‘জিনের আছর’ ছাড়ানোর নামে সিলেটে কথিত ‘পীরানি’র (নারী পীর) উদ্ভট চিকিৎসা-পদ্ধতি কেড়ে নিল এ মেধাবী ছাত্রীর প্রাণ।
পীরের পানি পড়া খেয়ে আর নাকে-মুখে তেল মাখার পর রক্তবমি করতে করতে গতকাল শুক্রবার সকালে সিলেট শহরের আম্বরখানায় নিজ বাসায় মারা যান সৈয়দা মারওয়া রিফাত (১৮)। একই চিকিৎসা নিয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন রিফাতের মা, মামা ও খালা।
এদিকে মৃত্যুর ঘটনা শুনেই আস্তানা ছেড়ে পালিয়েছেন কথিত ‘পীরানি’। পুলিশ শহরের রায়নগরে পীরানির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁর ‘খানকা’ জব্দ, সেখান থেকে তাঁর বড় বোন, এক ছেলেসহ নয়জনকে এবং নিহত রিফাতের বাসার গৃহকর্মীকেও আটক করেছে পুলিশ।
রিফাত এবার সিলেটের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কলার্সহোম থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে পারিবারিক সূত্র জানায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, রিফাতের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন সিলেট কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অঞ্জন রায়। তাতে বলা হয়, মরদেহে কোনো ক্ষত চিহ্ন নেই। রক্ত বমি করায় গলায়, শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তের দাগ ও তেল মাখা ছিল। হাতে ও গলায় ছিল তাবিজ। তাবিজগুলো খুলে দেখা গেছে, তাতে নখ ও চুল রয়েছে।
এ ছাড়া ওই বাসা থেকে পানি ও তেল পড়ার বোতল মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাতে মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়।
আম্বরখানার ইলেকট্রিসাপ্লাই এলাকার হাজি ভিলায় বাস করত রিফাতের পরিবার। তাঁর বাবা মুহিদুল ইসলাম দুবাইপ্রবাসী ছিলেন। প্রায় সাত বছর আগে হূদরোগে মারা যান তিনি। দুই ভাই এক বোনের পরিবারে রিফাত ছিলেন বড়। একই বাসায় রিফাতের দুই মামা ও এক খালা বাস করতেন।
ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ৩০ নভেম্বর রিফাত হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। বাসার গৃহকর্মী রোকেয়া বেগমের (৩০) পরামর্শে তাঁকে নগরের রায়নগর এলাকায় ‘জামতলার পীরানি’ নামে পরিচিত তহুরা বেগমের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তহুরা বেগম জানান, রিফাতের জিনের আছর হয়েছে। তিনি ঝাড়-ফুঁকের চিকিৎসার জন্য এককালীন ৭৭ হাজার টাকা ‘সেলামি’ দাবি করেন। মেয়েকে শিগগির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে যাবেন, তাই দ্রুত সুস্থ হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে পীরানির কথায় রাজি হয় পরিবারটি। পুরো টাকা পরিশোধ করার পর গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয় পীরানির চিকিৎসা। রাতব্যাপী একটানা পানি পড়া পান ও তেল মাখাসহ উদ্ভট ‘চিকিৎসা’ চলে। গতকাল ভোর সাতটায় রিফাত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে সকাল সাড়ে আটটায় মৃত্যু হয়।
রিফাতের মৃত্যুর পর তাঁর মা সিদ্দিকা আক্তার চৌধুরী (৪০) ও তাঁর মামা ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী (৩০) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা বাসায় এলোমেলো আচরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে পুলিশ গিয়ে দুজনকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। এরপর গৃহকর্মী রোকেয়াকে নিয়ে পুলিশ পীরানির বাড়িতে অভিযান চালায়।
রিফাতের ছোট খালা ফারহানা আক্তার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু কেমন যেন ধাঁধার মধ্য দিয়ে ঘটে গেছে। পীরানি তহুরা গত বৃহস্পতিবার সারা দিনই বাসায় অবস্থান করছিল। একের পর এক ঝাড়ফুঁক আর নানা রকম ফন্দি-ফিকির করায় পুরো বাসা অন্য রকম হয়ে উঠেছিল। সন্ধ্যার পর পীরানি একটি গরু ও এক ভরি স্বর্ণ নিয়ে চলে যায়।’ তিনি বলেন, পীরানি যাওয়ার আগে রিফাতের মা ও মামাকে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলে যান। পরে তাঁর কথামতো চারটি বোতলে পানি পড়া তেল মাখানো হয় রিফাতসহ তাঁর মা ও মামাকে। তিনজনই মধ্যরাত থেকে অসুস্থ বোধ করেন। ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে রিফাতের অবস্থা বেশি নাজুক হয়ে পড়লে ভোর সাড়ে ছয়টায় অজ্ঞান হয়ে যান।
নগরের রায়নগরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি আলিশান ভবনে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকেন পীরানি তহুরা বেগম। পুলিশ যাওয়ার আগেই তহুরা বেগম পালিয়ে যান। ওই বাসা থেকে তহুরার বড় বোন চান বানু (৬০), বড় ছেলে ইসলাম উদ্দিন (২৪), ছেলের বউ শিপা বেগম, কায়সার আহমদ (১৬), আবদুল্লাহ (৮), তানিয়া (১০), আবদুর রহিম (৭), কাজল আক্তার (৯) এবং রিফাতদের গৃহকর্মী রোকেয়াকে আটক করে পুলিশ।
সিলেট কোতোয়ালি থানা হাজতে আটক পীরানির বড় বোন চান বানু জানান, তাঁদের বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার আলিয়াপাড়া গ্রামে। প্রায় তিন বছর ধরে তাঁরা সিলেটে আছেন। তাঁর ছোট বোন তহুরা বেগম ঝাড়-ফুঁকের চিকিৎসা করছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। সিলেট নগরের জামতলা এলাকায় থাকতেন বলে তহুরা ‘জামতলার পীরানি’ নামে পরিচিতি পান।
রায়নগরে তহুরার ভাড়া বাড়িতে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জানান, পাঁচ মাস আগে মাসে সাত হাজার টাকা ভাড়ায় তহুরা এ ফ্ল্যাটে ওঠেন। প্রতিদিনই ৫০ থেকে ৭০ জন মানুষকে তিনি পানি পড়া ও তেল পড়া দিতেন।
চারতলার পীরানির ফ্ল্যাটটি পুলিশ তালাবদ্ধ করে রেখেছে। ভেতরে চারটি কক্ষের মধ্যে তিনটি পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। একটি কক্ষ অনেকটা মাজার আকৃতি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে একটি পাথর, পিতলের কলসি ও ওপরে লালসালু রয়েছে। ওই কক্ষে পীরানি ঝাড়-ফুঁকের চিকিৎসা দিতেন।
রাতে যোগাযোগ করলে সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার নওরোজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে। ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ বের করার চেষ্টা চলছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



