কোয়ারান্টাইন' এর দিনগুলোতে পাঠদান কিভাবে, কতটা সম্ভব? স্কুল কর্তৃপক্ষগুলো কি শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীদের সাথে এই আপদকালীন সময়ের প্রস্তুতি বা করণীয় সম্পর্কে [ঘন ঘন সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড সময় ধরে হাত ধোয়ানোর আলোচনা ছাড়া] কোন ধরনের আলাপ/আলোচনা করেছিলো?

প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের Office of Academics এর দায়িত্ব ছিল, আপদকালীন সময় শুরুর আগেই যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয়ার এবং সেই সময়টাকে মোকাবিলা করবার। প্রয়োজন ছিল দূরদর্শী হবার। আমার শিক্ষক, অভিভাবক এবং ছাত্রদের সাথে আমি কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করবো, পাঠদানের আধুনিক/বিকল্প পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আমার শিক্ষক/ছাত্ররা কতটা প্রস্তুত? প্রস্তুতি না থাকলে কিভাবে অল্পসময়ে তাদের প্রস্তুত করা যায়? যদি প্রস্তুতির জন্য সময় খুবই স্বল্প হয়, তাহলে তার বিকল্প কি? হাত গুটিয়ে বসে থেকে ২/৩ মাস সময় যে পার করা যাবেনা, এই বিষয়টাও কি আমরা ভেবেছি?

রাজধানীর হাতেগোনা মাত্র ২/১ টা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ ঘোষণার ১০/১৫ দিনের মধ্যেই তাদের ছাত্র ও অভিভাবকদের সাথে 'একাডেমিক সংযোগ' স্থাপন করতে পেরেছিলেন, যা বেশিরভাগ স্কুলগুলোরই করা উচিত ছিল। নামিদামি অনেক স্কুল এখনও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে 'কিভাবে কি করা যায়'? অথচ একবার ফিরে তাকান অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর দিকে। 'হোম কোয়ারান্টাইন' এর এই লম্বা সময়টাতে শিশু কিশোরদের Home Schooling নিয়ে তাদের কত রকম গবেষণা, কত রকম কর্মযজ্ঞ। Online Platform গুলোকে কাজে লাগিয়ে স্কুল/শিক্ষকদের সাথে ছাত্র/ছাত্রী দের সরাসরি সংযোগ স্থাপন এই আধুনিক বিশ্বে কোনমতেই কোন বিশেষ কঠিন কাজ ছিল না এবং এখনও নয়।

এমন নয় যে অনলাইনে পড়াশোনা করিয়ে এই দূর্যোগের মধ্যে ওদের আমরা বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেলবো। স্কুলের সাথে, শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের এক ধরনের অদৃশ্য গভীর মনস্তাত্ত্বিক যোগ থাকে। দুঃসময়ের গ্লানি থেকে কিছু সময়ের জন্য ওদের পরিত্রাণ দেয়া যেতে পারে সেই 'যোগ' টাকে কাজে লাগিয়ে। তাই 'হোম কোয়ারান্টাইন' এর এই লম্বা সময়টাতে ওদের সাথে 'সংযোগ স্থাপন' শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এক ধরনের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে।

ভুলে যাবেন না সময় কিন্তু চলে গেছে প্রায় ১ মাস। ঈদের আগে স্কুলগুলো খুলবার সুযোগ নেই বললেই চলে। অর্থাৎ এপ্রিল, মে আরও প্রায় ২ টি মাস এই ছেলেমেয়েরা তাদের ক্লাসরুমে ফিরতে পারবে না।

ফেইসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম আর টিকটক বাদ দিয়ে হিসেব করি চলুন। আসলে আমরা 'কতটুকুন' ডিজিটাল নিজেরা হয়েছি এবং আমাদের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের করতে পেরেছি ? গ্রাম, মফস্বলের কথা আপাততঃ না করি। খোদ রাজধানীর আধুনিক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবকদের সাথে স্কুল গুলোর ডিজিটাল যোগাযোগ প্রকৃতপক্ষে কতটুকুন? এই বিষয়গুলো ভাববার সময় আমাদের আর কবে আসবে?

যে আপদকালীন সময় আমরা এখন পার করছি, আমরা কি আশা করছি যে, কোনরকমে এইবার আল্লাহ আল্লাহ করে বিপদটা কেটে যাক, পরের বছর করোনা আসার আগেই সবাইকে যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে 'ডিজিটাল' বানিয়ে ফেলবো?

প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই জাতীয় পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি তাদের একটা নিজস্ব পাঠ্যক্রম থাকে। অনেক ভেবেচিন্তে প্রতিটা ক্লাসের জন্য স্কুলগুলোর Academic Curriculum এবং Calendar তৈরী করা হয় বছরের শুরুতেই। করোনার ছোবলে আমাদের ছেলেমেয়েরা যে তাদের শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৩ টি মাস হারাতে যাচ্ছে, সেই ক্ষতি আমরা কিভাবে পূরন করবো? এই বিষয়গুলো কি আমরা ভেবেছি কিংবা ভাবছি? যদি ভেবে থাকি তবে সেগুলো কি স্কুলগুলোর beneficiaries দের সাথে আমরা শেয়ার করেছি? মে/জুন মাসে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল গুলোর বার্ষিক পরীক্ষা হবার কথা। সে পরীক্ষা আদৌ নেয়া সম্ভব কি না আমরা কেউ জানিনা। যদি নিতে না পারি তাহলে কি?

আগে তো জীবন। তারপর শিক্ষা জীবন। নিঃসন্দেহে কথাটি সত্য। যে দূর্যোগের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ সহ গোটা বিশ্ব যাচ্ছে, সেখানে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বা শিক্ষা জীবন নিয়ে এত গভীর ও জটিল আলোচনা শুনে মনে হতে পারে যে আমি সেই সত্যটিকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। না। আমি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি না। একজন অতি সাধারণ শিক্ষক হিসেবে কিছু বিষয়ে আমার নিজস্ব ভাবনা সকলের সাথে ভাগ করবার চেষ্টা করছি।

করোনার প্রতিকার নেই। প্রতিরোধের জন্য আমাদের সবাইকে ঘরবন্দী থাকতে হবে এবং আমরা থাকছি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ও বিস্তর এই বিস্তারের যুগে 'শুধুই ঘরে বসে থাকা' হয়তো ষাটোর্ধ অবসরপ্রাপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য একটা বাধ্য বাধকতা। কিন্তু স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলোর জন্য এ এক নির্মম প্রাকৃতিক নির্যাতন। কি করছে ওরা সারাদিন ঘরে বসে? ঘন্টার পর ঘন্টা নেটফ্লিক্স? ভিডিও গেইমস? ফেইসবুক? ঘুম?

অনেক শিক্ষিত, আধুনিক বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই ইউটিউব, গুগল ঘেটে বের করছেন কিভাবে এই দুঃসময়েও তাদের সন্তানদের Productive Quality Home-Quarantine Time দেয়া যায়। অনেকেই হয়তো নানান সীমাবদ্ধতায় সেটা পারছেনও না। কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করছি বা করতে পারছি?

দুঃখের দিনে, কষ্টের সময়গুলোতে যে আপনার সবচাইতে কাছে থাকার চেষ্টা করে, একটু আনন্দ দেবার উপলক্ষ খোঁজে, তাঁর কথা আপনি কখনও ভুলবেন না। আমরা কেউ ভুলি না। অসীম দুরন্তপনায় কাটানো একজন শিশু বা কিশোরের জীবন অনির্দিষ্টকালের জন্য যখন অকস্মাৎ চারদেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়, জানালা খুলে যখন তাকে শুধু মৃত্যুর মিছিল দেখতে হয়, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে সে কষ্টে আছে। আসুন ওদের কাছে থাকবার চেষ্টা করি। একটু আনন্দ দেবার চেষ্টা করি। আমাদের কথাও ওরা কোনদিন ভুলবেনা।

করোনার করুণ দিন শেষ হলে, যখন সবকিছু আবার আগের মতো হবে তখন 'প্রথম তুই কি করবি? কোথায় যাবি?'
আমার এক ছাত্রের ফেইসবুকে ওর ই আর এক বন্ধুর প্রশ্ন।
উত্তরে লেখা, 'স্কুলে যাবো'।

প্রার্থনা করি।
সেইদিনটি আসুক। খুব তাড়াতাড়ি আসুক। আবার হৈচৈ, কোলাহলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠুক আমাদের স্কুলের ক্লাসরুম আর করিডোরগুলো।







[ইংরেজি শব্দগুলোর ব্যবহার আমার সীমাবদ্ধতা বৈ আর কিছু নয় । ক্ষমা করবেন]






সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৪:৫৯
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×