somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বহমান নদী ও ভাষা; (ভাষার মাসে ভাবতে হবে)

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নদী ও ভাষা উভয়ই বহমান। পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে নদী তার আপন গতিতে বহমান রয়েছে। আর ভাষা বহমান-মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে। কালে কালে বদলে যায় নদীর ধারা। তেমনি সময়ের পরিবর্তনে বদলে যায় মানুষের মুখের ভাষা। নদী বদলে প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষেরও ভূমিকা সমাসীন। কিন্তু ভাষা বদলে প্রকৃতি নিরব। মানুষের মুখে মুখেই রূপ বদল হয় ভাষার। যুগের পরিবর্তনে বহু নদী যেমন তার উপকূলের মানুষকে দিয়েছে সমৃদ্ধি, তেমনি অগণিত মানুষের শেষ সম্বল কেড়ে নিয়েছে এই নদী। ভাষাও ঠিক তেমনি। যুগে যুগে ভাষায় যোগ হয় নানা নতুন শব্দ যা ভাষাকে করে তুলে আরও সমৃদ্ধ। আবার তেমনি মাঝে মাঝে ভাষা হারিয়ে ফেলে নিজের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য। এতে ভাষার কোন দোষ নেই, দোষ ঐ মানুষগুলোর যারা এর অপব্যবহারে মত্ত হয়।
আমাদের দেশের অনন্ত জলরাশি আমাদের জাতীয় সম্পদ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় হাজার বছরের নদীতে বয়ে যাওয়া পলি দ্বারা এ ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে, বনাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশের পরিবর্তন ঘটিয়ে ভূমিকে মানুষের আবাসস্থলরূপে পরিণত করেছে। দেহের শিরা উপ-শিরার মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-নালা দেশকে করেছে শস্য শ্যামল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই নদীর তীরে সৃষ্টি হয়েছে জনপদ, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জীবিকা, চলাচল, পরিবহন, কৃষ্টি, শিল্প, সভ্যতা, আচার, ব্যবহারিক জীবন সব কিছুরই ভিত্তি হল এই নদী। তাই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সামাজিক জীবন। সোনার বাংলারূপে প্রাচীন বাংলার যে গৌরবোজ্জ্বল পরিচিতি, এ সবই তার বুকে বয়ে যাওয়া অজস্র নদী-নালার অনন্ত জলধারার অকৃত্রিম অবদান। দেহের রক্তকণিকার মতই আমাদের অস্তিত্বে মিশে আছে নদী। তাই তার পরিচয় মেলে কিংবদন্তিতে, ধর্মীয় পুরাণে, লোকগাঁথায়, ব্যবহারিক জীবনের কর্মকান্ডে। কিন্তু আজ এই নদীগুলো প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ শিকারে পরিণত হয়েছে।

“আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-
এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে...।”

পুনর্জন্মে বিশ্বাসী জীবনানন্দের পুনর্জন্ম যদি এত দিনেও না হয়ে থাকে তবে তিনি এই বাংলায় ফিরে আসতে পারলেও তার প্রিয় ধানসিড়ি নদীর তীরে তিনি আর ফিরতে পারবেন না। কারণ বরিশালের ঝালকাঠি জেলার বুকচিরে বয়ে যাওয়া সেই খরস্রোতা নদীটি আর নদী নেই, মরে গিয়ে সরু একটি নালায় পরিণত হয়েছে। কেবল জীবনানন্দ নয়, উৎসমুখ শুকিয়ে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদনের শৈশবের স্মতিবিজরিত কপোতাক্ষ নদের প্রবাহ বন্ধ হয়ে খালের রূপ নিয়েছে। এক সময় ভৈরব নদী ছিল গভীর, খরস্রোতা এবং ভয়ঙ্কর। হিন্দুদের কাছে এটি তীর্থ নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। যশোরপতি প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য মোঘল সেনাপতি মানসিংহ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ভৈরব নদী অতিক্রম করেছিলেন। এমন অনেক ইতিহাসের ধারক আজ নির্বিকার মরুতে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের রাজপুত্রদের মত ব্রক্ষ্মপুত্র নদও স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি ছবি। শুকনো মৌসুমে এর অধিকাংশ স্থানেই পানি থাকে না, মানুষ হেঁটেই নদী পার হয়ে যায়। আব্বাস উদ্দিনের ‘সর্বনাশা পদ্মানদী’ এখন বিস্তির্ণ মরুভূমি হয়ে গেছে। এমনি অনেক নদী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, দেশে নদীর সংখ্যা প্রায় ২৮০টি। ইতোমধ্যে ৮৮টি নদী মরে গেছে, আংশিক মরে গেছে আরো ২৪টি।
নদীর এই বেহাল দশার ফল কী তা আমাদের চোখের সামনেই দৃশ্যমান। আমাদের কৃষি অর্থনীতি আজ হুমকির সম্মুখীন। নদীভাঙনের ফলস্বরূপ শহরে বাড়ছে মানুষের ভীড়, বাড়ছে বস্তির সংখ্যা, বাড়ছে দ্রব্যমূল্য; কিন্তু কমে যাচ্ছে জীবনমান। আমাদের নদীগুলো সংস্কার আর পরিচর্যার অভাবে আবর্জনা আর পলি নিয়ে দিন দিন সেগুলো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এর আশু কোন প্রতিকার না হলে বাংলাদেশ অচিরেই অস্তিত্ব সংকটে জর্জরিত হবে-এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কোন অবকাশ নেই।
আমাদের দেশের নদীর সাথে ভাষার অনেকটা মিল আছে। নদী যেমন ধীরে ধীরে তার গতিপথ পরিবর্তন করছে, তেমনি ভাষাও তার ধরণ পরিবর্তন করছে। নদীগুলো মরে গিয়ে যেমন আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে হুমকির সম্মুখীন করছে, তেমনি ভাষার পরিবর্তনটাও আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করবে অচিরেই। ভাষার পরিবর্তন অতি স্বাভাবিক। ভাষাবিদ, সাহিত্যিকগণ নতুন শব্দের আবিষ্কার করবেন, আর মুখে মুখে তা ভাষায় স্থায়ী আসন গেড়ে নেবে, এইতো ভাষার পরিবর্তনশীলতা। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষগুলো নদীর মতো ভাষার প্রতিও অত্যাচারে বেশ মজা ও ফায়দা লুফে নিচ্ছে। কিন্তু এ যে নদীর মতই আমাদের ভাগ্যে অভিশাপের কালিমা লেপে দেবে তা বোধয় আমাদের চিন্তাতেও আসেনা।
আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতই গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার স্কুল। আর উচ্চবিত্তের সাথে সাথে কিছু অতি উৎসাহী মধ্যবিত্তও এসব স্কুলে সন্তান ভর্তি করে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল- এটাই হয়তো ভেবে নেন। কিন্তু শিক্ষা জন্য মাধ্যম হিসেবে তাই বেছে নেয়া উচিত যা শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে অধিকতর সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে বাংলার চেয়ে ইংরেজি যে অধিক ফলপ্রসু নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চয় আমাদের সাথে সাথে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিগণও একমত হবেন। কারণ, তাদের সন্তানেরা যখন ‘মানি মানি’ বলে চেঁচায়, এর মানে যে সন্তানের টাকা দরকার তা কিন্তু তারা বাংলাতেই বোঝেন।
ভাষার রাজ্যে আর এক হেরুইনসম মাদক হিসেবে সমাসীন হচ্ছে বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ। ছোট বেলায় দেখতাম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বিশেষ দ্রষ্টব্যে লেখা থাকতো, ‘সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ দূষণীয়’। ভাষা প্রয়োগের বৃহত্তর স্বার্থে এরূপ দ্রষ্টব্য থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মনে হয় সে দিন চলে এসেছে, যেদিন দ্রষ্টব্যে লেখা হবে, ‘বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ দূষণীয়’। আজকালের টিভি নাটকগুলো পরিবর্তনের নামে যাচ্ছে-তাই করে বেড়াচ্ছে। যাতে করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষার স্বকীয়তা। কারণ এ যুগের ছেলেমেয়েরা যে ইংরেজি ছাড়া ১০টি বাক্যও বাংলায় বলতে পারে না-তা আমাদের চারপশেই পরিলক্ষিত হয়। এর আরো একটা কারণ হিসেবে বলবো এফ এম রেডিও’র মহাকীর্তি। এফ এম-এর কথিত জকিরা যেভাবে বাংলা শব্দের উচ্চারণ করেন ঠিক একইভাবে ইংরেজিরও উচ্চারণ করেন। তারা যে ইংরেজি শব্দের সঠিক উচ্চারণের অনুশীলন করছেন না-একথা অস্বীকার করার জো নেই। কেবল তারুণ্যকে একটু পাশ্চাত্য ছোঁয়া দিতে আমার ‘বাংলা’ কে মুখ ভেঙচিয়ে ‘ব্যাংগালি’ বলার অধিকার কারো নেই। তবুও এদেশে এমন উচ্চরণের কমতি নেই। তবে এর ফলাফল যে ভাল নয় তা নিয়ে সংশয় না থাকাই উচিত। আমাদের নদীগুলো যেমন আমাদেরকে আজ সর্বশান্ত করে দিতে উদ্যত হয়েছে, তেমনি ভাষাও পারে আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ত্বকে হুমকির সম্মুখীন করতে।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে যত সভ্যতা গড়ে উঠবে সব সভ্যতার জন্যই নদী ও ভাষা সমানভাবে অপরিহার্য। তাই আমাদের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য এবং আমাদের অস্তিত্বকে সমুন্নত রাখার জন্য নদী ও ভাষাকে তাদের যথাযত মর্যাদা দানের বিকল্প কোন কিছুই হতে পারে না।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৬


আমি যখন কানাডায় বসে পাশ্চাত্যের সংবাদগুলো দেখি, আর তার পরপরই বাংলাদেশের খবর পড়ি, তখন মনে হয় - পশ্চিমা রাজনীতির চলমান দৃশ্যগুলো বহু পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আলো-ছায়ায় প্রতীয়মান... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×