somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি গ্রাম,একটি পতাকা, একজন মুক্তিযোদ্ধা।

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দোয়েল,গাছের পাতা, স্বর্ণচাঁপা,টলটলে দিঘি
বলে, "রণক্লান্ত বীরগণ! তোমরা ঘুমিয়ে আছো
ধুলোর শয্যায় স্তব্ধতায়,অথচ হায়েনা নেকড়ের পাল
দিকে দিকে দাঁত নখ বের করে স্বাধীনতাকেই
কি হিংস্র খুবলে খাচ্ছে। তোমরা কি জাগবে না? জাগবে না আর?
হাতে তুলে নেবে নাকি পশু-তাড়ানিয়া হাতিয়ার পুনরায়?
অন্তত ঝিমিয়ে-পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের শিরায় শিরায় আজ
দাও দোলা নব জাগৃতির; প্রকৃত জয়ের হোক উদ্বোধন।
"
- শামসুর রাহমান

পতাকা তুলি। পতাকা নামাই। জীবন কাটছে এভাবেই।
সন্তানেরা বলে,"বাবা তুমি এখনো কেন এসব কর? কাজ করতে পার না? কি পেয়েছ এসব করে?
প্রশ্নগুলো শুনে মাঝে মাঝে থমকে যাই।
প্রশ্নগুলোর উত্তর কী আছে আমার কাছে?
উত্তর কি আছে কারো কাছে?
কখনো মনে হয় আছে। কখনো সন্দেহ জাগে। সাময়িক দ্বিধা কাটিয়ে ছেলে মেয়েদের বলি,
"মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তার সন্তান। আমি সেই তোদেরকে রেখে চলে গিয়েছিলাম। কেন গিয়েছিলাম? কিসের জন্য গিয়েছিলাম? এই একটা পতাকার জন্যই তো!
জীবনে হাজারো অপ্রাপ্তি আছে। বঞ্চনা আছে।আছে দুঃখ,দারিদ্র্য আর হতাশা। কিন্তু তারপরও এই পতাকার কাছে এলে বুকটা এত্তো বড় হয়ে যায়। এছাড়া তো আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা বাবা!"
আমার জীবনে তো আর কিছু নেই। এই পতাকা ছাড়া, এই দেশ ছাড়া। এটা ছেড়ে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকব......।"


আবদুস সাত্তার সিকদার। কারো কাছে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার, আবার কারো কাছে তিনি কমান্ডার সাত্তার নামে পরিচিত। যখন তিনি কথাগুলো বলছিলেন তখন দুটো জ্বলজ্বলে চোখে টলমল অশ্রু। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু ধরে রাখা সত্যিই কষ্টকর।
.....................
খুলনার গল্লামারি নামক স্থানের স্মৃতিসৌধ। লাল ইটের তৈরি। পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। যে পতাকার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছকরে সন্তানের মায়া ত্যগ করে যুদ্ধ করেছেন সে পতাকাই এখন তার জীবন। পতাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না, করেন না।
প্রতিদিন নিয়ম করে স্মৃতিসৌধে পতাকা উত্তোলন করা আর নামানোই তার এখন একমাত্র কাজ। এই পতাকার মাঝেই তিনি খুঁজছেন জীবনের মানে।

খুলনা শহর থেকে গল্লামারির দূরত্ব প্রায় দু কিলোমিটার। গল্লামারি ব্রিজ পার হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলে হাতের বাম দিকে গল্লামারি খাল। খালের পারেই স্মৃতিসৌধ এলাকা। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এলাকা চিহ্নিত করা।
.....................
গল্লামারির আছে ভয়াবহ গণহত্যার ইতিহাস। ইতিহাসের উপাদান হবার জন্য দরকার ছিল একটি গবেষণার,যা কেউ করেনি। কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ সাত্তার সিকদাররা আজো সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। তাদের বয়স হয়েছে। তারাও হয়তো আর বেশি দিন থাকবেন না। তখন কে করবে স্মৃতিচারণ?
... এজাতির ট্র্যাজেডি- এই অমূল্য ইতিহাস সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা নেই। সরকারি তো নেইই, ব্যক্তি উদ্যোগও নেই।
গল্লামারির আকাশ জুড়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। সাত্তার সিকদার ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন পতাকা স্ট্যান্ডের কাছে। অশ্রু টলমল চোখে মাথা উঁচু করে স্যালুট করলেন। তারপর আস্তে আস্তে নামাতে থাকলেন পতাকা। পতাকা গলায় জড়ালেন। ধীরে ধীরে আসলেন আমাদের কাছে। আবার শুরু করলেন আলোচনা।
সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার। নিজে কিছু করেননা আগেই বলা হয়েছে। সাত্তার সিকদার বললেন,"দেশ স্বাধীন করেছি যুদ্ধ করে। পতাকা পেয়েছি। আর কিছু চাইনা। কিন্তু বাবা দুবেলা খেয়ে বাঁচতে হবে তো। আরতো পারি না।"
মুক্তি যোদ্ধা সাত্তার সিকদারের চোখে আবারো জলের ধারা। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ব্যবসা করতেন। একটি মুদির দোকান ছিল,খেয়ে-পরে চলে যেত ভালোই। সেই ব্যবসা ফেলে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে আর কিছুই পাননি।
তার দুটি গরু ছিল। দু'বছর আগে তার সেই গরু দুটি এলাকার কিছু লোক ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলে। এর মধ্যে একটি গরুর পাচ কেজি দুধ হতো। এই দুধ বিক্রি করেই কষ্টে হলেও তার সংসার চলত। গরু হারিয়ে আরো নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি। কারা নিয়ে গেছে আপনার গরু?
কিছুতেই তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিলেননা। তাকে বলেছিলাম আমাদের আপনি নাম বলেছেন সেটা প্রকাশ করা হবে না। এবার অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বললেন" কাউকেই তো আর বিশ্বাস করতে পারিনা বাবা। নাম বললে আমি এলাকায় থাকতে পারবো না,থাকতে পারবো না......।"
অনুসন্ধানে জানা যায়,'পার্শ্ববর্তী এলাকার তকিবুর রহমান ও তার ছেলে হাফিজের নেতৃত্বে একদল লোক তার গরু নিয়ে যায়। কে এই তকিবুর রহমান? অনুসন্ধানে জানা যায়,তকিবুর রহমান একাত্তরের একজন নামকরা রাজাকার।'... বদলে যাওয়া সামাজিক প্রেক্ষাপটে তকিবুর রহমানের কোন শাস্তি হয়নি।
তারা আজো টিকে আছে দাপটের সাথে। একাত্তরের পরাজিত দালাল আজ বিজয়ী বীরের ভূমিকায়। আর যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা সাত্তার সিকদাররা আজ জীবনযুদ্ধের পরাজিত সৈনিক। অকুতোভয় কমান্ডার সাত্তার সিকদার আজ একজন রাজাকারের নাম বলতেও ভয় পায়।
........................
বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে গল্লামারি স্মৃতিসৌধে জাঁকজমক অনুষ্ঠান হয়। এমপি ডিসিরা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। আশার বাণী শুনিয়ে চলে যান। সেদিনও পতাকা তোলেন কমান্ডার সাত্তার সিকদার। কিন্তু মূল অনুষ্ঠানে তিনি পেছনে পরে যান। তার কথা কেউ মনেও রাখেনা।
এতে হয়তো তার কিছুই যায়-আসে না। প্রতিদিনের মত যথা নিয়মে পতাকা তোলেন আর নামান। তার জীবনের বাকি সময়টা হয়তো এভাবেই কেটে যাবে।
----------------------------------------
এটা ''সাপ্তাহিক ২০০০'' এর ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালের প্রতিবেদন(কিছুটা সংক্ষেপিত)। আসুন তার বর্তমান অবস্থা দেখি।

''অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে তাঁর। ঠোট নড়ছে, বিড়বিড় করছেন। এত চেষ্টা করেও তার মুখ দিয়ে একটি বোধগম্য শব্দও বের হলো না। শোনা হলো না মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথাগুলো। শুন্যদৃষ্টিতে শুধুই তাকিয়ে থাকা ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই মানুষটির। অশীতিপর আবদুস সাত্তার এখন শুধুই প্রহর গুনছেন।
কবে শেষ হবে তা বেঁচে থাকার লড়াই! খুলনা শহরের পশ্চিমে গল্লামারি স্মৃতিসৌধের ঠিক পাশেই একটুকরো জমির উপর আবদুস সাত্তার তার পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন। জীর্ন কুঁড়ের ঘুণে ধরা একটি চৌকির ওপর শুয়ে থাকেন সারাদিন। কোথায় যন হারিয়ে গেছে তার একাত্তরের মনোবল। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন নয় নম্বর সেক্টরে।
..............................
১৯৯৫ সালে গল্লামারী বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপিত হলে বিনা পারিশ্রমিকে এর সংরক্ষনের দায়িত্ব নেন তিনি। প্রতিদিন ভোরে জাতীয় পতাকা তুলতেন তিনি,সন্ধায় আবার নামিয়ে রাখতেন। ১৯৯৮ সালে(শেষ দিকে) প্রথমবার মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়। তখন দিন পনেরো পতাকা তুলতে পারেন নি। সুস্থ হয়ে ফের ছুটে যান পতাকা তুলতে।
দ্বিতীয়বার রক্তক্ষরন হবার পর থেকে আর পতাকা তুলতে পারেন না। বাবার দ্বায়িত্ব এখন পালন করছেন মেঝ ছেলে হান্নান সিকদার। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার দেড় হাজার টাকা দিয়ে চলছে তাদের সাতজনের সংসার। তার স্ত্রী বলেন,'ওনাকে তিন বেলা ওষুধ দিতে মেলা টাকা লাগে,তাই এখন এক বেলা ওষুধ দেই।
আল্লার রহমতে তাই এখনো উনি বাইচে আছেন।''
.....................
একাত্তরের যুদ্ধ কেড়ে নেয় তার আর্থিক স্বাধীনতা। বাকহীন দৃষ্টি আজ শুধুই হারানো স্বাধীনতা খুঁজে ফেরে।
(প্রথম আলো-১৮ ডিসেম্বর ২০০৯)
।---------------------------------------------------------
আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন আমাদের চট্টগ্রাম শহরে নামকরা রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের(সাকা) চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয়ার অনুষ্ঠানের জন্য মাইকিং হচ্ছে!! (মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল তখন)
এই যোদ্ধার জন্য কি কিছু করা যায় না? এই এত বড় ব্লগ কমিউনিটিতে খুলনা শহরের কেউ কি নেই? তার নামে কোন একটা ব্যঙ্কে কেউ প্লিজ একটা একাউন্ট খুলে দিয়ে ব্লগে একটা পোস্ট দিন। এরপর আমরা যার যার সাধ্যমত কিছু করব।

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×