আসেন, প্রথমে রেসলিং এর ভিতরের সত্য-মিথ্যা নিয়ে কিছু আলাপ করি। আমার ধারণা, আপনারা সকলেই জানেন, wwe তে মারামারি যা কিছু হয় সবই অভিনয়। আমি বেশির ভাগ পাবলিককেই দেখছি, যখনই শুনে ইগিন অভিনয়, তখনই রেসলিং এর প্রতি আগ্রহ-ভালবাসা যা ছিল সব উবে যায়।
ব্যাপার কিছুটা হাস্যকর।
আমি এটার প্রতিবাদ করছি।
আসলে আমরা কি দেখতে চাই বলেন তো? এরকম কিছু যে পেশিবহুল কতক মানুষ প্রাণপণে নিষ্ঠুরভাবে মারামারি করবে এবং কিছু রক্তারক্তি হবে...একটা দুইটা দাঁত ভাঙ্গবে... ভাগ্য বেশি খারাপ হলে কারো হাত-পাও ভাঙ্গতে পারে অসম্ভব কিছু নয়।
প্রফেশনাল রেসলিং আসলে এরকম নয়।
এবং এখানেই প্রচলিত কুস্তির সাথে wwe বা TNA এইসবের পার্থক্য।
প্রফেশনাল রেসলিং আসলে অনেকটা সিনেমার মত। এখানে সিনেমার মতই আছে স্টোরিলাইন, সাসপেন্স, ভায়োলেন্স, সেক্স(!) ইত্যাদি ইত্যাদি...।
যারা রেসলিংকে বাস্তবিকই রিয়েল মনে করে তাদের বলা হয় ‘মার্ক’।
বলতে দ্বিধা নেই ২০০৮ পর্যন্তও আমি যখন রেসলিং দেখতাম তখন কিঞ্চিত মার্ক আছিলাম একরকমে।
একটা কথা ক্লিয়ার করে নেই। প্রফেশনাল রেসলিং এর পরিভাষায় নায়কদের বলা হয় ‘ফেইস’ আর ভিলেনরা ‘হিল’। এখন থেকে আমরা তাদেরকে এই নামেই সম্বোধন করব।
বলতেছিলাম আমার অনুভূতির কথা।
২০০৭-০৮ এ এজ যখন দল-বল নিয়ে কাপুরুষের মত দাদুভাই আন্ডারটেকারকে ধরে পেটাতো তখন আমি এজ এর প্রতি যেই ঘৃণা অনুভব করতাম তার তুলনা নেই।
কত্ত বড় কাপুরুষ, হীন মন-মানসিকতার মানুষ চিন্তা করা যায়!
এই ঘৃণা ক্রমে ক্রমে বাড়তেই থাকলো...।
অবশেষে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড০৮ এ ঘৃণা উথলায় উঠল চরমে। ম্যাচের শর্ত ছিল যদি দাদুভাই হারে, তাইলে দাদুভাই সাসপেন্ড হবে।
http://www.youtube.com/watch?v=YkHiHeTJqT4
এজ মান্দারি পুরাই বাম হাতের সাহায্যে হারাল।
পাঁচ জন মিইল্লা।
দামড়া, বাট্টু স--ব।
এবং আর কি, আন্ডারটেকারের করুণ বিদায়।
এজ যখন দুই পা চেগায়া ‘ফ্যামিলির’ সাথে আলন্দ করতে আছিল, আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে গালি দিলাম তাকে, ‘ যা কুত্তার বাচ্ছা দূরে গিয়া মর!’
আমার এখনো মনে আছে, আমি সেই দিন সারা বিকাল ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিলাম। (দাদুভাইয়ের বয়স তখন মনেহয় ৪৩, আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম সে খেলা ছেড়ে দিচ্ছে। তার ম্যাচ আর দেখতে পাব না। এই দুঃখ কোথায় রাখি!)
তবে গুরুজী ভিন্স নানার লীলা বোঝা দায়!
দুই মাস পর ঠিকই দাদুভাই আসল।(ছুটি শেষ কইরা।)
সেটা সামারস্ল্যামএর মেইন ইভেন্ট।
প্রতিশোধ নেওয়ার ঠিক উপযুক্ত জায়গা।
http://www.youtube.com/watch?v=4ugQkeaWM4Q
আহা! সে কি ম্যাচ একখানা! (খাদ্যদ্রব্য হলে বলতাম স্বাদ মুখে লেগে আছে, এর ক্ষেত্রে বোধহয় বলতে হয় স্বাদ মনের চোখে লেগে আছে!)
যা হোক, সেটা একটা ম্যাচ, একটা কিংবদন্তির ম্যাচ, এবং এখনো আমার প্রিয় ম্যাচের তালিকায় তার স্থান উপরের দিকেই থাকবে।
তবে এর চেয়ে বড় ব্যাপার হল এই ম্যাচে এজের পিউর স্কিল আর অসাধারণ খেলা দেখে আমি তার ভক্ত বনে গেলাম।
আর তার চেয়েও বড়......
এই ম্যাচ আমার চোখ খুলে দিল।
আমি বুঝতে পারলাম রেসলিংটা আসলে অভিনয়। চমতকার অভিনয়। আমি হয়ে গেলাম রেসলিং বিশেষজ্ঞ। যেখানে যা পাই গুঁতাগুঁতি করি। সেইসময় বহুকিছু জানছিলাম রেসলিং সম্বন্ধে।
তারপর থেকে আমার খেলা দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরাই পালটে গেল।
আগে খেলা দেখতাম ফেইসদের জন্য ভালবাসা, আর হিলদের জন্য একবুক ঘৃণা নিয়ে।
এখন খেলা দেখি অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে, খেলোয়াড় পছন্দ করি তার অভিনয়ের দক্ষতার
উপর। হিল-ফেইস এখানে ফ্যাক্টর নয়।
এবং তখন আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় কে হয়ে উঠল জানেন?
শুনলে হাসবেন!
এজ!!!
আহা! সেই ২০০৮ এ সে যে কি দেখাইলো! এরকম অসাধারণ ভিলেন লাখে কয়টা হয়? প্রত্যেকটা পাবলিক তারে ঘৃণা করে!
এজ!
দ্যা রেটেড আর সুপারস্টার!
রিঙ্গে এজ মানেই তখন সেক্স, ভায়োলেন্স, আর অপূর্ব সব ম্যাচ!
আমি বিমোহিত!...
২০০৮ এ আরেকজন খুব আকর্ষণ করেছিল। সে হল রেন্ডি অর্টন। অর্টন ভাই তখন ইনজুরি থেকে ফিরছে (আরে কিয়ের ইনজুরি। ইনজুরি সত্যি ছিল, তবে আসল কথা ভাইসাব তখন নতুন বিবাহ করেছে। মধুর সময়!)
http://www.youtube.com/watch?v=Ki9o64sX_u8
যা হোক, রেন্ডি অর্টন রিঙ্গে এসেও ‘মধুর সময়’ কাটাইতে লাগল। মানে তখন সে তুমুল ভিলেন। ট্রিপল এইচের সাথে প্রতি ম্যাচে ফাটাইতে আছে। আমরা মুগ্ধ নয়নে গিলতে আছি!
কিন্তু তখনও আমি দোটানায় ছিলাম আমার ফেভারিট কে? এজ না অর্টন? ২০০৯ এ এজ মামা ইনজুরিতে পড়ার পর ফয়সালা হয়ে গেল।
অর্টন।
এই অসম্ভব সুদর্শন যুবকের মধ্যে অস্টিন কিংবা মাসুদ রানার মত দুর্ধর্ষ একটা ভাব আছে।
http://www.youtube.com/watch?v=juljME7UFjM
একটা সত্যি কথা স্বীকার করে নেই। আমি জন সিনার ভক্ত কখনই ছিলাম না। কারণ আমার কখনই মনে হয়নি সে রিঙ্গে তার পুরোটা দিচ্ছে! সে সবসময়ই একজন ফেইস, একজন মার্কামারা নায়ক, একজন সুপারম্যান(ছোটদের কাছে। আশির দশকে হাল্ক হোগান যা ছিল আরকি) এবং যথারীতি একঘেয়ে! তার প্রত্যেকটা ম্যাচই হত এইরকম-শুরুতে প্রতিপক্ষের হাতে উষ্ঠা পিটান...বেশ কিছুক্ষণ লেটকায়া থাকন...অতঃপর ওই ফ্লাইং শোল্ডার এটাক না কি জানি আর ফাইভ নাকল শাফল(ইউ ক্যান্ট সি মি!) তারপর আর কি, পিঠে উপর নিয়া ধরাম!
এই হইল রেগুলার সিনা ম্যাচ।
তারে পছন্দ করব কোন যুক্তিতে?
তবে একজন ফেইসের কথা বলতে হয়। একজন সত্যিকারের ফেইস। সে হল জেফ হার্ডি।
হালকা-পাতলা দুঃসাহসী একজন মানুষ। এই মানুষটা সারাজীবন মিড কার্ডেই থেকে গেল। তার লগের এজ, সিনা, অর্টনরা কত্তো উপরে উইঠা গেছে!
হার্ডি ভাই একা বইসা কানতে আছে।
২০০৮ এ হার্ডি ফাটাইলো!
একটা বোমা ফালাইয়া সে সবকিছু জয় করে ফেললো।
না, এটম বম্ব না, ‘সোয়ানটন বম্ব’!
http://www.youtube.com/watch?v=hoqBAooydUI
সেটা একটা সময় ছিল বটে। ২০০১-০২ এর পর সম্ভবত স্ম্যাকডাউনের শ্রেষ্ঠ সময়। বাচ্চারা হার্ডিকে দেখার জন্য পাগল। এরিনার যেদিকে তাকাই খালি হলুদ-সবুজ হাত!(হার্ডি হাতে কি জানি একটা পরতো রাঙ্গা কালারের)
সত্যি কথা বলতে কি, জেফ হার্ডির কপালটা খুব বেশি ভাল না। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে যখন উঠছে মাত্র, তখন ড্রাগের ফাঁদে পড়ল! (বেনোইট-গুয়েরেরোর মৃত্যুর পর wwe ড্রাগ বিষয়ে খুবই সিরিয়াস)
ব্যাস! খেল খতম!
হার্ডি বহিষ্কার!
মনে হয় ৬০ দিনের জন্য সাসপেন্ড ছিল।
কিন্তু রাগ কইরা সাসপেনশনের সময় ফুরাইলেও আর খেলতে আসে নাই ভাইজান।
তার ইতিহাস স্থগিত।
সিনা মামুরে একটু আগে পঁচাইছি।
তবে তার কাছে একটা কারণে আমি কৃতজ্ঞ।
আল্লা না করুক সিনা যদি পরের সপ্তাহে মারা যায়, এই বাংলাদেশে রেসলিং এর জনপ্রিয়তার যে মৃদু একটা শিখা টিমটিম করে জ্বলছে, সেটা একেবারে দপ করে নিভে যাবে! রকের পর জন সিনার মত পাবলিকের ভালবাসা(পড়েন ছোটদের এবং মার্কদের ভালবাসা) আর কে পাইছে?
সাধে কি আর এই হাফপেন্ট পরা লোকটারে ‘ফেইস অব wwe’ বলা হয়?
[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/tashfikal_1291889114_12-jc3.jpg
ডীর্ঘঝিভী হও সিনা!
আরো ভাল কিছু কর।
আমি জানি তার সেই সামর্থ্য আছে।
২০০৯ এ অর্টন বসের সাথে তার ম্যাচগুলা (বিশেষত ব্রেকিং পয়েন্টের ম্যাচটা), প্রত্যেক রেসলম্যানিয়ার ম্যাচ, আনফরগিভেন০৬ এ এজের সাথে, রয়াল রাম্বল ০৭ আর ০৮ এর ম্যাচগুলা, কিংবা এই তো সেদিন এর টেবিল ম্যাচটা- এগুলার জন্য হলেও জন সিনা ভাইয়ের কথা আমার শ্রদ্ধার সাথে মনে থাকবে সারাজীবন।
শেষ করার আগে কিছু বলি...
শন মাইকেলকে চিনেন?
৯৭ এ মনট্রিল স্ক্রুজবে এই লোকটাকে ব্যাবহার করা হয়েছিল।
এই লোকটা wwe এর সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।
এই লোকটার রেসলম্যানিয়া২৫ এর ম্যাচটা রেসলম্যানিয়ার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ম্যাচ।
আমি কি তখন এতকিছু জানি?
আমি তো জানি না।
২০০৮ এ বাতিস্তারে চোরামি কইরা হারাইল বুইড়া শন।
আমি তো লাফাইতে আছি! বাতিস্তা আমার পেয়ারের খেলোয়াড়, তোর যোগ্যতা আছে হেরে হারাইবি?
বুইড়া শন তখন চুপ।
কিছু কইল না।
তিন মাস পর নো মার্সিতে সে দেখাইয়া দিল কেন তারে শো স্টপার, মিঃ রেসলম্যানিয়া, মেইল ইভেন্ট লিজেন্ড ইত্যাদি ইত্যাদি বলা হয়!
আমি ক্ষেমা ছাইলাম গুরুর কাছে!
গুরু ক্ষমা করল না।
মনে বড় রাগ।
তাই ২০১০ এ আমগোরে কান্দাইয়া গুরু গেলগা খেলা ছাইড়া।
সেদিনের কথা মনে আছে? রেসলম্যানিয়ার পরের দিন। লাল শার্ট পিন্দা শন মাইকেল আসলো রিঙ্গে। আবেগে আপ্লুত পুরা রিং, টিভি স্ক্রীনের সামনে বসা মিলিয়ন মিলিয়ন দর্শক।
শন মাইকেল কি বলবে বুঝতে পারতেছে না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তেছে!
http://www.youtube.com/watch?v=J6MPg6_Jcjw
Click This Link
তারপরও অনেক কিছুই বলল। আমাগোরে পাক্কা বিশ মিনিট একদম নষ্টালজিক করে ফেলল।
আমি বহু কষ্ট কইরা পুরাটা শুনছি। শেষ দিয়া আর রাখতে পারলাম না। শন ভাই যখন শেষ বাক্যটা উচ্চারণ কইরা হাত নাইড়া রিং থেকে নামল......... আমার দুই চোখ দিয়া দরদর কইরা পানি পড়তে লাগল...।
এই রিঙ্গে শন মাইকেল আর কখনো পা রাখবে না।
বিশ্বাস করা যায়?
শোকটা আমার কাছে ছিল খুব প্রিয় কোন বন্ধু বা আত্মীয় মারা যাবার মত।
বাতিস্তা আর জেরিকো যাবার পরও একই অনুভূতি
তীক্ষ্ম এবং অসহনীয় একটা দুঃখ!
হঠাত হঠাত দম আটকে আসে।
কথাগুলো পইড়া বোধহয় হাসলেন?
হাসতে পারেন।
অসলেও তো, এটা একদম মিছা-মিছি অভিনয়।
এখানে কারো থোতা ছুইটা যায় না।
হাত-পাও ভাঙ্গে না।
সব চোরামি...
এই খেলায় এত আবেগের কি আছে?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




