somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শায়েস্তা খাঁর আমল বনাম নতুন ইতিহাসে ‘অর্থলিপ্সু ও শোষক’ শায়েস্তা খাঁ

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আসন্ন ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ানোর জন্য “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” নামে একটি পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত করেছে। সামাজিক বিজ্ঞানের পরিবর্তে বইটি পড়ানো হবে। সেখানে “প্রজাদের শোষণ-বঞ্চনা” শিরোনামে লেখা রয়েছে। যাতে লেখা হয়েছে- তখন সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বলে আসলে কিছুই ছিল না। তাই চালসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিস বা গরু- ছাগলের দাম অবিশ্বাস্য রকম কম হলেও তা প্রজাদের কোনো উপকারে আসে নি। শায়েস্তা খানের নিজের অর্থলিপ্সা এত প্রচণ্ড ছিল যে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী ১৬৭৬ সালে লিখেছেন, শায়েস্তা খানের কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে এমন শোষণ করত যে, এমনকি পশুখাদ্যেও (মূলত ঘাস) ব্যবসাও তাদের একচেটিয়া ছিল। আর এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ১৩ বছর বাংলার সুবেদার থেকে শায়েস্তা খান যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তা তখনকার বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন অন্তত ৩৮ কোটি টাকার মালিক এবং তার দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা”। এছাড়া বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘স্বদেশচেতনা’র জাগরণকারী আন্দোলন হিসেবে।

শায়েস্তা খাঁর আমল নিয়ে কিছুটা পড়া ছিল এফ. বি. ব্রাডলী বার্ট রচিত ‘রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, অনুবাদ- রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী) নামের বইটির কল্যানে। ৮ম শ্রেণীর বইয়ে লেখা ইতিহাস পড়ে অবাক হলাম। আমরা যে ইতিহাস জেনে এসেছি এতোদিন এবং ব্রাডলীর বইয়ে যেভাবে শায়েস্তা খাঁ সম্পর্কে জেনেছি তার সাথে কোনভাবেই মেলাতে পারলাম না।

ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত এফ. বি. ব্রাডলী বার্ট (F B Bradley Birt) রচিত 'প্রাচ্যের রহস্যনগরী' (Romance of an Eastern Capital) [বাংলায় অনুবাদ করেছেন রহীম উদ্দীন সিদ্দিকী] বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়টি শায়েস্তা খাঁ’কে নিয়ে লেখা রয়েছে। অধ্যায়ের শুরুতেই ব্রাডলী বার্ট লেখেছেন- ঢাকার সাথে শায়েস্তা খাঁর নাম যে-রূপ ঘনিষ্টভাবে জড়িত হয়ে আছে, অন্য কোন শাসনকর্তা, এমন কি, এই নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খাঁর নামও সেরূপ নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে আসে নাই। যে-সময়ে মোগল সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের প্রদেশটি শাহজাদাদের মল্লভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পূর্ব বাংলা যে-সময়ে তাঁদের উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ পরিগণিত হয়েছিল এবং যে সময়ে চারদিকে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সময়েই পূর্বাঞ্চলের এই শ্রেষ্ঠ সুবেদার দীর্ঘকাল ধরে নিরুপদ্রুবভাবে এই অঞ্চল শাসন করে গেছেন। (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ৮১)

অন্য এক জায়গায় ব্রাডলী লেখেছেন, মগ ও পর্তুগীজদের পৌনঃপুনিক হানা ও অমানুষিক অত্যাচারে পূর্ব বাংলার দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। ইহাদের অরাজকতার অবসান হওয়ায় প্রদেশে শান্তি ফিরে আসে। এই শান্তি বহু ক্লিষ্ট ও নির্জিত পূর্ব বাংলা এবং এর অধিবাসীদের কাছে এক চরম আশীর্বাদরূপে কাজ করেছিল। এই সময় ঢাকা সমৃদ্ধির উচ্চতম শিখরে আরোহন করে। এখান থেকে যে-সব পণ্য বিদেশে রফতানি হত, সেগুলোর সংখ্যা ও রকমারীই এর সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই ঢাকা তার উৎপাদিত পণ্য রফতানি করত। (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ৮৮)

ইংরেজদের অনধিকার প্রবেশকারী মনে করতেন শায়েস্তা খাঁ। ব্রাডলী লেখেছেন- ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসে ‘স্বেচ্ছাসারী’ ও ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ নওয়াব’ চিত্রিত হলেও প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণা ও ন্যায়ানুগতার জন্যে বাংলার শাসন কর্তাদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইংরেজদের অনধিকার প্রবেশকারীর দল বলে মনে করতেন। (প্রাচ্যের রহস্যনগরী, পৃ. ১০৫)

শায়েস্তা খাঁর বিদায় পর্ব ছিল গৌরবব্যঞ্জক। বিপুল জনতা মিছিলের মাধ্যমে তাকে বিদায় জানিয়েছিল। একটি শতাব্দীর প্রায় এক-চতুথাংশকাল শাসন করে তিনি গৌরবের সাথে বিদায় নিয়েছিলেন। অথচ শিক্ষার্থীদের জন্য লেখা নতুন ইতিহাসে শায়েস্তা খানকে দেখানো হয়েছে অর্থলিপ্সু ও শোষক সুবেদার হিসেবে, যেমন করে ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসে তিনি ‘স্বেচ্ছাসারী’ ও ‘বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ নওয়াব’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। নতুন ইতিহাস অনুযায়ী, দ্রব্যমূল্যের দাম কম হলেও মানুষ তার সুফল পায়নি, মানুষকে অত্যাচার করা হয়েছে। অথচ ব্রাডলী বার্টের লেখা ইতিহাস অনুযায়ী শায়েস্তা খাঁর শাসনামলে বাংলার মানুষ শান্তিতে ছিল।



প্রশ্ন হলো নতুন ইতিহাসের বইয়ে কেন শায়েস্তা খাঁকে নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে? কেনইবা ইংরেজ শাসনের নেতিবাচক দিক নিয়ে কথাবার্তা নেই? ‘শায়েস্তা খানের আমল’ বলে কিছু ছিল না, এমনটা প্রমাণ করতে পারলে কী কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো কি দিবেন নব্য ইতিহাস রচয়িতারা? প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, ২০০৮ সালের দিকে একজন অর্থ উপদেষ্টা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে না পেরে বলেছিলেন, ‘এটি শায়েস্তা খাঁর আমল নয়’।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ২:১২
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×