somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলচ্চিত্রের সংকট নিরসনের উপায়

২১ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ৮:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চলচ্চিত্রের সংকট নিরসনের উপায়
.....
তপন বাগচী
.......

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে খুব বেশি গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়নি। আলমগীর কবিরের ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ’-এর (১৯৭৯) মতো মূল্যায়নধর্মী গ্রন্থের পরে অনুপম হায়াৎ লিখলেন ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ (১৯৮৭)। চলচ্চিত্র-জগতের অনেক আকর তথ্যের ভাণ্ডার এই গ্রন্থ। একই বছরে প্রকাশিত চিন্ময় মুৎসুদ্দীর ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সামাজিক অঙ্গীকার’ (১৯৮৭) গ্রন্থটিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চরিত্র বুঝতে ব্যাপক সহায়ক। আর চলচ্চিত্রের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে মির্জা তারেকুল কাদের লিখলেন ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প’ (১৯৯৩)। এরপর নতুন শতাব্দীতে এসে খন্দকার মাহমুদুল হাসান লিখছেন ‘চলচ্চিত্র’ (২০০৬) নামের বিশাল আকারের এক গ্রন্থ। আহমাদ মাযহারের ‘বাঙালির সিনেমা’ (২০০৮) গ্রন্থটিও অনেক জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সম। সাজেদুল আউয়াল, জাকির হোসেন রাজু ও আহমদ আমিনুল ইসলাম চলচ্চিত্র নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আহমদ আমিনুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ জেয়াদের চলচ্চিত্র সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। অনুপম হায়াৎ চলচ্চিত্রবিষয়ক বেশ কয়েকটি গ্রন্থ লিখে তাঁর চলচ্চিত্রগবেষণার প্রমাণ রেখে চলেছেন। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র-গবেষক বলতে অনুপম হায়ৎ-এর নামটিই সকলের আগে ভেসে ওঠে। চলচ্চিত্রবিষয়ক তথ্য পাওয়া যখন খুব কঠিন ছিল, সেই সময়ে তিনি এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। বর্তমানে চলচ্চিত্র গবেষণার সুযোগ বেড়েছে। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ফেলোশিপ প্রদান করে চলচ্চিত্রবিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিতও হয়েছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য বই একেবারেই হাতেগোনা। এরই মাঝখানে ভিন্ন রকমের একটি গবেষণাগ্রন্থ আমাদের চোখে পড়ে। গ্রন্থটির নাম ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প: সংকটে জনসংস্কৃতি’। লিখেছেন গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হক। এঁরা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগবিদ্যার শিক। উভয়ের পাঠদানের আওতার মধ্যে চলচ্চিত্রও রয়েছে। ফাহমিদুল হক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণাও করেছেন চলচ্চিত্র নিয়ে। তাই এই দুই গবেষকের যৌথ রচনা পাঠকের কাছে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দেয়। গবেষকদ্বয় শুরুতেই জানিয়েছেন, এই গবেষণার সহযোগী ছিলেন নজরানা চৌধুরী, নীনা শামসুন নাহার, প্রদীপকুমার চৌধুরী, ফাতেমা বেগম ও হুমায়রা বিলকিস। এই গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিঞ্চিৎ অনুদানও দিয়েছিল। গবেষণার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেই এই গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
রীতিসিদ্ধ গবেষণা-পদ্ধতি মেনে কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে। মোটাদাগে ছয়টি পদ্ধতি তাঁরা অবলম্বন করেছেন--প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন পদ্ধতি, অংশগ্রহণমূলক নিরীক্ষণ পদ্ধতি, গ্রন্থাগার পদ্ধতি, আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি, দর্শক জরিপ পদ্ধতি, ফোকাসগ্রুপ আলোচনা পদ্ধতি। বিজ্ঞানসম্মত এই সকল পদ্ধতিতে গবেষকদ্বয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং এবং পাঠকদের জন্য পরিবেশন করেছেন। গবেষকদের অভীষ্ট ল্ ল েক্ষ্যয পৌঁছতে গবেষণার পদ্ধতি-নির্ধারণ যথার্থ হয়েছে। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রগবেষণায় এরকম পদ্ধতিগত চর্চা এর আগে হয়নি বলে এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাতে চাই।
গ্রন্থটি বিভক্ত হয়েছে সাতটি অধ্যায়ে। অধ্যায়কে বলা হয়েছে ‘ক্যাপস্টিক’। অবতরণিকাকে বলা হয়েছে ‘ওপেনটি বাইস্কোপ’। এছাড়া অধ্যায়গুলোর নাম হিসেবে ব্যবহৃত হযেছে ওয়াইড এ্যাঙ্গেল, ফ্যাশব্যাক, জুম-ইন, স্লো মোশন, মিজাঅঁ-সেন, কোজ-আপ এবং ডিপ-ফোকাস শব্দবন্ধ। চলচ্চিত্রের এই ধরনের পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়লগ্নতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমিন প্রকাশ পেয়েছে লেখকদের রসবোধ। প্রণাণীবদ্ধ গবেষণাকর্ম হলেও পাঠকের কথা মাথায় রেখেই যে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে, গবেষকদের ভাষা-ব্যবহারে তা বোঝা যায়।
জনসংস্কৃতি হিসেবে চলচ্চিত্রের ভূমিকার কথা জানাতে গিয়ে জনসংস্কৃতিপাঠের গুরুত্বের কথাও তাঁরা বলেছেন। এর পে তাঁদের উপস্থাপিত যুক্তি--
‘জনসংস্কৃতি হিসেবে চলচ্চিত্র এক বিরাট অংশ দখল করে আছে বাংলাদেশের জনজীবনে। শুধু নিম্নবিত্তের মানুষ নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চলচ্চিত্রের বিষয়য়ে যতই উন্নাসিক ভাব দেখাক না কেন, কোনো না কোনোভাবে সে ঢাকাই চলচ্চিত্র কনজিউম করে, আস্বাদন করে, উপভোগ করে।’
তাঁদের এই যুক্তি অকাট্য বলে আমরা সহজেই মেনে নিতে পারি। চলচ্চিত্রের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে বলে তথাকথিত শিিক্ষত সমাজ ওই মাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সাধারণ মানুষ ঠিকই চলচ্চিত্র উপভোগ করে। তাই একে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে গৌরব নেই। বরং এই শক্তিশালী জনসংস্কৃতি নিয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তা করা দরকার, সেই সত্যটিও তুলে ধরেছেন গবেষকদ্বয়। তাঁদের এই সাগ্রহ কর্মতৎপরতা চলচ্চিত্রশিল্পের কতিপয় সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রচলিত ইতিহাসকে তাঁরা সংক্ষেেপ তুলে ধরেছেন দ্বিতীয় অধ্যায়ে। এেক্ষেেত্র তাঁরা নতুন কোনো তথ্য উদঘাটন করতে যাননি। গবেষণার অন্বিষ্টও তা নয়। চলচ্চিত্রশিল্প সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার জন্যেই এই ইতিহাসের পুনর্পাঠ। তাঁরা লিখেছেন--
‘ছবিটি (দি লাস্ট কিস্) ঢাকার মুকুল প্রোগৃহে ১৯৩১ সালে মুক্তি পায়। মুক্তি উপলে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় এবং ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার।’ (পৃ. ৩৬)
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন প্রফেসর জিএইচ ল্যাংলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে ওই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেননি, তা এই তথ্য থেকেই বোঝা যায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার উপাচার্য ছিলেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। তিনি উদ্বোধন করেছেন খ্যাতিমান অধ্যাপক কিংবা ইতিহাসবিদ হিসেবে, কিন্তু উপাচার্যের পরিচয়ের কারণে নয়। এটি মারাত্মক কোনো ত্রুটি নয়। তবু সত্যের খাতিরে উল্লেখ না করে উপায় নেই।
এই অধ্যায়ে চলচ্চিত্রের কেবল ঐতিহাসিক তথ্যই নয়, গবেষকদের নিজস্ব মূল্যায়নও খচিত হয়েছে। তাঁদের এই মন্তব্যের ফলে চলচ্চিত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে সহজ হয়। তবে সকল মূল্যায়নের সঙ্গেই যে পাঠক একমত হবেন, এমন নয়। গবেষদ্বয়ও হয়তো তা প্রত্যাশা করেন না। তারপরেও তাঁদের বেশির ভাগ মূল্যায়নই যুক্তিগ্রাহ্য মনে করা যায়। এর মধ্যে একটি মন্তব্য আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। নব্বই দশকের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে--
‘এই দশকে ইন্ডাস্ট্রিতে অল্প কয়েকটি অব-বিট ছবি নির্মিত হয়। কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ ঢাকা এসে নির্মাণ করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে পদ্মনদীর মাঝি’ (১৯৯৩)। স্বাধীনধারা পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ইন্ডাস্ট্রিতে নির্মাণ করেন শিশুকিশোরদের ছবি দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) ও দুখাই (১৯৯৭), সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে আখতারুজ্জামান নির্মাণ করেন পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৯৬) ও চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন হাঙ্গর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)। ছবিগুলোর কোনো কোনোটি কিছুমাত্রায় ব্যবসাসফল হলেও, শেষদুটি ছবি সব দিক থেকেই ছিল ব্যর্থ।’ (পৃ. ৬৫)
গবেষকদ্বয় পদ্মা নদীর মাঝি, দিপু নাম্বার টু ও দুখাই -- এই তিনিট ছবির কোনো কোনোটি (মানে একটি কি দুটি) ‘কিছুমাত্রায় ব্যবসাসফল’ হলেও পোকামাকড়ের ঘরবসতি ও হাঙ্গর নদী গ্রেনেডকে ‘সব দিক থেকেই ব্যর্থ’ বলেছেন। অর্থাৎ বিনা যুক্তিতেই খারিজ করেছেন ওই দুটি ছবির ‘সাফল্য’কে। ওই দুটি ছবির দর্শক এবং এই মন্তব্যের পাঠক হিসেবে আমার প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে। সেই সুযোগ নিয়ে বলতে চাই যে, ওই দুটি ছবি ‘সব দিক থেকেই ব্যর্থ’ হতে পারে না। কারিগরি ব্যাখ্যা দেয়ার যোগ্যতা আমার হয়তো নেই। কিন্তু ওই ছবির কাহিনী, আবহ সঙ্গীত, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের েপ্রক্ষাপট বিবেচনায় প্রথম শ্রেণীর চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেতে পারে। কাহিনীকার হিসেবে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এই যুক্তিটি অবশ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবু তথ্য হিসেবে এর গুরুত্বকে অস্বীকার করি কীভাবে? নির্মাণকলার আর কিছু বিবেচেনায় না নিয়েও কেবল কাহিনী ও সংলাপের কারণেই চলচ্চিত্রদুটিকে আমি ব্যর্থ বলতে রাজি নই। লেখকদের এই মন্তব্য পুনির্বিবেচনার আহ্বান জানাই। লেখকদের একজন আমার শিক্ষক, আরেকজন অনুজপ্রতিম বন্ধু। দুজনের পাণ্ডিত্যকেই আমি শ্রদ্ধা করি। ঢালাও মন্তব্যকে মেনে নিতে পারিনি বলেই এই অনুরোধ।
‘চলচ্চিত্র-শিল্পের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি’ নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে ‘অশ্লীলতা’, ‘সহিংসতা’, ‘ব্যবসায়িক মন্দা’, ‘প্রদর্শক নির্ভরতা’ প্রভৃতি বিষয়। নতুন শতাব্দীর কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখে তাঁরা এই সকল নেতিবাচক প্রবণতার স্বরূপ উেন্মাচন করেছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ থেকে জানানো হয়--
ক্স এ গবেষণার আওতায় যতগুলো চলচ্চিত্র দেখা হয়েছে তার সিংহভাগেই নারী প্রধানত যৌন-উপকরণ হিসেবে উপস্থাপিত। এছাড়া ধর্ষণের মতো একটি ভয়ঙ্কর যৌন-অপরাধকে প্রধানত যৌন-উত্তেজনা প্রদানের জন্য বারংবার ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্স সেন্সরবোর্ডের সদস্যরা একদিকে যেমন পর্নোউপাদান সংবলিত চরচ্চিত্র অনুমোদন করেছেন, তেমনি অননুমোদিত দৃশ্যও প্রোগৃহে প্রদর্শিত হয়েছে।
ক্স হাত-পা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলা, শ্বাসরোধ করে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, গলায় কামড় দিয়ে হৃদপিণ্ডসহ কণ্ঠনালী বের করে আনা, শিশুকে পুড়িয়ে নির্যাতন ইত্যাদি নানা কায়দায় সহিংসতা কায়েম করা হয় এবং ছবিগুলোর মধ্যে এর প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
ক্স চলচ্চিত্র ব্যবসা মন্দা হবার অন্যতম কারণ হলো দর্শক হিসেবে নারীদের হারিয়ে ফেলেছে এই শিল্প।
এই পর্যবেক্ষণ নতুন কিছু না হলেও শৃঙ্খলার মধ্যে এনে উপস্থাপন করার কারণে মন্তব্য প্রতিষ্ঠা লাভ করল। আমরা জানতে পারলাম চলচ্চিত্রের সংকট প্রকৃতপক্ষে কোন জায়গায়? রোগনির্ণয় করা গেলে নিরাময়ের উপায় খোঁজা যায়। তাঁরা নির্ণয়ের কাজটি করেছে, নিরাময়েরও প্রচেষ্টা চলছে।
টেলিভিশনের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়েও তাঁরা কথা বলেছেন। বিশেষত ইমপ্রেস টিলিফিল্ম এবং কয়েকজন স্বাধীন চরচ্চিত্রকারের ভূমিকা ও অবদানের কথা তাঁরা উল্লেখ করেছেন। এই চলচ্চিত্রগুলো টেলিভিশনের দর্শকদের কাছে গ্রহণীয় হলেও, এবং সুস্থ ধারায় চলচ্চিত্রকে ফিরিয়ে আনার েক্ষেত্রে অবদান রাখছে বলে অনেকে ধারণা করলেও গবেষকরা বলেছেন অন্যকথা--
‘জনসংস্কৃতি হিসেবে চলচ্চিত্রে ইমপ্রেসের চলচ্চিত্রগুলোর তেমন কোনো অবদান নেই, বরং এই চলচ্চিত্রগুলোর জনবিযুক্ততা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকারে রয়ে যাচ্ছে।’ (পৃ. ৮১)
এই বক্তব্যও মেনে নেয়া যায় না। গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই টেলিভিশনে স্বতন্ত্র গণমাধ্যম চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়। েপ্রক্ষাগৃহে যাওয়ার সুযোগ যাঁরা পান না, তাঁরা ঘরে বসে টেলিভিশনে অন্তত চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারে। কিন্তু ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ না হলে, টেলিভিশন দেখাবে কী? সেই অভাব বোধ থেকেই হয়তো ইমপ্রেস টেলিফিল্ম চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিছু ভালো চলচ্চিত্রও এভাবে নির্মিত হয়। আগে ক্ েপ্রক্ষাগৃহ থেকে চলচ্চিত্র আসত টেলিভিশনের পর্দায়, আর এখন টেলিভিশনের প্রিমিয়ার শো’র পরে চলচ্চিত্র যাচ্ছে পর্দায়। কিছু ভালো চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ তো ঘটছে! তাই এই উদ্যোগকে ‘জনসংস্কৃতি’ বিবেচনায় খাট করে না দেখলেও চলে। ইমেপ্রেসের অবদান নেই বলে একথায় খারিজ করে দেয়া যায় না। অন্তত টেলিভিশনের দর্শকরা এই চলচ্চিত্রগুলি দেখেছে বলে ধরে নিতে পারি। সেই বিবেচনায় চলচ্চিত্রগুলোকে ‘জনবিযুক্ত’ বলতে গেলে টিলিভিশনকেও জনবিযুক্ত মাধ্যমের সারিতে দাঁড় করাতে হয়।
আমরা জানি যে, চলচ্চিত্রশিল্পের সংকট নিরসনে সরকার একসময় উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৭ সালে অক্টোবরে র্রাপিড একশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব)-এর মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স অশ্লীলতার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় এবং অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। টাস্কফোর্সের তৎপরতায় এই শিল্পের কিছুটা উন্নতি হয় এবং বলা যায় চলচ্চিত্র সুস্থ ধারায় প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করে। এ থেকে হয়তো চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা ও সহিংসতা দূর হতে পারে, কিন্তু চলচ্চিত্রের শিল্পমান রা করবে কে? আমাদের কাহিনীতে ধস, গানের বাণীতে দুর্বলতা, সুরেও অনুকরণপ্রিয়তা, অভিনয়ের স্থুরতা, সর্বোপরি পরিচালনার অযোগ্যতা নিয়ে একটি ইন্ডাস্ট্রি চলছে কীভাবে, ভাবলে অবাক হতে হয়।
সরকার ও সেন্সরবোর্ডের পদপে নিয়েও গবেষকদ্বয় আলোচনা করেছেন। শহীদুল ইসলাম খোন, মোরশেদুল ইসলাম ও তারেক মাসুদ-এই তিন পরিচালকের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করে সেন্সরপ্রথার বদলে গ্রেডিংপ্রথা চালুর পে তাঁদের অভিমত তুলে ধরেছেন। এধরনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য গবেষকদ্বয় আমাদের সাধুবাদ পাবেন।
‘আধেয় বিশ্লেষণ--দর্শক কী খায়?’ নামের অধ্যায়ে ২২টি ছবি দেখে তার মধ্যে বাছাই করে রঙ্গীন চশমা (২০০৪), বাঘের বাচ্চা (২০০৪), বিদ্রোহী সালাহউদ্দিন (২০০৪)--এই ছবিতিনটির আধেয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তিনটি ছবিই ২০০৪ সালের। ফলে একটি বছরের চিত্র ধরা পড়েছে। ছবিগুলো ভিন্ন বছরের হলে ভালো হতো বলে মনে হচ্ছে। তবে এই সীমাবদ্ধতা তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বিশ্লেষণের গভীরতা দিয়ে। আলোচনা-বিশ্লেষণ একেবারেই গবেষকদের দর্শন-শ্রবণ-অভিজ্ঞতাজাত। তাই তাতে অনেক সত্য প্রস্ফুটিত। তাঁদের মন্তব্য থেকে কিছু টুকরো সত্য উদ্ধার করা যায়--
ক্স কাহিনী খুব দুর্বল, পারম্পর্যহীন, অসংলগ্ন, কখনো কখনো একই ধাঁচের।
ক্স কারিগরি দিক থেকে ছবিগুলো সাংঘাতিক দুর্বল।
ক্স ছবিগুলোর প্রধান অবলম্বন যৌনতা ও সহিংসতা।
ক্স ক্যামেরা কেবলই পাত্রপাত্রীকে অনুসরণ করে, পারিপার্শ্বিক ডিটেল কিংবা প্রতীকের ব্যবহার একেবারে অনুপস্থিত।
ক্স কাহিনী সমাজবাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে।
ক্স ছবিগুলোর ইতিহাসজ্ঞান সামান্যই মনে হয়।
ক্স সেট নির্মাণের েক্ষত্রে সিনেমাগুলোতে খুবই দুর্বলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ক্স প্রতিটি গানই ভীষণ কদর্য।
ক্স গান হলো পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের প্রধান অবলম্বন।
ক্স ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছে, এগুলো যতটা অশ্লীল তার চাইতে বেশি সহিংস।
ক্স বেশিরভাগ নারীচরিত্রের কোনো পেশা থাকছে না। বাংলা ছবির শ্রেণীচেতনা তাই ভুয়া, অসার, অবাস্তব; প্রকৃত শ্রেণীচেতনা বিকাশের প্রতিকূলে তা কাজ করে।
এভাবে তালিকা আরো বাড়ানো যায়। এধরনের অনেক মূল্যবান মন্তব্য তাঁরা করেছেন আধেয় বিশ্লেষণ থেকে। পাঠক এই অধ্যায় থেকে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের ছবি সম্পর্কে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভ করতে পারে। গবেষকদ্বয় কেবল সমালোচকের চোখ দিয়ে নয়, পাঠকের চোখ দিয়েও দেখেছেন বলেই হয়তো প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে।
দর্শক ও প্রোগৃহের চেহারাটাও গবেষকদ্বয় তুলে ধরেছেন বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিেত। প্প্রেক্ষগৃহে এখন আর নারীদর্শক পাওয়া যায় না। প্রকৃত দর্শকের জনমিতি তাঁর নির্ণয় করেছেন। তবে কেবল সংকটের কথা তুলে ধরেই তাঁরা দায়িত্ব শেষ করেননি। তাঁরা ‘সংকট নিরসন-সূত্র’ও বাতলে দিয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো--পরিচালক ও প্রযোজকের মনোজগতে পরিবর্তন আসতে হবে, সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ফিল্ম সেন্টার গড়ে তুলতে হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটতে হবে, চিত্রনাট্য টেকনিক ও টেকনোলজিতে পেমাদরিত্ব আনতে হবে, বৃহত্তর বাজারের সন্ধান করতে হবে, নানা ধরনের দর্শকের উপযোগী সিনেমা নির্মাণ করতে হবে।
এ কথা প্রচার করতে ভালো লাগছে যে, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে একটি ভিন্ন ধরনের ভালো গ্রন্থ লিখছেন গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হক। সময়মতো তাঁরা সংকটকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিয়ে এধরনের আরো কাজ হতে পারে আমাদের শিল্পসংস্কৃতি অন্যান্য মাধ্যম তথা সংগীত, নাটক, টেিিলভিশন, বেতার এমনকি সাহিত্য নিয়েও। আর সেই ধরনের কাজে নির্দেশক প্রচেষ্টা হিসেবে অনুকরণীয় হতে পারে এই গ্রন্থ ।
গ্রন্থটির ছাপা, কাগজ, বাঁধাই ভালো। কিন্তু ভেতরে ব্যবহৃত ছবি মান ভালো নয়। প্রচ্ছদকে অর্থবহ করে তোলার জন্য রবীন আহসানকে ধন্যবাদ জানানো যায়। চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে এই গ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে হীরালাল সেনকে। যোগ্য পাত্রে যোগ্য অর্ঘ্য। এই শিল্পের উন্নতির জন্য এধরনের গবেষণা আরো প্রয়োজন।
...................................
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×