somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি? - ১

১৩ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙালি, পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো;- ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; কুপমন্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধ'রে। বাঙালির এক অংশ প'ড়ে আছে এক বড়ো দেশের একপ্রান্তে, ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক অংশ ঠাসাঠাসি করে বেঁচে আছে আরেক ভূভাগে, যা এক টুকরো। বাঙালির দারিদ্র বিশশতকের এক কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। প্রতিটি বাঙালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড়ো ভাবার অচিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙালি। ইতিহাসে বাঙালির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে পরিচয় পাই বাঙালির তা আরো অগৌরবের। প্রতিটি জনগোষ্ঠির রয়েছে একটি বিশেষ চরিত্র, যা দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যায়; কিন্তু বাঙালির পাওয়া যায় না এমন কোন বৈশিষ্ট্য;- কোনো জাতি সরল, কোনো জাতি পরোপকারী, কোনো জনগোষ্ঠি উদার, বা মহৎ, বা আন্তরিক; বা কোনো জাতি স্বল্পভাষী, বা বিনয়ী, বা পরিশ্রমী, বা উচ্চাভিলাষী; কিন্তু বাঙালির নেই এমন কোনো গুণ, যার সংস্পর্শে এসে মুনষত্বের প্রসার ঘটতে পারে। বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিচার করা হয়েছে কি না, তা জানি না আমি; কিন্তু বোধ করি তা এখন জরুরি। বাঙালিকে এখন বিচার করা দরকার শারীরিক দিক থেকে- তার অবয়বসংস্থান কেমন, ওই সংস্থান মানুষকে কতোটা সুন্দর বা অসুন্দর করে, তা দেখা দরকার। বিচার করা প্রয়োজন বাঙালিকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে;- কেমন তার মানসগঠন, ওই মনে নিয়ত চলছে কিসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; দিনভর কতোটা ইর্ষায় ভুগছে, উত্তেজিত থাকছে কতোখানি, কতোটা গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে দিনরাত, বা কতোটা গৌরবে তার সময় কাটে। মানসিক এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু বাঙালির মানস উদ্ঘাটনের চেষ্টা হয়নি আজো। বাঙালির আচরণও বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও বিচারের বিষয়। বাঙালি সাধারণত কী আচরণ করে, তার সামাজিক আচরণ কেমন; বন্ধুকে কতোটা প্রীতির সাথে গ্রহণ করে, শত্রুকে দেখে কতোটা ঘৃণার চোখে; কতোটা কথা বলে বাঙালি, কথায় কতোটা বক্তব্য থাকে বা থাকে না, এবং আরো অনেক আচরণ সূক্ষভাবে বিচার করা দরকার। তার আর্থ, সামাজিক, রাজনীতিক জীবন ও আচরণ তো গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাই খুব বিস্তৃতভাবে রচনা করা দরকার বর্তমান বাঙালির জীবন ও স্বপ্নের ব্যাকরণ, যাতে আমরা বুঝতে পারি তার সমস্ত সূত্র। ওই সব সূত্র যদি কখনো রচিত হয়, তবে কি ধরা পড়বে যে বাঙালি একটি সুস্থ জনগোষ্ঠি, না কি ধরা পড়বে বাঙালি জাতি হিশেবে রুগ্ন; আর এ রুগ্নতা শুধু সাম্প্রতিক নয়, ঐতিহাসিকও। বাঙালির অহমিকা কি বাঙালিকে বাধা দেবে না নিজের নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে ও বিচারে? তা দেবে; কেননা বাঙালি সত্যের থেকে শূণ্য স্তাবকতা পছন্দ করে। আমি এখানে বাঙালির কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা বা বর্ণনা করতে চাই, বস্তুনিষ্ঠভাবে, যাতে বাঙালির ব্যাকরণ রচনার সূচনা ঘটে।



বাঙালির ভাষিক আচরণ দিয়েই শুরু করি। জাতি হিশেবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকন্ঠে, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয়টি বিতর্কিত হয়, পক্ষ-বিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচন্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে-কোন আলোচনায় বাঙালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙালির যুক্তি কন্ঠের উচ্চতা; যার কন্ঠ যত উঁচু সে নিজেকে ততোটা যুক্তিপরায়ণ ব'লে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত ব'লে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙালি কখনো পরাজিত হয়নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। বাঙালি কথায় সাধারণত ভুল শব্দ ব্যবহার করে, বাক্য সম্পুর্ন করে না; এক কথা বলে অন্য কথা বুঝিয়ে থাকে। বাঙালি উচ্চকন্ঠে আলাপ করে, অযুক্তি পেশ করে, এবং অনেকের মাঝখানে থেকেও ফিশফিশে স্বরে চমৎকার চক্রান্ত করতে পারে। বাঙালি কারো সাথে দেখা হ'লেই কথা বলে, কথার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও। বাঙালি প্রচুর মিথ্যা কথা বলে থাকে, অনেকে মিথ্যা কথা বলাকে মনে করে চাতুর্য, একধরণের উৎকর্ষ। বাঙালির প্রতিটি এলাকায় অন্তত একজন পেশাদার মিথ্যাবাদী পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে একটি উপজাতি রয়েছে, যারা চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর কথা বলাই থামিয়ে দেয়, তাদের বলার মতো আর কিছু থাকে না। বাঙালি এর বিপরীত- বয়স বাড়ার সাথে কথাও বাড়তে থাকে বাঙালির; বাঙালি বুড়োরা কথা বলার জন্য প্রসিদ্ধ। বাঙালির কথার পরিমাণ ও বক্তব্য সমানুপাতিক নয়; প্রচুর কথায় বাঙালি সামান্য বক্তব্য প্রকাশ করে। বাঙালির কথার প্রাচুর্য হয়ত বোঝায় যে জীবন তাকে ক্লান্ত করে নি; এবং সাথে সাথে এও বোঝায় যে জীবনে তার অপ্রাপ্তী অশেষ। বাঙালির অধিকাংশ কথা তার না পাওয়ার কথা, তার সমস্যার কথা, তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যর্থতার কথা। বাঙালি তার কথা দিয়ে জীবনে না-পাওয়ার শূণ্যতাগুলো পূরণ করে। এ-দিক দিয়ে বেশ ট্র্যাজিক জাতি বাঙালি; কিন্তু সে তার ট্র্যাজেডিকে লুকিয়ে রাখতে চায় অন্যের কাছে। বাঙালির কথায় ধরা পড়ে তার অন্তঃসারশূণ্যতাও।



বাঙালি গুছিয়ে কথা বলে না; এক কথা বারবার বলে; কথায় কথায় অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করে। সাধারণ মানুষের বাক্যের ভান্ডার বেশ সীমাবদ্ধ; কিন্তু তারা ওই সীমাবদ্ধ ভান্ডারকে বারবার ব্যবহার করে প্রায় অসীম ক'রে তোলে। বাঙালি মনে করে এক কথা বারবার বললে তা গ্রহণযোগ্য হয়, তাতে ফল ফলে। এটা হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু এতে কথার তাৎপর্য কমে, মূল্য বাড়ে পৌনপুনিকতার। সাধারণ মানুষকে যদি ছেড়ে দিই, ধরি যদি মঞ্চের মানুষদের, বিচিত্র কথা বলা যাদের পেশা, তারাও একই কথা বারবার বলে। বাঙালি নতুনত্ব চায় না, বিশাস করে পুনরাবৃত্তিতে। পুনরাবৃত্তিতে বাঙালির প্রতিভা কি তুলনাহীন? বাঙালির স্বভাবে রয়েছে অতিশয়োক্তি, সে কোনো আবেগ ও সত্য প্রকাশ করতে পারে না অতিশয়োক্তি ছাড়া। অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে, যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। 'দারুণ পছন্দ করি', 'ভীষণ ভালোবাসি', 'শ্রেষ্ঠতম কবির' মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ। অতিশয়োক্তি লঘুতার লক্ষণ, এতে প্রকাশ পায় পরিমাপবোধের অভাব। বাঙালি লঘু, পরিমাপবোধহীন। বাঙালি সাধারণত কারো আন্তর গুরুত্ব নিজে উপলব্ধি করতে পারে না; অন্য কারো কাছ থেকে তার জানতে হয় এটা; এবং একবার অন্যের কাছ থেকে জেনে গেলে, বিচার না ক'রে, সে তাতে বিশ্বাস করে। বাঙালি ভাষাকে এক ধরণের অস্ত্ররূপেও ব্যবহার করে। কলহে বাঙালির প্রধান অস্ত্র ভাষা- আগ্নেয়াস্ত্রের মতো বাঙালি ভাষা প্রয়োগ ক'রে থাকে।



বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয় বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে 'কী চাই?' অপেক্ষা করার জন্য বলে 'দাঁড়ান'। কোন কর্মক্ষত্রে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। যিনি কোনো আসনে ব'সে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চিত। আসীন কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কেনো, তিনি আগন্তুকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলের কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক'রে নিজেকে সম্মানিত করে। পশ্চিমে এটা কখনো হয় না। পশ্চিমে সাক্ষাৎপ্রার্থী সাদরে গৃহীত হয়, সম্মানিত হয়; কিন্তু বাঙলায় প্রতিটি সাক্ষাৎপ্রার্থী হয় অপমানিত। বাঙলায় সম্মানলাভের বড়ো উপায় হচ্ছে ক্ষমতা। কোথাও গিয়ে তাই প্রথমেই নিজের পদের পরিচয় দিতে হয়, ঐ পদটি যদি আসীন ব্যক্তিকে সন্ত্রস্ত করে, তাহলে সাক্ষাৎপ্রার্থী যথেষ্ট সমাদর লাভ করেন। তাই বাঙালি সামাজিকভাবে ভদ্র ও সৌজন্যপরায়ণ নয়; তার সৌজন্য ভীতি বা স্বার্থচেতনাপ্রসূত। বাঙালি যখন পথেঘাটে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখনও ঠিক সৌজন্য বিনিময় ঘটে না। ধর্মীয় সম্বোধন অনেকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক'রে থাকে, তবে তা যতোটা যান্ত্রিক, ততোটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়। পশ্চিমে রাস্তায় বেরিয়েই পরিচিতজনের, সামান্য পরিচিতের, হাসিমুখ দেখা স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এখানে হাসিমুখ দুর্লভ; রেশারেশি বাঙলায় আলোবাতাসের মতো সত্য। প্রতিটি এলাকা পারস্পরিক রেশারেশিতে গোপন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ঙ্কর এখানে। তাই সামাজিক ভদ্রতা দুষ্প্রাপ্য। বাঙালি সমাজ প্রতি মুহূর্তে ক্ষমতানিয়ন্ত্রিত; প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি ক্ষমতারূপে বিরাজ করে, চলাফেরা করে। ক্ষমতা কোনো ভদ্রতা জানে না। ক্ষমতার দুটি দিকে রয়েছে;- একটি দম্ভ, তা শক্তিমানকে দাম্ভিক করে; আরেকটি অসহায়ত্ব, তা অধীন ব্যক্তিকে স্তাবকে পরিণত করে। তাই বাঙালি দাম্ভিক বা স্তাবক, ভদ্র নয়।



বাঙালির চরিত্রের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ভন্ডামো। বাঙালি প্রকাশ্যে একটি মুখোশ পরতে ভালোবাসে, মুখোশটি নানা রঙে রঙিন ক'রে রাখে; কিন্তু তার ভেতরের মুখটি কালো, কুৎসিত। বাইরে বাঙালি সব আদর্শের সমষ্টি, ভেতরে আদর্শহীন। বাঙালি সততার কথা নিরন্তর বলে, কিন্তু জীবনযাপন করে অসততায়। বাঙলায় এমন কোনো পিতা পাওয়া যাবে না, যিনি পুত্রকে সৎ হ'তে বলেন না; আর এমন পিতাও খুব কম পাওয়া যাবে, যিনি পুত্রের অসৎ উপার্জনে গৌরব বোধ করেন না। 'চরিত্র' সম্পর্কে বাঙালির ধারণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 'চরিত্রহীন' বলতে বাঙালি বোঝে পরনারীতে আসক্ত পুরুষ; তার চোখে আর কেউ চরিত্রহীন নয়, শুধু পরনারীআসক্তই চরিত্রহীন বা দুশ্চরিত্র। ঘুষ খাওয়া চরিত্রহীনতা নয়, গৌরব; কপটতা চরিত্রহীনতা নয়, মিথ্যাচার চরিত্রহীনতা নয়, এমনকি খুন করাও চরিত্রহীনের লক্ষণ নয়, শুধু নারীআসক্তিই চরিত্রহীনতা। তবে বাঙালি মাত্রই পরনারীআসক্ত; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। বাঙালি ধর্মের কথা সোরগোল ক'রে ব'লে ধর্মবিরোধী কাজ করে অবলীলায়, প্রগতির কথা ব'লে প্রগতিবিরোধী কাজ করে প্রতিদিন; বাঙালি প্রকাশ্যে মহত্ত্ব দেখিয়ে বাস্তবে কাজের সময় পরিচয় দেয় ক্ষুদ্রতার। বাঙালি যা বিশ্বাস করে মুখে তা প্রকাশ করে না; বাঙালি যা প্রকাশ করে আচরণে তা পালন করে না; বাঙালি পেছনে যার নিন্দা করে, মুখোমুখি তার তোষামোদ করে- যদি সে শক্তিমান হয়। শক্তি বাঙালির জীবনের বড়ো নিয়ন্ত্রক;- বাঙালি শক্তিমানের পদানত হয় নির্দ্বিধায়, আর দুর্বলকে পীড়ন করে অবলীলায়। বাঙালি শক্তিমানের কোনো ত্রুটি দেখে না, শক্তিমানের সমস্ত অন্যায়কে মেনে নেয়, বাঙালির চোখে শক্তিমান কখনো চরিত্রহীন নয়, শক্তিমানের কোন চরিত্র থাকার দরকার আছে বলেও মনে করে না বাঙালি; কিন্তু চরিত্রবান হওয়া দুর্বলের জন্য বিধিবদ্ধ। বাঙালি খুবই পরনিন্দা করে, পিতার নিন্দা করতেও কুন্ঠিত হয় না; তবে বাঙালির চোখে সামাজিকভাবে কেউ নিন্দিত নয়, যদি সে শক্তিমান হয়। নিন্দিত শক্তিমানের কন্ঠে মালা পরাতে বাঙালি লজ্জিত হয় না, গর্ব বোধ করে; নিন্দিত শক্তিমানকে নিমন্ত্রণ করে ধন্য বোধ করে বাঙালি। বাঙালি, অশেষ ভন্ডামোর সমষ্টি, শক্তিকেই মনে করে বিধাতা।



বাঙালির শরীরটির দিকেই তাকানো যাক একবার। বাঙালি কি সুন্দর, বাঙালি কি নিজেকে মনে করে রূপমন্ডিত? বাঙালির অহমিকা আছে, তাই নিজেকে রূপের আঁধার মনে করে নিশ্চয়ই; কিন্তু বাঙালির চোখে সৌন্দর্যের দেবতা অন্যরা। একটু ফরশা হ'লে বাঙালি তাকে বলে 'সাহেবের মতো সুন্দর'; একটু বড়োসড়ো হলে বাঙালি তার তুলনা করে, বা কিছুদিন আগেও তুলনা করত, পাঠানের সাথে। বাঙালি সাধারণত খর্বকায়, তবে সবাই খর্ব নয়; বাঙালির রঙ ময়লা, তবে সবাই ময়লা নয়, কেউ কেউ ফরশা। শাদা রঙটিকে পূজো করে বাঙালি, সম্ভবত সমস্ত ভারতবর্ষীয়ই। এদিক দিয়ে বাঙালিকে বর্ণান্ধ বা বর্ণবাদীও বলা যায়। রঙের জন্য এত মোহ আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। যে-মেয়ে শুধুই শাদা, আর কিছু নয়, যার মুখের দিকে তাকানো যায় না, যার শরীর বেঢপ, তাকেও বাঙালি সুন্দর বলে, কারণ সে শাদা। বাঙালি কালো, কিন্তু তার সৌন্দর্যের দেবী শাদা। বাঙালির শরীর সুন্দর নয়। কেউ হয়তো খর্ব, মধ্যভাগে মাংশ প্রচুর; নারীদের সৌন্দর্য কম, যদিও কেউ কেউ রূপসী। বাঙালি নারী বক্র হয়ে যায় পিঠ বাঁকিয়ে চলতে চলতে, আর ঠিক মতো সোজা হ'তে পারে না, সব সময় ঢাকা থাকে জড়তায়। বাঙালি পুরুষের কাঠামোতে পৌরুষের অভাব; নারীদের অভাব আবেদনের। বাঙালি অবশ্য নিজের সম্পর্কে সবকিছু বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে ব'লে সৌন্দর্যের কথাও বাড়িয়ে ব'লে থাকে; কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সাথে তুলনা করলে তার সৌন্দর্য স্থান পাবে তালিকার নিচের দিকেই। তাই বাঙালি তাকেই সুন্দর বলে যে দেখতে বাঙালির মতো নয়। তাহলে কি বাঙালির সৌন্দর্যচেতনা চিরকালই থেকে যায় অপরিতৃপ্ত? বাঙালির জীবন ভ'রে অপরিতৃপ্ত ও অসন্তোষ; অর্থ তাকে সচ্ছলতা দেয় না, সমাজ তাকে শান্তি দেয় না, রাজনীতি তাকে মানুষ হিশেবে গণ্য করে না, আর তার সৌন্দর্যপিপাসাও তাকে করে রাখে অপরিতৃপ্ত?



বাঙালি দরিদ্র কিন্তু অপচয়প্রবণ; আর বাঙালি সময়ের মূল্যবোধহীন। দারিদ্রের একটা বৈশিষ্ট্য সম্ভবত অপচয়, বা অপচয়ে তারা গৌরব বোধ করে। গরিব বাঙালির বাড়িতে গেলেও নানা অপচয় চোখে পড়ে। ভাতের অভাব বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক সত্য ও নিয়তি; কিন্তু প্রতি বাড়িতেই প্রতিদিন কিছু পরিমাণ হ’লেও ভাতের অপচয় ঘটে। কেউ হয়তো খাওয়ার সময় কিছু ভাত ফেলে দেয়, কেউ না-খেয়েই উঠে যায়; কিন্তু ধনী দেশগুলোতে এক টুকরো রুটিও অপচয় হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালির অপচয়ের কোনো শেষ নেই, এটা ব্যাক্তির অপচয়েরই রাষ্ট্রীয় পরিণতি। বাঙালির রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন অপচয় করে চলে, কিন্তু জাপানে একটি ইয়েনেরও অপচয় ঘটে না। অপব্যয় বাঙালির স্বভাব ও সামাজিক দাবি। বৃটেনে কারো আয়ের একটি ছোটো মুদ্রাও অপব্যয়িত হয় না; তারা নিজেরা অপব্যয় করে না, রাষ্ট্র অপব্যয় করতে দেয় না, সমাজ অপব্যয় করতে দেয় না। সিগারেটকেই উদাহরণ হিশেবে নিই। আমি সিগারেট খাই, হিশেব মতো খেতে চাই, কিন্তু হয়ে ওঠে না। পাশের কাউকে-না-কাউকে প্রতিদিনই দু-চারটি দিতে হয়, যদিও তাদের অনেকেই ধূমপায়ী নন, কিন্তু অন্যকে সিগারেট খেতে দেখলে ধূমপানের শখ জেগে ওঠে তাঁদের। প্রতিদিনই কয়েকটি সিগারেট অপচয় হয় আমার, যেমন হয় অধিকাংশ বাঙালির। আয় খুব সামান্য, কিন্তু অপচয় অনেক;- কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে। দর্জির কাছে কখনো একবার গিয়ে জামা তৈরি পাওয়া যায় না, দু-তিনবার যেতে হয়, অপচয় ঘটে সময়ের ও অর্থের; যে কাজে একবারের বেশি যাওয়ার কথা নয়, সেখানে যেতে হয় বারবার। এমন অপচয় পশ্চিমে ঘটে না। তারা অনেক আয় করেন, কিন্তু তাঁদের একটি সিগারেটেরও অপচয় ঘটে না। বাঙালি আয় করে কম, কিন্তু তার একটা বড় অংশ অপচয় হয়ে যায়। অপচয় হয় বাঙালির জীবন। বাঙালির সময় বোধ নেই বললেই চলে; বাঙালি পাঁচটা বললে ছটা-সাতটাও বোঝাতে পারে। সময় মতো যে চলে বাঙালি সমাজে সে-বেমানান, তাকে বার বার পড়তে হয় অসুবিধায়। বাঙালি সভা বা বৈঠক করতে খুবই উৎসাহী; প্রতিটি অফিস বৈঠকপরায়ণ, তারা প্রতিদিন নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে ব্যগ্র; কিন্তু ঠিক সময়ে কোনো সদস্য আসে না বৈঠকে। যারা আগে আসে তাদের মূল্য কম, বাঙালি মনে করে সময়বোধহীন বিলম্বীরাই মূল্যবান। যে-ঠিক সময়ে এসেছে বাঙালি তাকে খেয়াল করে না; কিন্তু যে আসে নি, আসবে কি না সন্দেহ, বাঙালি তার কথা বারবার বলে, তার জন্যে বড়ো আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।



প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা বা কথা না রাখায় বাঙালি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। কারো সাথে আর্থিক সম্পর্কে জড়িত হ’লে প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একশো ভাগ, না হ’লেই বিস্ময় জাগে। বাঙালি প্রচুর দলিলপত্র ক’রে ব্যবসায়ে নামে অন্যের সাথে, তারা সবাই সুযুগ খুঁজতে থাকে পরস্পরকে ঠকানোর, এবং ঠকাতে পারলে গৌরব বোধ করে, ও না ঠকলে অবাক হয়। ঋণ শোধ না করা বাঙালির স্বভাব। কেউ একবার ঋণ নিলে তা যে ফেরত পাওয়া যাবে, এমন আশা করা বাঙালি সমাজে অন্যায়; আর ফেরত পাওয়া গেলেও তা কখনো ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। বাঙালি কারো প্রাপ্য অর্থ শোধ করতেও কয়েকবার ঘোরায়। প্রথমে একটি তারিখ দেয়, প্রাপক গিয়ে দেখে অন্যজন অনুপস্থিত। তখন তার খোঁজ করতে হয়, পাওয়া গেলে প্রাপ্য টাকা পাওয়া যায় না, টাকা শোধের আরেকটি তারিখ পাওয়া যায়। অনেকবার ঘোরানোর পর বাঙালি টাকার কিছুটা শোধ করে, বাকিটার জন্যে আরেকটি তারিখ দেয়। এটাই হচ্ছে বাঙালির ঋণনীতি। ব্যবসাবাণিজ্যে যারা জড়িত, তারা প্রত্যেকেই প্রতারক; কাউকে-না-কাউকে প্রতারণ করে তারা টাকা করে। এখন অবশ্য রাষ্ট্রকে প্রতারণ করার পথই তারা আবিষ্কার করেছে। বাঙালি বন্ধুকে, পরিচিত জনকে, এমনকি অপরিচিতকেও নানা রকম কথা দেয়; কিন্তু কথা রাখে না। কথা না-রাখার অজুহাত বের করতে দক্ষ বাঙালি; এতো দক্ষ যে বাঙালির কথা শুনে যে বিশ্বাস করবে না তাকে চরম অবিশ্বাসী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।



বাঙালি খুবই স্বৈরাচারী; দেখতে এতোটুকু, কিন্তু সবাই ছোটোখাটো চেঙ্গিশ খাঁ। প্রতিটি পরিবারকে যদি একটি ছোটো রাষ্ট্র হিশেবে দেখি, তাহলে ঐ রাষ্ট্রের একনায়ক পিতাটি। পল্লীসমাজে পিতার একনায়কত্ব খুবই প্রবল ও প্রচন্ড; শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে কিছুটা কম। পিতার শাসনে স্বৈরাচারে পরিবারটি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ; মা-টি হয় সবচেয়ে পীড়িত ও পর্যুদস্ত, সন্তানেরাও তাই। পিতার স্বৈরাচারের পরিচয় পরিবারের সদস্যদের সম্বোধনরীতিতেও ধরা পড়ে। আগে, সম্ভবত এখনো, সন্তানেরা পিতাকে সম্বোধন করতো ‘আপনি’ বলে, কিন্তু মাকে সম্বোধন করতো বা করে ‘তুমি’ বলে। পিতা যে প্রতাপশালী ও অপ্রতিহত, এটা বোঝে ছোটো শিশুটিও; মা যে শক্তিহীন তাও বোঝে। মা তাদের মতোই পীড়িত। বাঙালির পারিবারিক একনায়কত্বই বিস্তৃত হয় সমাজে, রাষ্ট্রে। বাঙালি সমাজে প্রধানেরা একনায়ক, তারা অন্যের মত গ্রাহ্য করে না, নিজের মত চাপিয়ে দেয় সকলের ওপর। রাষ্ট্রনায়কেরা তো প্রসিদ্ধ একনায়ক, যদিও বিশ্বের প্রধান একনায়কদের কাছে তারা ইঁদুরছানার মতো। বাঙালি একনায়কত্ব করে, ও ওপরের একনায়কের বশ্যতা মেনে নেয়। নিচের সবাই তাদের কাছে ‘ভৃত্য’, ওপরের সবাই ‘প্রভু’। একনায়কত্ব বাঙালিসমাজে বিকাশ ঘটিয়েছে স্তাবকতার। স্তাবকতায় বাঙালি কি অদ্বিতীয়? প্রভুকে তারা হাজার বিশেষণে শোভিত করে, এতো বিশেষণ তাকে উপহার দেয় যে বিধাতাকেও অতো বিশেষণে সাজানো হয় না। স্তাবকতায় যে-কোনো অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করতে পারে বাঙালি, এবং মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন অতিশয়োক্তি খুঁজে ফেরে। তবে বাঙালি কখনো প্রভুভক্ত নয়। বাঙালি জানে প্রভু শাশ্বত, কিন্তু কোনো বিশেষ প্রভু নশ্বর। এক প্রভু নিঃশেষ হয়ে গেলে বাঙালি আরেক প্রভু ধরে, আগের প্রভুর নিন্দায় মুখর হয়, জয়গানে মুখর হয় নতুন প্রভুর।

- হুমায়ুন আজাদ
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×