বিকাল ৫টা, হোটেল শেরাটনের ভিআইপি রোডের সিগনাল। সিএনজিতে অস্থির বসে আছি। ৬টাকা শেষ, ঘন ঘন মিটার দেখছি। আগের সিগনালে (কাকরাইল মোড়ে ৮টাকা) ওয়েটিং চার্জ গেছে। কমলাপুর থেকে যাচ্ছি কাওরান বাজার, ড্রাইভার বাদে আমরা ৪জন। এক জন বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। গল্প জমছেনা.. নগদ টাকায় ভ্যাপসা গরমে সিগনালের অপেক্ষায় বসে আছি। এই প্রতিদিনের সিগনাল অপেক্ষায় বসে থাকাদের নিয়ে কিছু পেশাজীবি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। হিলারী ক্লিনটন, ওবামা, রুশদি থেকে রবীন্দ্রনাথের বই হাতে কিশোর বিক্রেতা ছুটছে দামী গাড়িগুলোর দিকে, কয়েকজন ফুল বিক্রেতা শিশু-কিশোরী ছুটছে অপেক্ষারত যুগল দেখে দেখে। এইসব দেখতে দেখতে হঠাত আমার সিএনজির পাশে দেখি মাঝ বয়সী এক ভিক্ষুক, মাথায় তেরচা করে টুপি পরা। ডান হাত খানা পেতে ধরেছে। মুহুর্তে আপদমস্তক দেখে নিয়ে, একবার ওর চোখের দিকে আর একবার ওর পেতে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে ওর মতো করে আমিও হাত পেতে ধরলাম ওর দিকে। আমার হাতে দুই টাকার একটা নোট রেখে দিয়ে ও চুপচাপ হেটে চলে গেল।
এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ঘটল, একই ঘটনা। ভাবছি একটা ব্যংক একাউন্ট খুলব এই টাকা সংরক্ষণের জন্য। আপাতত টাকাগুলো আমার একটি মূল্যবান বইয়ের মধে জমিয়ে রাখছি। আশাকরছি আগামীতে আরো ইতিবাচক সাড়াপাব ওদের থেকে। কেউ এই প্রকল্পে যোগ দিতে চাইলে স্বাগতম....
ফ্লাশব্যাক:
২০০৭, ১/১১ পর। তত্বাবধাযক সরকারের আমল শুরু হয়েছে সদ্য। ফুটপাতের দোকান উঠিয়ে দেবার তোড়জোড় চলছে চারদিকে। দৈনিক বাংলা মোড়ের পাশে পেট্রল পাম্প, তারপাশে একটি ছাপড়া হোটেল, করিম মিঞা, মালিকের (যখন যেই সরকার ক্ষমতায়, তখন সেই দলের মাস্তান দের ৮ হাজার টাকা চান্দা দিয়ে) বাড়ি সুনাম গঞ্জ, সিলেট। মধ্যরাতে ক্ষিধে পেলে ওখানে মাছ ভাজা আর গরম তেল ছাড়া পরাটা পাওয়া যায়। এই লোভে প্রায়ই যাই। নিয়মিত এসময়ে ঐ ছাপড়া হোটেলে দুই জন হোটেল বয়, বুড়ো করিম চাচা আর এক কোনায় এক চোখ অণ্ধ, মাথায় নোংরা টুপি, পরনে একটি এককালের ঘিয়ে রঙের সুতির পাঞ্জাবী, একপা বেঞ্চের ওপর ওঠানো, পাশে একটি প্রায় দোমড়াননো ডিশ আর একটা তল্রা বাঁশের লাঠি রেখে, আয়েশি মেজাজে চা খেতে থাকা পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধকে দেখি। মাঝে মধ্বে এই বৃদ্ধের সাথে আরো একজন বৃদ্ধাকেও পাওয়া যায়, যার চেহারা ও বেশবাশ এই এক চোখা, ধুলোমলিন বৃদ্ধ থেকেও আরো একটু বেশি বিধ্বস্ত। প্রতিদদিনই ওদের আলোচনার মধ্য একটি ধারাবাহিক টাকার হিসাব উঠে আসে।
একদিন একটু বেশিই মনেযাগ দিলাম, কেননা ওদের নিয়মিত আলোচনায় আমিও মাঝে মধ্যে চায়ের আমন্ত্রন পেতে শুরু করেছি। একটি ড্যানিশ দুধের টিনে আনা চায়ের নিমন্ত্রণ ফেরানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। ঐ ধুলোমলিন বৃধ্ধর সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিকটি হচ্ছে.. তিনি সব বুঝে ফেলার মতো-বিজ্ঞের হাসি মুখে লাগিয়ে রাখেন সবসময়, যা তাঁর সকল মলিনতাকে অতিক্রম করে যায়। বৃদ্ধ কাল বাড়ি যাবেন, বাড়ি কিশোর গঞ্জ। ১৮ দিন হয় এবার বাড়ি থেকে এসেছেন। সাধারণত মাসের ১৮ / ২০দিন ঢাকায় থাকেন, শেষ সপ্তাহটা কাটিয়ে আসেন কিশোরগঞ্জ। তাই পাশের দোকান থেকে টাকা ধার করে, সমস্ত ক্যাশ ঝেড়ে ও আমার খাবারের বিল আগে আগে বুঝে নিয়ে যোগ করে ১১ হাজার ৭শত ৮০ টাকা করিম মিঞা বুঝিয়েদিলেন ঐ ধুলো মলিন, তল্লাবাশের লাঠি, তোবড়ানো ডিশ, নোংরা টুপি পাঞ্জাবী আর মুথে বিজ্ঞের হাসি ওয়ালা বুড়ো চাচাকে। তিনি টাকাটা কোমরে একটা নোংরা কাপড়ের মধ্যে পুরে, আমাদের কাছ থেক দোযা নিয়ে তিনি উঠে দাড়ালেন, (এই প্রথম বৃদ্ধকে দাঁড়াতে দেখলাম) অতপর: দীর্ঘাঙ্গী বৃদ্ধ বৃক টান টান ভঙ্গীতে (লাঠিটা বোগলে রেখে) হেঁটে চলে গেলেন হাঁসতে হাঁসতে...
করিম মিঞার কাছে জানতে চাইলাম কিসের টাকা দিলেন ? এরপর করিম মিঞা জানালেন, বৃদ্ধ এ মাসের ২ তারিখে ঢাকায় এসেছিলেন, প্রতিদিন ভিক্ষা শেষে রাত্রে খুচরা টাকা গুলো বিক্রি করেন করিম মিঞার কাছে। টাকাগুলো বিক্রি করে করে হিসাবসহ টাকাগুলো রেখে যান এবং বাড়ি যাোয়ার সময় সমুদয় অর্থ বুঝেনেন। থাকেন ফকিরাপুলের গরম পানির গলিতে একটি পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়ি ঘরে। ওখানে দারোয়ানকে থাকা ও অন্যান কিয়া-কর্ম বাবদ মাসে ২শত টাকা দেন। রাত্রে টাকা পয়সার হিসাব মেটাতে মেটাতে করিম মিঞার হোটেলে খেয়ে নেন। সবকিছু বাদ দিয়ে ২০দিনে তাঁর আয় তখন ১১৭৮০টাকা। তবে এই এক চোখা বৃদ্ধ থেকে ঐ মাঝে মধ্যে দেখা বৃদ্ধার আয় অনেক বেশি বলে জানালেন করিম মিঞা। আর এপথে আয়ের সূত্র হলো, আপনার শ্রী-চেহারা যত বিধ্বস্ত হবে আয় ততোই বেশি হবে। ........................
রাত অনেক হয়ছে, আর কথা না বাড়িয়ে ... শেষ সিগারেটটা টানতে টানতে ডেরায় ফিরলাম।
হঁঠাত নিজেকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। একটি প্রথম শ্রেনীর দৈনিকে তিনটি বিভাগ সম্পাদনার সুবাদে আমি সব মিলিয়ে পাই ১৪ হাজার টাকা। কয়েকটি নিয়মিত অনুবাদ কর্ম করে পাই আর ৫/৬ হাজার টাকা। ৩০ দিনে। এই আয়ের প্রস্তুতি হিসেবে বাবার একটি দামি কলেজ ও দেশের বাইরে একটি বিশ্ববিদ্যালেয় পড়ানোর খরচের নৈতিক মূল্যায়নের জন্য অনিয়মিত টাকা পাঠানো বাদ, ৪৫০০ টাকা বাড়ি ভাড়া + (স্টাটাস ব্যয়) ২টি দৈনিক সংবাদ পত্র ৫৪০ + একটি মুঠোফোনের ক্ষুধা মেটাতে ৫০০ টাকা + ইন্টারনেটের বিল ৭০০ টাকা
+ রিকশা ও সিএনিজ ভাড়া ২০০০টাকা + বন্ধু বান্ধব সম্পর্ক সংরক্ষণ, সামাজিকতা ১২০০ + একটি রিডার্স ডাইজেস্ট, ২টি দেশ পত্রিকা, কয়েকটি লিটল ম্রাগ, কিছু বই, ডিভিডি ১০০০ + ন্যুনতম মাথা পরিস্কার কারী ১ বোতল কেরু, ঢাকার বাইরে ভ্রমণ (যা সচ্ছন্দ মনে লেখা-জোকার জন্য অপরিহার্য)সহ বিস্তারিত ব্যয় ইত্যাদি... ইত্যাদি ... ইত্যাদি.... = ঐ এক চোখ অণ্ধ, মাথায় নোংরা টুপি, পরনে একটি এককালের ঘিয়ে রঙের সুতির পাঞ্জাবী, একপা বেঞ্চের ওপর ওঠানো, পাশে একটি প্রায় দোমড়াননো ডিশ আর একটা তল্রা বাঁশের লাঠি রেখে, আয়েশি মেজাজে চা খেতে থাকা পঞ্চাশোর্ধ সব বুঝে ফেলার মতো-বিজ্ঞের হাসি মুখে লাগিয়ে রাখা বৃদ্ধের ১৮ দিনের পরিশ্রম শেষে ষঞ্চয় ১১৮৭০ টাকা ... বৃদ্ধের ৩০দিনের আয়ের হিসাব করেত অনেক দিনের ঐকিক নিয়মের অংক না করে ঘুমানর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম.......

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



