somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগাররা জেনেনিনঃ আল্লাহকে সম্মান দেওয়া ও তাকে গালমন্দকারী সম্পর্কে ইসলামী বিধান

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আল্লাহ তা‘আলার জন্য সকল প্রশংসা, যেরূপ তার সম্মানের সঙ্গে উপযুক্ত। আমি তার নির্দেশ মোতাবেক যথাযথ শোকর জ্ঞাপন করছি, আরো স্বীকার করছি যে, বান্দা তার যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে অক্ষম, কারণ তারা তাকে জ্ঞান দ্বারা পূর্ণরূপে বেষ্টন করতে পারে নি (যাকে জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করা যায় না, তার পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভব নয়)।
আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামত অগণিত, যার যথাযথ শোকর আদায় করা কখনো সম্ভব নয়। তিনি ইহকাল ও পরকালের মালিক এবং তার নিকট সবার প্রত্যাবর্তন। একমাত্র তিনি ব্যতীত কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, একমাত্র তিনি ব্যতীত সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই। সালাত ও সালাম পাঠ করছি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।
অতঃপর
যুক্তি ও বিবেক উভয়ের সবচেয়ে বড় দাবী হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার মর্যাদা ও সম্মান জানা, যাঁর তাওহীদের ঘোষণা দেয় গোটা সৃষ্টিজগত। সকল সৃষ্টিজীবে সৃষ্টিকর্তার বড়ত্ব, মহান সৃষ্টির কারুকার্য ও নিখুঁত পরিকল্পনার স্বাক্ষর বিদ্যমান। যদি তারা সকলে নিজের দিকে মনোনিবেশ করে, নিজ সত্তার প্রতি ভাবনার দৃষ্টি দেয় ও গভীর চিন্তা করে, তাহলে অবশ্যই তারা সৃষ্টিকর্তার মহত্ত্ব নিজেদের মাঝে দেখতে পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَفِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٢١ ﴾ [الذاريات: ٢١]
“আর তোমাদের নিজেদের মধ্যেও [নিদর্শন রয়েছে]। তোমরা কি চক্ষুষ্মান হবে না? নূহ আলাইহিস সালাম তার কওমকে বলেন:
﴿ مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗا ١٣ وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارًا ١٤ ﴾ [نوح: ١٣، ١٤]
“তোমাদের কি হল, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের পরোয়া করছ না? অথচ তিনি তোমাদেরকে নানাস্তরে সৃষ্টি করেছেন”।
এ আয়াতের অর্থ ইব্ন আব্বাস ও মুজাহিদ বলেন: “তোমরা আল্লাহর মর্যাদার পরোয়া করো না”। ইব্ন আব্বাস আরো বলেন: “তোমাদের কি হল, তোমরা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছ না?”
নবী নূহ আলাইহিস সালাম তার জাতিকে স্বীয় নফস ও সৃষ্টির স্তরসমূহে চিন্তার আহ্বান করেছেন, যেন তারা নিজেদের উপর সৃষ্টিকর্তার হক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহকে সম্মান দেওয়া ও তার অধিকার জানার জন্য নিজের নফস ও সৃষ্টির স্তরসমূহ দেখাই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আসমান ও জমিনে বিদ্যমান সকল সৃষ্টিজীবের উপর চিন্তা করবে তার অবস্থা কেমন হবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ আল্লাহর মর্যাদা বুঝে না, কারণ তারা তার নিদর্শনসমূহ ভাবনার দৃষ্টিতে দেখে না; দেখে না চিন্তা, গবেষণা ও উপদেশ গ্রহণের গভীর আগ্রহে, তারা দেখে শুধু উপভোগ ও দ্রুত বা অবহেলার দৃষ্টিতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَكَأَيِّن مِّنۡ ءَايَةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ يَمُرُّونَ عَلَيۡهَا وَهُمۡ عَنۡهَا مُعۡرِضُونَ ١٠٥﴾ [يوسف: ١٠٤]
“আর আসমানসমূহ ও জমিনে কত নিদর্শন রয়েছে, যা তারা অতিক্রম করে চলে যায়, অথচ সেগুলো থেকে তারা বিমুখ”। বিমুখ অন্তর ও গাফেল হৃদয়কে এসব নিদর্শন আকৃষ্ট করে না, মুজিযাসমূহ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। একমাত্র তারাই আল্লাহকে মর্যাদা দেয়, যারা তাকে দেখে, অথবা তার নিদর্শন দেখে ও তার গুণগান জানে। গাফেল ও বিমুখ অন্তরে আল্লাহর মর্যাদা মূল্যহীন, ফলশ্রুতিতে তার সাথে কুফরি ও তার নাফরমানি করা হয়, কখনো তাকে গালি দেওয়া হয়, তার সাথে উপহাস করা হয়। মহানের মহত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা পরিমাণ তার নাফরমানি করা হয়, অন্তর থেকে যে পরিমাণ তার মর্যাদা ও বড়ত্ব হ্রাস পায়, সে পরিমাণ তার কুফরি করা হয় ও তার হক অস্বীকার করা হয়। আর দুর্বলের আনুগত্য তার দুর্বলতা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিমাণ অনুযায়ীই করা হয়, অন্তরে যে পরিমাণ তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, সে পরিমাণ তার ইবাদত করা হয় ও তাকে সম্মান দেওয়া হয়।
আর এ জন্যই মুশরিকরা মূর্তির ইবাদত করেছে এবং যিনি পুনরায় জীবিত করবেন তার সাথে কুফরি করেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ত্রুটির বর্ণনা দিয়ে বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٞ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥٓۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَن يَخۡلُقُواْ ذُبَابٗا وَلَوِ ٱجۡتَمَعُواْ لَهُۥۖ وَإِن يَسۡلُبۡهُمُ ٱلذُّبَابُ شَيۡٔٗا لَّا يَسۡتَنقِذُوهُ مِنۡهُۚ ضَعُفَ ٱلطَّالِبُ وَٱلۡمَطۡلُوبُ ٧٣ مَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٧٤﴾ [الحج : ٧٣، ٧٤]
“হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। তারা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দেয় না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাক্ষমতাবান, মহাপরাক্রমশালী।
* আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান দেওয়ার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে: তার সিফত ও গুণগানের জ্ঞান হাসিল করা, তার নিদর্শনসমূহ চিন্তা করা, তার নিয়ামত ও অনুগ্রহসমূহ নিয়ে ভাবা। অতীত জাতিগুলোর অবস্থা, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী, মুমিন ও কাফিরদের পরিণতি জানা ও সেগুলো থেকে উপদেশ গ্রহণ করা।
* আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান দেওয়ার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে: তাঁর শরীয়ত, আদেশ-নিষেধগুলো জানা ও সম্পাদন করা, তার বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও সাধ্যানুসারে তার উপর আমল করা। কারণ এগুলো অন্তরে ঈমানকে পুনর্জীবিত করে। কেননা, ঈমানেরও জ্যোতি ও উত্তাপ আছে। (আপনি যার উপর ঈমান রাখেন, তিনি নির্দেশ করেন ও নির্দেশনা প্রদান করেন) কিন্তু যিনি নির্দেশ প্রদান করলে তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করা হয় না, যিনি নিষেধ করলে তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকা হয় না, তাঁর প্রতি আপনার ঈমানের উত্তাপ হ্রাস পাবে ও তার জ্যোতি নিষ্প্রভ হবে। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা হজ্জের হাদি ও বিভিন্ন নিদর্শন প্রসঙ্গে বলেন:
﴿ ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢ ﴾ [الحج : ٣٢]
“এটাই হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই”।
আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন মানে হুকুমদাতাকে সম্মান করা। তাই নাস্তিকতা, আল্লাহকে অস্বীকার করা ও তার সাথে কুফরি করার পূর্বে, তার আদেশ ও নিষেধের প্রতি উপেক্ষা ও তার সাথে তাচ্ছিল্যের আচরণ প্রকাশ পায়।
আল্লাহ ও তার মর্যাদা সম্পর্কে কতক অজ্ঞ বিমুখ লোকের নিকট, যারা ইতোপূর্বে তার আদেশ ও নিষেধ অবজ্ঞা করেছে, আল্লাহকে গালমন্দ করা, তাকে কতক শব্দ দ্বারা বিশেষায়িত ও সম্বোধন করা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে শাম, ইরাক ও আফ্রিকার কতক দেশে, যা মুমিনদের মুখে উচ্চারণ করা, কিংবা তাদের কানে শ্রবণ করা কঠিন ঠেকে । এ জাতীয় বাক্য উচ্চারণকারী কতক লোক আবার নিজেদের মুসলিম দাবি করে, যেহেতু তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে বিশ্বাস করে। হয়তো কতক মুসল্লি থেকেও এরূপ কথা প্রকাশ পায়, কারণ শয়তান তাদের মুখের উপর এসব চালু করেছে এবং সে তাদেরকে প্ররোচনা দেয় যে, এ কথার প্রকৃত অর্থ ও সৃষ্টিকর্তাকে হেয় করা উদ্দেশ্য নয়। তাদেরকে সে বুঝায় এ জাতীয় কথা অর্থহীন, এ জন্য জবাবদিহি করা হয় না! তাই তারা অবলীলায় তা বলে বেড়ায়।
অতএব সবার সামনে প্রকাশ করা জরুরি যে, সুস্থ বিবেক ও সকল আসমানি ধর্ম মতে এসব কথা ভ্রান্ত ও জঘন্য। এভাবে শয়তানের প্রবঞ্চনা বন্ধ হবে, মানুষ আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দিবে ও সকল অশোভন বাক্য থেকে তার পবিত্রতা ঘোষণা করবে, যে নিয়তে হোক ও যেভাবে হোক এসব কথা উচ্চারণ থেকে বিরত থাকবে।
সারসংক্ষেপ:
যেসব কথা বা কর্ম দ্বারা আল্লাহকে খাটো ও হেয় করা হয় তাই গালমন্দ, তাই কুফরি। এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই, ইচ্ছায় হোক, অথবা খেল-তামাশায় হোক, উপহাস করে হোক, অথবা অবহেলা ও মূর্খতায় হোক। এ ব্যাপারে উদ্দেশ্য কিংবা নিয়ত দিয়ে কোনো তফাৎ না করে করা যাবে না, বরং বাহ্যিক অবস্থার উপরই ফয়সালা করা হবে।

* * *

গালমন্দের বাস্তবতা ও গালমন্দের অর্থ
মানুষ তাদের পরিভাষায় যেসব শব্দকে গালি বলে, অথবা উপহাস বলে, অথবা তাচ্ছিল্য বলে, শরীয়তের দৃষ্টিতেও তাই গালি, উপহাস ও তাচ্ছিল্য বলা হয়। এ ক্ষেত্রে মানুষের পরিভাষাই বিচারক হিসেবে ধর্তব্য হবে, যেমন লানত, অপমান, অশ্লীল বাক্য এবং হাত দ্বারা খারাপ ও অশালীন ইঙ্গিত। নির্দিষ্ট কোনো দেশে যা গালি ও উপহাস হিসেবে পরিচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে সেখানে তাই গালি ও উপহাস হিসেবে গণ্য, যদিও অন্য দেশে তা গালি নয়।
* * *

আল্লাহ তা‘আলাকে গালমন্দ করার বিধান
আল্লাহকে গালি দেওয়া কুফরি, গালিদাতাকে হত্যা করা ওয়াজিব। এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই। দ্বিমত শুধু তার তওবার ক্ষেত্রে, তওবা তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিবে কি দিবে না, যদি সে তওবা করে? এ সম্পর্কে দু’টি মত প্রসিদ্ধ।
আল্লাহকে গালি দেওয়া ও তাঁর সাথে উপহাস করা, মূলত তাঁকে বড় কষ্ট দেওয়া। কষ্ট দেওয়ার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمۡ عَذَابٗا مُّهِينٗا ٥٧ وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٥٨ ﴾ [الاحزاب : ٥٧، ٥٨]
“নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন, এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অপমানজনক আযাব। আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে তাদের কৃত কোনো অন্যায় ছাড়াই কষ্ট দেয়, নিশ্চয় তারা বহন করবে অপবাদ ও সুস্পষ্ট পাপ”।
আল্লাহকে কষ্ট দেয়ার অর্থ তার ক্ষতি করা নয়, কারণ কষ্ট দু’প্রকার: এক প্রকার কষ্ট ক্ষতি করে, অপর প্রকার কষ্ট ক্ষতি করে না। আল্লাহ তা‘আলাকে কোনো বস্তু ক্ষতি করতে পারে না। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
«يَا عِبَادِي: إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي، فَتَضُرُّونِي»
“হে আমার বান্দাগণ, তোমরা নিশ্চয় আমার ক্ষতি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যে, আমাকে ক্ষতি করবে”।
* যে আল্লাহকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা‘নত করেছেন। লা‘নত অর্থ বান্দাকে রহমত থেকে বিতাড়িত করা। এ আয়াত প্রমাণ করে কষ্টদাতা দু’টি রহমত থেকে বঞ্চিত: ইহকালীন রহমত ও পরকালীন রহমত। কাফির ব্যতীত কাউকে এ দু’টি রহমত থেকে বঞ্চিত করা হয় না! এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যে, তারপরে আল্লাহ মুমিন নারী ও পুরুষদের কষ্ট দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের কষ্টদাতাকে তিনি উভয় জগতে লানত করেন নি; কারণ, গালমন্দ, লানত ও অপবাদ দ্বারা কেউ কাউকে কষ্ট দিলে কাফির বলা হবে না, তবে এসব বাক্য বলা স্পষ্ট পাপ ও অপবাদ হিসেবে ধর্তব্য হবে, যদি না সেটার পক্ষে কোনো দলিল না থাকে।
দ্বিতীয়ত তাঁকে কষ্টদাতার জন্য তিনি ‘আযাবে মুহিন’ তথা মর্মন্তুদ শাস্তির কথা উল্লেখ বলেছেন, কুরআনুল কারীমে তিনি কাফের ব্যতীত অন্য কারো জন্য এ শাস্তি উল্লেখ করেন নি।
* আল্লাহ তা‘আলাকে গালমন্দ করা সকল কুফরি অপেক্ষা বড় কুফরি, মূর্তিপূজকদের কুফরি অপেক্ষাও বড়, কারণ তারা আল্লাহর প্রতি তাদের সম্মান থেকে পাথরকে সম্মান করে। তারা আল্লাহর মর্তবা হ্রাস করে পাথরের সমকক্ষ আল্লাহকে করে নি, বরং পাথরের সম্মান বৃদ্ধি করে তারা পাথরকে আল্লাহর সমকক্ষ করেছে। তাই মুশরিকরা জাহান্নামে প্রবেশ করে বলবে:
﴿تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨﴾ [الشعراء : ٩٧، ٩٨]
“আল্লাহর কসম! আমরা তো সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিলাম। যখন আমরা তোমাদেরকে সকল সৃষ্টির রবের সমকক্ষ বানাতাম”।
মুশরিকরা পাথরকে আল্লাহর সমকক্ষ করার জন্য উচ্চে তুলেছে, কিন্তু আল্লাহকে পাথরের সমকক্ষ করার জন্য নিচে নামায় নি। তারা তাদের ধারণা মতে, আল্লাহর সম্মানের অংশ হিসেবে পাথরকে সম্মান করে, পক্ষান্তরে আল্লাহকে গালমন্দকারী তাঁকে নিচে নামায়, যেন তিনি তার গালির কারণে পাথরের চেয়ে মূল্যহীন হন। মুশরিকরা তাদের প্রভুকে খেলার ছলেও গালি দেয় না, কারণ তারা প্রভুকে সম্মান করে। তাই যারা তাদের প্রভুকে গালি দেয়, তাদেরকে তারা গালি দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تَسُبُّواْ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَسُبُّواْ ٱللَّهَ عَدۡوَۢا بِغَيۡرِ عِلۡمٖۗ ١٠٨ ﴾ [الانعام: ١٠٨]
“আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে, ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে, শত্রুতা পোষণ করে অজ্ঞতাবশত”।
মুশরিকরা যদিও কাফির, তবু আল্লাহ তার নবীকে তাদের মূর্তিদের গালমন্দ করতে নিষেধ করেছেন, যেন তারা এরচেয়ে বড় কুফরিতে লিপ্ত না হয়, অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাবুদকে গালি দেওয়া।
* আল্লাহকে গালমন্দ করার কতক শব্দ নাস্তিকতার চেয়েও বড় কুফরি, কারণ নাস্তিক তো সৃষ্টিকর্তা ও রবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অর্থাৎ তার অবস্থা বলে: ‘আমি যদি আল্লাহকে মানতাম, তাহলে অবশ্যই তাকে সম্মান করতাম’।
আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী করে আল্লাহকে গালমন্দ করে, সে তার রবকে স্বীকার করেও তাকে গালি দেয়। এটা প্রকাশ্য অবাধ্যতা ও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া।
কোনো শহরে মূর্তি স্থাপন করা, তার চারপাশে তওয়াফ করা, তাকে সেজদা দেওয়া ও তার থেকে বরকত হাসিল করা; সে শহরের অলিতে-গলিতে, রাস্তায়, বাজারে ও মজলিসে আল্লাহর গালমন্দ প্রচার করা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিক সহজ। কারণ আল্লাহকে গালমন্দ করার স্পর্ধা শির্কের চেয়েও মারাত্মক, যদিও উভয় কাজ কুফরি, তবে মুশরিক আল্লাহকে সম্মান করে, গালমন্দকারী আল্লাহকে অসম্মান করে। আল্লাহ তাদের অসম্মান থেকে পবিত্র।
* অনুরূপ, কোনো শহরে যিনার বৈধতা দেওয়া ও তার প্রসার করা অপেক্ষা অধিক জঘন্য তাতে আল্লাহকে গালমন্দ করা ও তার প্রচার করা, বরং কওমে লুতের অশ্লীলতা ও তার অনুমোদন থেকেও সেটা জঘন্য। অশ্লীলতাকে হালাল মনে করা হচ্ছে এমন কুফরি, যাতে আল্লাহর শরীয়তকে অস্বীকার ও তার বিধানকে হেয় করা হয়। পক্ষান্তরে গালমন্দ করা; সেটা এমন কুফরি, যার লক্ষ্য খোদ আল্লাহ তা‘আলা, যিনি শরীয়ত প্রদান করেন, আর স্বয়ং শরীয়তদাতাকে গালি দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, তাঁর প্রবর্তিত যাবতীয় শরীয়তকেই অস্বীকার করা, সেগুলোকে হেয় জ্ঞান করা। এটা সবচেয়ে বড় ও কঠোর; যদিও উভয় কর্ম কুফরি, তবে কুফরির রয়েছে অনেক অধোমূখী স্তর, যেমন ঈমানের রয়েছে অনেক উর্ধ্বমূখী স্তর।
* আল্লাহ তা‘আলা নাসারাদের কুফরি ও আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করার মাধ্যমে তাঁকে গালমন্দ করার বিষয়টি উল্লেখ শেষে, তাদের বড় অপরাধ উল্লেখ করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, মূর্তি ও নক্ষত্র পূজকদের শির্কের চেয়েও সন্তান সাব্যস্ত করে তাকে গালমন্দ করার পাপ অনেক বড়। তিনি বলেন:
﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَلَدٗا ٨٨ لَّقَدۡ جِئۡتُمۡ شَيًۡٔا إِدّٗا ٨٩ تَكَادُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ يَتَفَطَّرۡنَ مِنۡهُ وَتَنشَقُّ ٱلۡأَرۡضُ وَتَخِرُّ ٱلۡجِبَالُ هَدًّا ٩٠ أَن دَعَوۡاْ لِلرَّحۡمَٰنِ وَلَدٗا ٩١ وَمَا يَنۢبَغِي لِلرَّحۡمَٰنِ أَن يَتَّخِذَ وَلَدًا ٩٢ إِن كُلُّ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ إِلَّآ ءَاتِي ٱلرَّحۡمَٰنِ عَبۡدٗا ٩٣ لَّقَدۡ أَحۡصَىٰهُمۡ وَعَدَّهُمۡ عَدّٗا ٩٤ وَكُلُّهُمۡ ءَاتِيهِ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فَرۡدًا ٩٥ ﴾ [مريم: ٨٨، ٩٥]
“আর তারা বলে, ‘পরম করুণাময় সন্তান গ্রহণ করেছেন’। অবশ্যই তোমরা এক জঘন্য বিষয়ের অবতারণা করেছ। এতে আসমানসমূহ ফেটে পড়ার, জমিন বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কারণ তারা পরম করুণাময়ের সন্তান আছে বলে দাবী করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা পরম করুণাময়ের জন্য শোভনীয় নয়। আসমান ও জমিনে এমন কেউ নেই, যে বান্দা হিসেবে পরম করুণাময়ের কাছে হাযির হবে না। তিনি তাদের সংখ্যা জানেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে গণনা করে রেখেছেন। আর কিয়ামতের দিন তাদের সকলেই তার কাছে আসবে একাকী।
কারণ আল্লাহর সন্তান দাবি করে তাকে হেয় ও গালমন্দ করা হয়। আল্লাহকে গালমন্দ করা অপেক্ষা তার সাথে শির্ক করা গৌণ অপরাধ। মুশরিকরা মখলুককে উপরে তুলে আল্লাহর পর্যায়ে নিয়ে যায়, খৃস্টানরা সন্তান সাব্যস্ত করে আল্লাহকে মখলুকের স্থানে নিয়ে আসে, যেন সেও মখলুক। মূর্তিপূজায় মখলুককে উপরে তুলে সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ করা হয়। তাই মখলুকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা অপেক্ষা আল্লাহর সম্মান হ্রাস করা বড় কুফরি।
আল্লাহকে গালমন্দ করা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ ঈমান পরিপন্থী এবং অন্তরের স্বীকৃতিরও বিপরীত, অর্থাৎ সেটা আল্লাহকে বিশ্বাস করা, তার অস্তিত্বের উপর ঈমান আনা ও একমাত্র তিনি ইবাদতের হকদার আকিদা পরিপন্থী। অনুরূপ গালমন্দ করা অন্তরের আমলেরও বিপরীত, অর্থাৎ সেটা আল্লাহকে মহব্বত করা, তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর বিপরীত। কারণ, আপনি যাকে গালমন্দ করেন, তার প্রতি আপনার সম্মানের ধারণা কখনো ঠিক নয়। উদাহরণত: আল্লাহ ও পিতা-মাতার সম্মান, যে পিতা-মাতার মহব্বতের দাবি করে তাদের গালমন্দ ও উপহাস করে, সে কপট ও মিথ্যাবাদী। অনুরূপভাবে আল্লাহকে গালমন্দ করা, বাহ্যিক ঈমান তথা কালিমার সাক্ষ্য ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল পরিপন্থী।


আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরি প্রসঙ্গে আলেমগণের ঐকমত্য
প্রত্যেক মাযহাবের আলেম, যারা বলেন, ঈমান হচ্ছে কথা ও কাজের নাম, তাদের নিকট আল্লাহকে গালি দেওয়া কুফরি। সুস্পষ্টভাবে গালি দেওয়া বা মানহানির ব্যাপারে গালিদাতার কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
হারব রহ. তার মাসায়েল গ্রন্থে মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: “যে আল্লাহকে কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, তাকে হত্যা কর”।
ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মুজাহিদ রহ. বর্ণনা করেন: “যে কোনো মুসলিম আল্লাহকে কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, সে আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যারোপ করল, এটা তার ধর্ম ত্যাগ। তার নিকট তওবা তলব করা হবে, যদি সে ফিরে আসে ভাল, অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে। আর যে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি অবাধ্য হল ও আল্লাহকে গালমন্দ করল, কিংবা কোনো নবীকে গালমন্দ করল, অথবা গালমন্দ প্রকাশ করল, সে চুক্তি ভঙ্গ করল, অতএব তোমরা তাকে হত্যা কর”।
আল্লাহকে গালমন্দকারী সম্পর্কে ইমাম আহমদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন: “আল্লাহকে গালমন্দকারী মুরতাদ, তাকে হত্যা করা হবে”। তার ছেলে আব্দুল্লাহ তার মাসায়েল গ্রন্থে এরূপই বর্ণনা করেছেন।
একাধিক আলেম গালমন্দকারীর কুফরি ও তাকে হত্যা প্রসঙ্গে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন:
ইব্ন রাহাওয়ায়হে রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “সকল মুসলিম একমত যে, আল্লাহকে যে গালি দিল, অথবা তার রাসূলকে গালি দিল, অথবা আল্লাহর নাযিলকৃত কোন বস্তু প্রত্যাখ্যান করল, অথবা তার কোনো নবীকে হত্যা করল, সে কাফের; যদিও সে আল্লাহর নাযিলকৃত অহি বিশ্বাস করে”।
কাদি ইয়াদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “এ প্রসঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোনো মুসলিম আল্লাহকে গালমন্দ করলে কাফিরে পরিণত হবে, তার রক্ত হালাল”।
আরো অনেক আলেম আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরির উপর ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন, যেমন ইব্ন হাযম প্রমুখ। অনেক ইমাম গালমন্দকারীকে কাফির বলেছেন, যেমন ইব্ন আবি যায়েদ আল-কাইরোয়ানী ও ইব্ন কুদামাহ প্রমুখ।
সকল আলেম আল্লাহকে গালমন্দকারীর কুফরির উপর একমত। তারা গালমন্দকারীর কোনো অজুহাত গ্রহণ করেন নি, কারণ সামান্য জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও কোন্টি গালি ও কোন্টি গালি নয় পার্থক্য করতে সক্ষম, কোন্টি প্রশংসা ও কোন্টি কুৎসা ভালো করে জানে, তবু ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে গালমন্দ করে।
ইব্ন আবি যায়েদ আল-কায়রোয়ানী আল-মালিকিকে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে লানত করার সাথে আল্লাহকেও লানত করে অজুহাত পেশ করেছে যে, আমার ইচ্ছা ছিল শয়তানকে লানত করা, কিন্তু আমার মুখ ফসকে গেছে।
ইব্ন আবি যায়েদ উত্তর দিলেন: “স্পষ্ট কুফরিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে, তার কোনো অজুহাত গ্রহণ করা যাবে না, মশকরা করে বলুক, অথবা ইচ্ছা করে বলুক”।
অনুরূপভাবে যাহিরিয়াহ ও চার মাযহাবের আলেম, বিচারক ও মুফতিগণ তারা সবার নিকটই বাহ্যিক অবস্থার উপরই ফতোয়া ও ফয়সালা দেওয়া হবে, সে ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ অবস্থা আমলে নেওয়া হবে না, যদিও গালমন্দকারী বলে তার গালমন্দ করার ইচ্ছা ছিল না।
আলেমগণ যদি সুস্পষ্ট বাহ্যিক শরীয়তবিরোধী বিষয়গুলোকে, গোপনে প্রকাশ্যের বিপরীত কথা থাকার দাবিসমূহের কারণে, ত্যাগ করতে শুরু করেন, তাহলে শরয়ী আহকামের নাম, বিধান, শাস্তি ও হদগুলো বাতিলে পরিণত হবে, মানুষের কোনো সম্মান ও অধিকার থাকবে না। কোনো মুসলিমকে কাফের থেকে, কোনো মুনাফিককে মুমিন থেকে পৃথক করা যাবে না। কপট ও অন্তরের ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকের মুখে দীন ও দুনিয়া খেলনায় পরিণত হবে।
* * *

গালমন্দ কুফরি যদিও তাতে কুফরের উদ্দেশ্য না থাকে
আল্লাহকে গালমন্দ করা কুফরি, এতে কোনো দ্বিমত নেই। অনিচ্ছা অবহেলায় প্রকাশ পেয়েছে, আল্লাহর সম্মানে খারাপ ইচ্ছা ছিল না, সাধারণ লোকের এরূপ অজুহাতের কোনো মূল্য নেই।
এরূপ অজুহাত অজুহাতপ্রদানকারীর মূর্খতার প্রমাণ, জাহাম ইব্ন সাফওয়ান ও কট্টর মুরজিয়া, যারা বলে: বিশ্বাস ও অন্তরের জ্ঞানই ঈমান, তারা ব্যতীত কেউ তা গ্রহণ করার পক্ষে মত দেয় নি। এটাও ঈমান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ, তারা জানে না: ‘কথা ও কর্মের সমন্বয়ে ঈমান’, অর্থাৎ মুখ ও অন্তর দ্বারা কালেমা শাহাদাতের স্বীকৃতি এবং অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করাকে ঈমান বলা হয়।
কট্টর মুরজিয়াদের দৃষ্টিতে বাহ্যিক আমল ঈমানের দলিল নয়, তাই তারা অন্তর না দেখে ঈমান অস্বীকার করে না, বাহ্যিক কথার বিপরীত হলেও তারা অন্তরের দাবি বিশ্বাস করে।
বস্তুত ঈমানের রয়েছে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ দু’টি অংশ। উভয়ের একটির সাথে অপরটি সাব্যস্ত হলে ঈমান সাব্যস্ত হবে, পক্ষান্তরে দু’টির যে কোনো একটির অনুপস্থিতিতে পুরো ঈমানই নাই হয়ে যাবে।
কাফের যেরূপ কুফরির ইচ্ছা ও নিয়তের কারণে কাফির হয়, যদিও সে মুখে উচ্চারণ না করে, কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা কাজে পরিণত না করে; সেরূপ কথার কারণে ব্যক্তি কাফির হবে, যদিও সে কুফরির নিয়ত না করে, কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা কাজে পরিণত না করে। তাই যে কুফরি কাজ করে, সেও কাফির, যদিও সে অন্তরে কুফরির ইচ্ছা না করে, কিংবা মুখে না বলে।
শরীরের কোনো অঙ্গ হারাম কাজে লিপ্ত হলে, তাকে সেটার জন্যও পাকড়াও করা হবে, তার অন্তরের বিষয়টি আল্লাহর উপর সোপর্দ। কুফরি প্রকাশ পাওয়ার কারণে যাকে কাফির ফতোয়া দেওয়া হয়, সে আল্লাহর নিকটও কাফের হবে এরূপ জরুরি নয়, আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আল্লাহর উপর সোপর্দ, তবে দুনিয়ায় বাহ্যিক দেখে বান্দার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
যে আল্লাহর সাথে, তার কিতাবের সাথে ও তার রাসূলের সাথে উপহাস করে, আল্লাহ তাকে কাফির বলেছেন, অনিচ্ছার অজুহাত তিনি গ্রহণ করেন নি, তিনি ইরশাদ করেন:
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ إِن نَّعۡفُ عَن طَآئِفَةٖ مِّنكُمۡ نُعَذِّبۡ طَآئِفَةَۢ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ مُجۡرِمِينَ ٦٦﴾ [التوبة: 65، 95]
“আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, ‘আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরি করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী”।
বিবেকও বলে মানুষকে তার কথার কারণে পাকড়াও করা হোক। সুতরাং কাউকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলে সেটার শাস্তি না দেওয়ার জন্য ওজর গ্রহণযোগ্য হবে না, অনুরূপভাবে কোনো শাসককে গালি ও তাকে লা‘নত করলেও সেটা তার উদ্দেশ্য ছিল না বললেই গ্রহণযোগ্য কথা হবে না! বস্তুত: আল্লাহ তা‘আলা বিনা দলিলে যিনার অপবাদদাতাকে আশি বেত্রাঘাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যদিও সে বলে অপবাদ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না, অনুরূপ তার ঠাট্টা ও মশকরার নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।
তদ্রূপ কোনো শাসক যদি তার ইজ্জত নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টাকারীকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়, তাহলে তার ভয় মানুষের অন্তর থেকে বিদায় নিবে। তাই আপনি দেখবেন এ জাতীয় অপরাধের কারণে তিনি মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন: তারা ইচ্ছায় বলুক বা অনিচ্ছায় বলুক।
মানুষকে তার অপরাধ ও জুলমের কারণে পাকড়াও করার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নার একাধিক জায়গায় এসেছে। বিবেক এবং কুরআন ও সুন্নায় স্বীকৃত যে, এ ব্যাপারে সেটার বড়ত্ব ও যথাযথ মর্যাদা জানার ক্ষেত্রে অবহেলাকারীর কোনো অজুহাত গ্রহণ করা হবে না।
সহি গ্রন্থে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَإِنَّ الْعَبْدَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللَّهِ لَا يُلْقِي لَهَا بَالًا، يَهْوِي بِهَا فِي جَهَنَّمَ»
“নিশ্চয় বান্দা আল্লাহর অপছন্দনীয় এমন বাক্য উচ্চারণ করে, যার পরোয়া সে করে না, (গুরুত্ব সে দেয় না) তার কারণে সে জাহান্নামের নিক্ষিপ্ত হয়”।
এখানে দেখছি, বান্দা তার কথার কোনো পরোয়া করে নি বা গুরুত্ব দিয়ে বলে নি, এ জন্য আল্লাহ তাকে ছাড় দেন নি, বরং তার জন্য তিনি শাস্তি অবধারিত করেছেন। অর্থাৎ বান্দা তার কথার মূল্য ও তিক্ততা (সম্পর্কে বলার সময়) চিন্তা করে নি, অর্থ বুঝতে অবহেলা করেছে। সে যদি তার কথা চিন্তা করত ও সামান্য ভেবে দেখত, তাহলে তার কথার খারাপি সে বুঝত।
বেলাল ইব্ন হারেস নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:
«وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سُخْطِ اللَّهِ، مَا يَظُنُّ أَنْ تَبْلُغَ مَا بَلَغَتْ، فَيَكْتُبُ اللَّهُ تعالى عَلَيْهِ بِهَا سُخْطَهُ إِلَى يَوْمِ يَلْقَاهُ»
“নিশ্চয় তোমাদের কেউ আল্লাহর গোস্বার এমন বাক্য উচ্চারণ করে, সে চিন্তাও করে না বাক্যটি যেখানে পৌঁছেছে সেখানে পৌঁছবে, ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তার উপর তার সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত স্বীয় গোস্বা অবধারিত করে দেন”।
অতএব মানুষের বলা যে, আল্লাহ তা‘আলাকে গালমন্দ করা, লানত করা, হেয় করা অথবা অপমান করার ইচ্ছা ব্যতীত মুখের উপর চলে এসেছে, এ জাতীয় অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়, এটাও তার এক ধরণের বাহানা, যা ইবলিস তার অন্তরে সৃষ্টি করে। ইবলিস এভাবে তাকে কুফরির উপর অটল রাখে, আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতায় তাকে সান্ত্বনা দেয়। বস্তুত শয়তান মানুষকে যখন কুফরির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, সে তার সামনে অসার অযৌক্তিক কতক অজুহাত ও শরয়ী অপব্যাখ্যা তৈরি করে দেয়, যা প্রবৃত্তি মুক্ত সুস্থ বিবেকের সামনে টিকে না।

ইবলিসের প্ররোচনা ও সন্দেহ সৃষ্টি:
মানুষ যখন কোনো অপরাধ করে, ইবলিস তার সামনে তার কৃত ইবাদতগুলো পেশ করে, যা তার পাপের আফসোস ও গুনাহের কারণে সৃষ্ট দুঃখ তার অন্তর থেকে দূর করে দেয়। উদাহরণত আল্লাহকে গালমন্দকারীকে সে বলে: ‘তুমি শাহাদাতের কালেমাহ উচ্চারণ কর, পিতা-মাতার আনুগত্য কর ও সালাত আদায় কর, তোমার এতে সমস্যা হবে না’।
শয়তানের এরূপ প্ররোচনার কারণে মক্কার মুশরিকরা গোমরাহ হয়েছে। তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তির ইবাদত করেছে, আর শয়তান তাদের সামনে হাজিদের পানি পান করানো, মসজিদে হারাম আবাদ করা ও কাবায় পোশাক পড়ানোর ন্যায় ভালো কাজগুলো পেশ করেছে, অথচ শির্কের মোকাবিলায় এগুলো আল্লাহর নিকট তাদের কোনো উপকারে আসে নি। কারণ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা তার সম্মান পরিপন্থী, তারা বায়তুল্লাহকে সম্মান করে তার রবের সাথে কুফরি করেছে। অথচ রবের কারণে বায়তুল্লাহ সম্মানিত হয়েছে, বায়তুল্লাহর কারণে রব সম্মানিত হয় নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿أَجَعَلۡتُمۡ سِقَايَةَ ٱلۡحَآجِّ وَعِمَارَةَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ كَمَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَجَٰهَدَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ لَا يَسۡتَوُۥنَ عِندَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩﴾ [التوبة: 19]
“তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও মসজিদুল হারাম আবাদ করাকে ঐ ব্যক্তির মত বিবেচনা কর, যে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে। তারা আল্লাহর কাছে বরাবর নয়। আর আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়েত দেন না”।
কতক মানুষের ঈমানের দাবীই সর্বস্ব, তাদের মধ্যে ঈমানের কোনো আলামত নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨﴾ [البقرة: ٨]
“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি, অথচ তারা মুমিন নয়”।
অতএব আল্লাহকে গালমন্দ ও উপহাস করে, তাঁকে সম্মান দেখানোর দাবী ও কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করার কোনো অর্থ হয় না।

আল্লাহকে গালমন্দকারীর শাস্তি
সকল আলেম একমত যে, আল্লাহকে যে গালমন্দ করবে, তাকে কুফরির কারণে হত্যা করা হবে, হত্যার পর মুসলিমদের হুকুম তার জন্য প্রযোজ্য হবে না, যেমন তার উপর সালাত পড়া, তাকে গোসল ও কাফন-দাফন দেওয়া, তার জন্য দোয়া করা ইত্যাদি। সে মুসলিম নয়, তাই তার উপর সালাত পড়া হবে না, তাকে গোসল ও মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে না এবং তার জন্য দোয়া করা বৈধ নয়।
আল্লাহকে গালমন্দকারী যদি জঘন্য কথা ও কর্ম থেকে তওবা করে, তার তওবা কুবল করা হবে কিনা এ ব্যাপারে আলেমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে তার থেকে তওবা তলব করা হবে, না দুনিয়ায় তার তওবার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, আখিরাতে তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর সোপর্দ করে, তাকে হত্যা করা হবে? এ ব্যাপারে দু’টি মত প্রসিদ্ধ:
প্রথম মত: তার তওবার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হবে না, তওবা তলব করা ব্যতীত তাকে হত্যা করা ওয়াজিব, তার তওবা আখিরাতে আল্লাহর উপর সোপর্দ। এটি হাম্বলি মাযহাব ও অন্যান্য ফকিহদের প্রসিদ্ধ অভিমত। ওমর, ইব্ন আব্বাস ও অন্যান্যদের বাহ্যিক অভিমত তাই, এটা ইমাম আহমদের প্রসিদ্ধ মত।
কারণ: তওবা বাহ্যিক অপরাধ রহিত করে না, মানুষের সামনে আল্লাহকে গালমন্দ ও তাকে উপহাস করার কু-প্রভাব অপনোদন করে না। তওবা কবুল করা হলে এ জাতীয় অপরাধ মানুষ শিথিল মনে করবে। তাদেরকে যখন সরকার ও বিচারের সম্মুখীন করা হবে, তারা তওবা প্রকাশ করবে, অতঃপর তওবা ত্যাগ করবে। তাই এ সুযোগ তাদেরকে কুফরির উপর উদ্বুদ্ধ করে গালমন্দ করার অপরাধবোধ গৌণ করে দেয়। অপরাধীকে আদব শিক্ষা দেওয়া ও অপরাধ থেকে পবিত্র করা এবং যে তার কথার ন্যায় কথা বলে, কিংবা তার কর্মের ন্যায় কর্ম করে, তাকে বিরত রাখা ইত্যাদি উদ্দেশ্যগুলো তওবা কবুল করা হলে ব্যাহত হয়।
দ্বিতীয় মত: যদি সে সত্য তওবা করে এবং কখনো তাতে লিপ্ত না হয়, তাহলে গ্রহণ করা হবে, জমহুর ফকিহগণ এ কথা বলেন।
কারণ: গালমন্দ করা কুফরি, কুফরি থেকে প্রত্যেক কাফিরের তওবা গ্রহণযোগ্য, যেমন মুশরিক, মূর্তিপূজক ও নাস্তিকরা তওবা করে ইসলামে দাখিল হয়। তাদের ইসলাম পূর্বেকার সকল কুফরি মিটিয়ে দেয়। আল্লাহ তওবাকারীর তওবা কবুল করেন ও তাকে ক্ষমা করেন। আল্লাহকে গালমন্দকারী তার অধিকারে ত্রুটি করে, আল্লাহ মুশরিক ও তাকে গালমন্দকারীর তওবা কবুল করেন, অতএব তার তওবাও কবুল করবেন এটাই স্বাভাবিক।
তবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করার বিষয় আলাদা, এটা তার অধিকার, তাই এ জন্য তাকে পাকড়াও করা হবে, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করেননি, তার মৃত্যু হয়ে গেছে।
মূলনীতি:
রাসূলের মহান অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে, সেটার জন্য পাকড়াও করতে হবে, রাসূলকে গালমন্দ করা কুফরি, তার হক উসুল করে গালিদাতাকে হত্যা করা ওয়াজিব।
দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দকারী মানুষের অন্তরে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে ও তাকে হেয় করে, পক্ষান্তরে আল্লাহকে গালমন্দকারী নিজের ক্ষতি করে।
মুদ্দাকথা: যে আল্লাহকে গালমন্দ করে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব, তার তওবা গ্রহণ করা হবে না, তার তওবা আল্লাহর নিকট সোপর্দ, সে তার নিয়তের সাথে আল্লাহর সাক্ষাত করবে, অতঃপর আল্লাহ তার সাথে ইনসাফ কিংবা ক্ষমার ব্যবহার করবেন।
আল্লাহকে গালমন্দকারী যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও পাকড়াও করার পূর্বে তওবা করে প্রকাশ করে দেয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য, কারণ তার তওবার সত্যতা প্রকাশ পেয়েছে। তার হুকুম স্বেচ্ছায় ইসলামে প্রবেশকারী কাফিরদের ন্যায়, তারা মুসলিম হয়ে ইসলাম-পূর্বে গালমন্দ করার কথা স্বীকার করত।
গালমন্দ দু’প্রকার:
১. প্রত্যক্ষ গালমন্দ: যেমন তাকে লানত করা, তার কুৎসা রটনা করা, তার সাথে উপহাস করা ও তাকে হেয় করা। এর হুকুম পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহকে গালমন্দ করা দ্বারা এ প্রকার উদ্দেশ্য।
২. পরোক্ষ গালমন্দ: যেমন আল্লাহ তা‘আলা যেসব নিদর্শন ও মখলুক পরিচালনা করেন, মানুষের ইচ্ছা ও অর্জনের ন্যায় যাদের কোন ইচ্ছা ও অর্জন নেই, যেমন যুগ, দিন, সময়, মুহূর্ত, মাস, বছর এবং তারকা ও তাদের সন্তরণকে গালমন্দ করা। এ প্রকার গালমন্দের হুকুম পূর্বের ন্যায় নয়, যেমন গালমন্দকারীর কুফরি ও তাকে হত্যা করা ওয়াজিব নয়, তবে যদি গালি দ্বারা উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় যে, সে এসবের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রণকারী, তথা আল্লাহকেই উদ্দেশ্য করেছে তাহলে সেটার বিধান প্রত্যক্ষ গালি দেওয়ার মতই হবে। (অর্থাৎ কুফরির কারণে পাকড়াও ও হত্যা করা হবে)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«قَالَ اللَّهُ تعالى: يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ، وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِي الْأَمْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ»
“আল্লাহ বলেন: ইব্ন আদম আমাকে কষ্ট দেয়, সে যুগকে গালি দেয়, অথচ আমিই যুগ, আমার হাতে কর্তৃত্ব, আমি রাত-দিনকে পরিবর্তন করি”। অপর বর্ণনা আছে:
«يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ، يَقُولُ: يَا خَيْبَةَ الدَّهْرِ، فَلَا يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ: يَا خَيْبَةَ الدَّهْرِ، فَإِنِّي أَنَا الدَّهْرُ، أُقَلِّبُ لَيْلَهُ وَنَهَارَهُ، فَإِذَا شِئْتُ قَبَضْتُهُمَا»
“ইব্ন আদম আমাকে কষ্ট দেয়, সে বলে: হে যুগের অনিষ্ট। অতএব তোমাদের কেউ যেন না বলে: হে যুগের অনিষ্ট, কারণ আমিই যুগ; আমি তার রাত ও দিন পরিবর্তন করি। আমি যখন ইচ্ছা করব ঘুটিয়ে নিব”।
নক্ষত্রসমূহ; যেমন, চাঁদ-সূর্য এবং তাদের নিদর্শনসমূহ; যেমন, রাত-দিন ও যুগসমূহ স্বাধীন নয়, এগুলো আল্লাহর পরিচালনাধীন, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে যেতে পারে না। তাদের কোনো ইচ্ছা, উপার্জন ও পছন্দ করার ক্ষমতা নেই। তাদেরকে পার্থিব বিষয় ব্যতীত কোনো নির্দেশ দেওয়া হয় না, আর এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
অতএব এগুলোকে গালমন্দ করা মূলত তাদের পরিচালক ও নির্দেশদাতাকে গালমন্দ করা এবং আল্লাহর হিকমত ও তার ইচ্ছায় আপত্তি করা। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা যুগকে গালমন্দ করাকে তাঁর নিজেকে গালি দেওয়া হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। কারণ, সেগুলোকে গাল-মন্দ করা আল্লাহকে গালমন্দ করা আবশ্যক করে তুলে।
মানুষকে গালমন্দ করা আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে গালমন্দ করা গণ্য করেন না, কারণ মানুষের ইচ্ছা ও স্বাধীনতা রয়েছে, যা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا تَشَآءُونَ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢٩ ﴾ [التكوير: ٢٩]
“আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন”।
পক্ষান্তরে নক্ষত্রসমূহ যেমন চাঁদ ও সূর্য, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে বলেছেন:
﴿لَا ٱلشَّمۡسُ يَنۢبَغِي لَهَآ أَن تُدۡرِكَ ٱلۡقَمَرَ وَلَا ٱلَّيۡلُ سَابِقُ ٱلنَّهَارِۚ وَكُلّٞ فِي فَلَكٖ يَسۡبَحُونَ ٤٠﴾ [يس: ٤٠]
“সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষপথে ভেসে বেড়ায়”।


আল্লাহ ও তার গুণগানকে সম্মান করা ওয়াজিব !
* আল্লাহর সম্মান যেমন: তার পরিকল্পনা, আদেশ ও নিষেধকে সম্মান করা ও বাস্তবায়ন করা, তার নির্দেশ অতিক্রম না করা, যার জ্ঞান মানুষের নেই, সে বিষয়ে তাদের ঘাটাঘাটি না করা।
* আল্লাহর সম্মান যেমন: তাকে স্মরণ করা, তার নিকট প্রার্থনা করা এবং দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকাণ্ড তার সাথে সংশ্লিষ্ট করা। তিনি এ জগতের স্রষ্টা ও পরিচালক, তার কোনো অংশীদার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٦]
“আর তারা আল্লাহকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় নি। অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তার মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তার ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। তিনি পবিত্র, তারা যাদেরকে শরীক করে তিনি তাদের ঊর্ধ্বে।
এখানেই আমরা সংক্ষিপ্ত এ পুস্তিকার সমাপ্তি করছি। একমাত্র তিনিই সাহায্যকারী ও সঠিক পথে পরিচালনাকারী, তার কোনো শরীক নেই, তার নিকট ইখলাস ও ব্যাপক প্রসারতা আশা করছি।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করুন, তার পরিবার ও তার সাথীদের উপর এবং যারা ইহসানের সাথে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করবে, সবার উপর।
লেখক
আবদুল আযীয ইবন মারযূক আত-ত্বারীফী
২১ মুহাররাম, ১৪৩৪ হি.
সমাপ্ত
সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ২:০৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×