নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকের কথা। ঢাকা শহরের আমরা এসেছি এক মাসের মত হবে। আমাদের এই পাড়াটা বেশ সুন্দর, ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকার মত ঘিঞ্জি নয়। সরকারি কোয়ার্টার হওয়ায় চারিপাশে বাউন্ডারি দেওয়া, আছে বেশ কিছু গাছপালা, একটা খেলার মাঠও আছে। পাড়ার মানুষের বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি রিক্রেশন রুম, যেখানে সন্ধ্যা বেলায় ক্যারামবোর্ড, দাবা, তাস খেলা হয়। কুড়ি ইঞ্চি একটা সাদাকালো টেলিভিশনে পাড়ার মুরব্বীরা রাত আটটার বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর দেখেন।
আমাদের বাসাটা তিন তলায়। সামনের বিল্ডিংটা বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায় জানালা খোলা রাখলে সুন্দর বাতাস আসে এজন্য বেশিরভাগ সময় আমার রুমের জানালা খোলা রাখি। একদিন জানালা দিয়ে খেয়াল করলাম সামনের বিল্ডিংয়ের দোতালায় একটা মেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তার লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। পড়া ফেলে মেয়েটার চুল আঁচড়ানো দেখতে লাগলাম। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই এক দুইবার মেয়েটাকে দেখতে পেতাম।
আমি শফিক, সদ্য এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে চিটাগং থেকে বাবার বদলীর কারণে ঢাকায় এসেছি।বাবার বদলীটা অনেকদিন আগেই হয়েছে, এতদিন আমার পরীক্ষার কারণে অফিসে রিকোয়েস্ট করে সেটা আটকে রাখা হয়েছিল।
এটা
নতুন পাড়ায় ধীরে ধীরে দু একজন বন্ধু তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইকবাল, মিন্টুদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। ওরাও আমার মত এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে এখন রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে । বেশ সুবিধাই হল, ওদের সাথে পড়াশোনা, কে কোন কলেজে ভর্তি হবো তা নিয়ে আলাপ করা যায়।পড়াশোনার বাইরে আমাদের সবারই প্রিয় খেলা ক্রিকেট, তবে ফুটবল খেলাও পছন্দ করি। আবাহনী মোহামেডানের মধ্যে ফুটবল খেলা হলে এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করে।সবাই দলবেঁধে স্টেডিয়ামে যাই খেলা দেখতে। নিজ দলের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করি, যা নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ বাক বিতন্ডা হয়।
কথায় কথায় একদিন জানলাম এ পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের নাম নিলু।
- নীলুতো তোদের সামনের বিল্ডিংয়ের দোতালায় থাকে,মিন্টু জানালো।
আমার বুঝতে বাকী রইলো না সামনের দোতালার চুলে চিরুনি করা মেয়েটাই নীলু।
-কিন্তু সাবধান! নীলুকে পাড়ার মতিন ভাই পছন্দ করে। মতিন ভাই ভিশন ডেঞ্জারাস লোক কালা জাহাঙ্গীরের ডান হাত। সবসময় পকেটে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ইকবাল জানলো তথ্যটা।( সে সময় ঢাকা শহরে শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল, তার নাম শুনলে পুরো ঢাকা শহর কাপতো। আমাদের বয়সী অনেক কিশোরের হাতেও অস্ত্র তুলে দিয়েছিল এই কালা জাহাঙ্গীর )
ওরে বাবা! শুনে বুকের ভিতর ভয়ের স্রোত বয়ে গেল।
ইস মতিন ভাই আর কোন মেয়ে পেল না পছন্দ করার জন্য।
যদিও আমার রুমের জানালা সবসময় খোলা থাকে তবে আগের মত ওই বাসার দিকে তাকাই না, পরে যদি মতিন ভাইয়ের চোখে পড়ে যাই। আমি জানালায় খুব বেশি না দাড়ালেও দুইএকবার লুকিয়ে লুকিয়ে নীলুকে দেখি আর মনে মনে আফসোস করতে থাকি।
একসময় আমি ইকবাল মিন্টু আমরা সবাই বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হলাম। বিকেলে সবাই পাড়ার রিক্রেশন রুমের সামনে এক হতাম ।পাড়ার মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যডমিন্টনসহ সারাবছর নানান ধরনের খেলা খেলতাম। পাড়ায় দুইটা টিম আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, আমি ইকবালদের সাথে মিশতাম তাই আমি অবধারিতভাবেই ইকবালদের গ্রুপের সদস্য হয়ে গেলাম। আমাদের কালো চিতা গ্রুপের সাথে রায়হানদের দেশী বয়েজ গ্রুপের দ্বন্দ লেগেই থাকতো। বেশ কয়েকবার দুই গ্রুপের মাঝে দ্বন্দ হাতাহাতি এমনকি মারামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন ছোট খাট দ্বন্দ মতিন ভাই মিমাংসা করে দিতেন। একবারতো দেশী বয়েজ গ্রুপের ছেলেরা আমাদের কালো চিতা গ্রুপের পবনকে বেধড়ক মেরেছিল,
এর কারণ ছিল,
আমাদের বন্ধু পবন মমীকে ভালবাসতো, মমীও পবনকে ভালবাসতো। অন্যদিকে দেশী বয়েজ গ্রুপের ফিরোজও মমীকে ভালবাসতো। মুলত মমীকে নিয়েই এই গন্ডগোলের সুত্রপাত। আমরাও এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম।
আমরা সবাই এক হয়ে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবন দিয়ে হলেও এর প্রতিশোধ আমরা নেবোই।
দেশি বয়েজ গ্রুপের বোকাসোকা টাইপের রতন নামের একটা ছেলেকে টার্গেট করলাম। যথারীতি ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে রতন ব্যাপক পেটানো হল, পবনতো পারলে ওকে মেরেই ফেলে। আমরা ওকে অনেক কষ্টে থামাই। এরপর থেকে দুই গ্রুপের দ্বন্দ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।আমরা সবাই আতংকের মধ্যে থাকতাম কখন কার উপর হামলা হয়।
আমাদের গ্রুপের মানিকের কাছে রীতিমতো হত্যার হুমকি দিয়ে একটা চিঠি আসলো।
মানিক খুবই ভয় পেয়ে গেল, ওর বাবার কাছে চিঠিটা দেখালো। পাড়ার মুরব্বিরা রিক্রেশন রুমে মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে পাড়ার সবছেলেদের ডাকা হল। দেশী বয়েজ গ্রুপের লিডার রায়হানের বাবাকে দায়িত্ব দেওয়া হল ওদেরকে সামলানোর এবং আমাদের সবার বাবাকে ডেকে বিষয়টি মিমাংসা করা হল। বড়রা আমাদের সবাইকে ডেকে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করিয়ে দিলেন । সকল অভিভাবক প্রতিজ্ঞা করলেন তাদের ছেলেকে কোন প্রকার মারামারি করতে দেবেন না । বড়দের হস্তক্ষেপের কারণেই বড় ধরনের গন্ডগোল মিটে গেল। কিন্তু মনে মনে ওরা প্রতিশোধ নেওয়ার বুদ্ধি আটতে লাগলো। একদিন ওদের কেউ একজন মতিন ভাইয়ের কাছে আমার নামে অভিযোগ করলো আমি নাকি নীলুর সাথে লাইন মারছি।
মতিন ভাই আমাকে ডাকলেন,
আমিতো ভয়েই অস্থির!
-নীলুর সাথে কি তোমার প্রেম চলছে? মতিন ভাইয়ের প্রশ্ন।
-না, আমি বললাম।
-নীলু যদি তোমায় ভালবাসে তবে আমার আপত্তি নেই, তবে ওকে ডিস্টার্ব করবে না।
-আচ্ছা, আমি মাথা নেড়ে বললাম।
মনে মনে বললাম
-আহারে এতো দেখছি নীলুর সত্যিকারের প্রেমিক।
সেদিন মতিন ভাইয়ের ব্যবহারে আমি অবাক হলাম। আমি ভেবেছিলাম আজ মতিন ভাইয়ের হাতে চড় থাপ্পড় খেতে হবে কিন্তু একি শুনলাম!
ততদিনে নীলুকে দূর থেকে দেখে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছি। নীলুর স্কুলে যাওয়া আসার সময়ে গলির মোড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেতাম নীলুকে মতিন ভাইয়ের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা গেছে, শুনে বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠতো। আমার অবশ্য বিশ্বাস হতো না মতিন ভাইয়ের মত একটা মাস্তানকে নীলু ভালবাসতে পারে। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম যেকরেই হোক নীলুকে জানাতেই হবে আমার ভালবাসার কথা। অনেক চিন্তাভাবনা হলুদ রঙের একটা কাগজে আমার ভালবাসার কথা জানিয়ে একখানা চিঠি লিখে ফেললাম।চিঠিটা নীল খামে ভরে চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে নীলুর কাছে পৌছানো যায়?
নীলুদের জানালার পাশে একটা পেয়ারা গাছ ছিল। একদিন রাত এগারোটার দিকে নীলুকে দেখলাম জানালার পাশে চুল আঁচড়াচ্ছে, মনে মনে ভাবলাম এটাই সুযোগ। জানালার পাশের পেয়ারা গাছ বেয়ে দোতালায় উঠে গেলাম, আমার পরনে ছিল সাদা টি শার্ট ও জিনস প্যান্ট । আমি যেই নীলুদের খোলা জানালা দিয়ে চিঠিটা ফেলেছি, ওমনি নীলুর চিৎকার দিল
-ভু-ত-ত, ভুত, ভুত।
আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে দ্রুত বাসায় চলে এলাম। ওদিকে ওদের বাসার পেছনের পেয়ারা গাছের নীচে প্রচুর লোকজন জড় হয়ে গেছে। সবাই ভুত খুজছে, কেউ কেউ বলছে
- চোর ই হবে, ভুত বলে কিছু আছে নাকি।
আমি মনে মনে আল্লাহ খোদার নাম জপতে লাগলাম। আমি ধারণা করেছিলাম চিঠিটা হাতে পেয়ে কাল সকালেই নীলুর বাবা আমাদের বাসায় বিচার নিয়ে আসবেন, এরপর কি হবে সেটা ভাবতেই আমার গা শিওরে উঠলো।
যা আশা করেছিলাম তার কিছুই ঘটলো না।নীলুর বাবা বিচার নিয়ে আমাদের বাসায় আসলেন না। সেইদিন থেকে আমার ঘরের জানালাটা পুরোপুরি বন্ধ। এখন আর নীলুর স্কুলে যাওয়া আসার পথে গলির মোড়ে দাড়িয়ে থাকি না। মোটকথা নীলুর ভাবনা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। আর দোয়া করিতে থাকি নীলু র বাবা যেন বিচার নিয়ে আমাদের বাসায় না আসে।
এরপর প্রায় একমাস কেটে গেল কিন্তু কোন বিচার আসলো না। মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম আর প্রতিজ্ঞা করলাম কোনদিন এসব প্রেম ভালবাসার চক্করে জড়াবো না। একদিন আম্মু আমাকে জিরা আনতে বিশ টাকার একটা নোট দিয়ে দোকানে পাঠালেন।কাকতালীয় ভাবেই নীলুর সাথে দেখা, স্কুল থেকে ফিরছে। কোনদিকে পালাবো সেটাই ভাবছিলাম। হঠাৎ নীলু আমাকে ডাক দিল
- শফিক ভাইয়া একটু এইদিকে আসেন
তো।
এখন আর পালানোর পথ নেই। কাছে যেতেই ব্যাগ থেকে নীল রঙের একটা খাম বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, আর মুচকি হাসি দিতে লাগলো।আমি কথা না বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে চলে আসলাম।
-আরে এটাতো আমারই দেওয়া সেই চিঠি!
কিন্তু না, চিঠিটা খুলে ভুল ভাঙল। খাম একই রকম হলেও এটা ভিন্ন চিঠি। চিঠির ভাষা ছিল এমন
শফিক ভাইয়া
সেদিনের পেয়ারা গাছের ভুতটা যে আপনি ছিলেন সেটা বুঝতে না পারায় ওমন চিৎকার করেছিলাম।অন্ধকারে সাদা টি শার্টে প্রথমে আপনাকে ভুত ভেবেছিলাম। ভাগ্যিস চিঠিটা বাবার হাতে পড়েনি, বাবা চিঠিটা পেলে সত্যি মহা কেলেংকারী হয়ে যেতো। ইদানীং আমার স্কুলে যাওয়া আসার পথেও আপনাকে দেখা যায় না আর আপনার রুমের জানালাটাও অনেকদিন ধরে খুলছেন না, এভাবে জানালা বন্ধ রাখলেতো জানালার কব্জাগুলোতে জং পড়ে যাবে। অনেক ভাল থাকবেন।
ইতি
নীলু।
চিঠিটা বুক পকেটে গুজে নিলাম। মনের ভিতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
আহা ! এটাতো সেই নীলু যার ভালবাসা পাওয়ার জন্য সারা পাড়ার ছেলেরা ব্যাকুল।
মনের ভিতর বেজে উঠলো নচীকেতার সেই বিখ্যাত গান
" সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা"।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১:৪৬