স্কুলিয়া কাহানি
কত স্কুলে পড়লাম... কত কাহানি...
আজকে বলি আমার মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের এক কাহিনী।
আমাদের একটা গ্রুপ ছিল স্কুলে, ‘চন্দন পার্টি।’ এই গ্রুপে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছাড়াও কিছু ‘ফ্রেন্ডস অফ ফ্রেন্ডস’ও ছিল। আমরা ছিলাম মূলত ব্যাবসায়িক বন্ধু। অর্থাত পরীক্ষার সময় সবাই সবাইকে হেল্প-টেল্প করি এই রকমের। তো আমাদের নিজস্ব একটা গ্রুপও ছিল খুব ঘনিষ্ঠ ব্যাবসায়ী বন্ধুদের নিয়ে। সেটার নাম ‘দ্যা সিন্ডিকেট।’ যা হোক, চন্দন পার্টির এক কাহিনী বলি।
বছরের শেষ স্কুল কর্মদিবসে কি ‘র্যাগ ডে’ মত হয় না, আমরা ভাবলাম আমরাও নাহয় কিছু করি। চন্দন পার্টির মেম্বারদের সাথে আলোচনা করা হল। তারা রাজি হল, কিছু টাকাও আনল সবাই। গুনে দেখা গেল টাকার পরিমাণ খারাপ না একেবারে। ভাবলাম স্কুল ছুটি হলে পার্টির মেম্বাররা সবাই মিলে কিছু খাবো-দাবো। সেই মত স্কুলে হাজির হলাম। তো প্রথম পিরিয়ডে চন্দন পার্টির ফাইল মত একটা জিনিস বিলানো হল। সেখানে পার্টি মেম্বারদের নাম-ধাম, পজিশান আর যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের ঠিকানা দেওয়া আছে। তারপর পঁচা আলু জিয়ার ক্লাস। সে আসল। যথারীতি হনুমানের মত মুখ করে রোলকল করল। আমরা কথা-বার্তা বলছি। হঠাত শাওন(পার্টির স্বঘোষিত লিডার) আমাকে বললো, ‘দোস্ত, এই টাকাগুলা দিয়া আমরা না খায়া চল সবগুলা পোলাপাইনরে কিছু কিইন্যা খাওয়াইয়ে দেই।’ আমি তখন চারপাশের ভুখখা ছাত্রভাইদের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তাকে বললাম, ‘হ শাওন, আসলেও। এই টাকাগুলো দিয়া আমরা সবাইরে খাওয়াই, তাইলেই কিন্তু আসলে মজা হবে।’ দুজনে তখন একমত হলাম। নাকিবের সাথেও কথা বলা হল। সেও খুব মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘হ। হ। এইটা করলেই ভাল হইব।’ তখন আমরা শাওনকে পাঠাইলাম বিড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধতে! ‘সে কেমন লিডার দেখাইয়া দিক আজকে’- এইসব বলে-টলে পাঠানো হল যা হোক। তো সে গিয়ে পঁচা আলুকে বললো। আজব ব্যাপার পঁচা আলু তাকে অনুমতি দিয়েও দিল! এইটা দেখে তো নাকিব-টাকিব এরা খুব হইচই করে শাওনকে গিয়ে বললো- দোস চল নিচে যাই! সাথে সাথে দেখার আগে তিন-চারজন হুড়মুড় করে বের হয়ে গেল! আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না। এইসব কেনাকাটার ঝামেলা ওরা করুক। আমি নাহয় খাওয়া-দাওয়ার সময় থাকি! কিন্তু হঠাত ভাবলাম, লিডারি বলে তো একটা কথা আছে! তাছাড়া এই বালের ক্লাস না করে বাইরে একটু গুরে-গারে আসলেও তো হয়। তাই আমিও একটু লেটে বের হয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি পাঁচ-ছয় জন আসছে মোট! এত্ত লোক কেন আসলো? কিছু তো কমানো দরকার। কিন্তু প্রত্যেকে পার্টির মেম্বার। কিছু কইতেও পারি না আবার সইতেও পারি না। সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাইতেছি আর ভাবতেছি কেমনে একে কেমনে ওকে ভাগানো যায়। যা হোক, শেষে পিচ্চিকে ভাগানো হল। তার ডাক নাম ‘গাঞ্ঝুইট্টি।’ গেটের কাছে দারোয়ানের সামনে এসে তাকে বলা হল-‘গাঞ্ঝুইট্টি! যা তুই এখান থেকে ভাগ!’ দারোয়ানও তাকে ভাগায়া দিল। তো সে কিছু করতে না পেরে গেটের শিক ধরে খুব কাঁদো কাঁদো মুখ করে আমাদের গালি দিতে লাগলো! হের গালি শুনে কে? আমরা ততক্ষণে রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে দোকানের কাছে গিয়ে সবার খেয়াল হল, কি কিনব আসলে? কেক-টেক কিনার পয়সা নাই। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে আমাদের কাছে যেই পরিমাণ টাকা, তা দিয়ে ক্লাসের সবার জন্য মাথাপিছু দুইটা করে লেবেনচুস কেনা যেতে পারে! এখন উপায়? একজন পরামর্শ দিল-‘দুই টাকার নবেল্টু বিস্কুট কিনতে পার। খেতে খুবই মজা।’ তাকে ধমক দিয়ে চুপ করানো হল। বোঝা যাচ্ছে বিরাট বোকামি হয়ে গেছে! বিশাল মান-সম্মানের ব্যাপার। এখন আবার ক্লাসে গিয়ে টাকা চাইতে গেলে পোলাপান কি ভাববে? নাকিব তো গজগজ করে বলতে আছে-‘হ! আমি তো আগেই কইসিলাম এই টাকা দিয়া সবার হইব না। তখন তো শুনলো না!’ এখন কি এইসব বলে লাভ আছে? আসল কথা কাউকে খয়রাতি করতে যেতে হবে। ধুরো বাল আমি যাব না। পোলাপাইনের কাছে কি খয়রাতি করব নাকি? ঠিক করা হল শাওন, নভো আর ফার্স্ট বয় প্রান্ত যাবে। আমি, নাকিব আর শাহরিয়ার এখানে লেবেঞ্চুসের দোকানে অপেক্ষা করব। কথামত তারা চলে গেল। আমি ভাবলাম-‘বা! বেশ বাঁচা গেল!’ তখনও যদি জানতাম সামনে কি কাহানি অপেক্ষা করছে!
ওরা যাওয়ার পরপরই নাকিব বকবক শুরু করল। আমরা ভাবলাম কিছু খাওয়া দরকার। খোঁজ করতেই কি আশ্চর্যের বিষয় লেবেঞ্চুসের দোকানে সেভেন আপও পাওয়া যায়! শাহরিয়ার ভাইসাহেবের টাকায় একটা সেভেন আপ কিনে খেলাম সবাই। তারপর আবার দাঁড়ায়ে থাকন। দশ-পনের মিনিট এভাবে অপেক্ষা করার পর হঠাত সবাই বুঝে ফেললাম কোথাও কোন ঝামেলা আছে। দান-খয়রাতি করে শাওনদের ফিরতে এত সময় লাগার কথা না। মনে হয় পঁচা আলু তাদের আটকায়ে দিছে। দ্বিতীয়বার বাহির হতে দেয় নাই। এখন আমরা কি করি? বেলাজের মত ক্লাসে ফেরত যাব? প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু সমস্যা হল এইটা স্কুলের এলাকা। বেশিক্ষণ দোকানে দাঁড়ায়ে থাকলে কোন টিচার দেখে ফেলতে পারে। স্কুলের আইন-কানুন এখন খুব কড়া। কারণ দুই আগে কিছু বখাটে পোলাপাইন বাথরুমের ট্যাপ খুলে নিয়ে গেছে। এখন বলা যায় না আবুল মামা টাইপের কোন টিচারের হাতে ধরা খেলে টিসি পর্যন্ত খেয়ে যেতে পারি! হায় আল্লাহ! বছরের শেষ ক্লাসে এ কি বিপদে ফেললা! নাকিব তো শাওন আর প্রান্তকে সমানে গাইল্লাইতে আছে। সে বলতেছে-‘হ! আমাদেরকে ফালায়া ওই দুই বান্দরতো ভাগছে! অখন আমি কি করি!’ আমি দোকানের মালপত্রের পেছনে লুকানোর চিন্তা-ভাবনা করলাম। তবে লেবেঞ্চুসওয়ালা বেটা দিল না লুকাতে। সে বেশ বিরক্ত হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে! আমরা অন্য দোকানে ঢুকলাম। শাহরিয়ার সাহেবের পরিচিত দোকান। সেখানে বসে আমরা নিবিষ্ট মনে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম কি করনীয়। ক্লাসে তো ঢোকা যাবে না। এখানেও বসে থাকলে ধরা খাবার সম্ভাবনা ৮০%। তাহলে পালানো যেতে পারে। মনে কর শান্তিনগর বা কাকরাইল কোথাও চলে গেলে কোন শালার বেটা ধরবে আমাদেরকে? এসব ভেবে আমরা কোথায় যাব মনস্থির না করেই তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলাম। বিরাট রিস্কের ব্যাপার। চুপে চুপে হাঁটতে আছি। পীরসাহেবের গলির কাছে এসে হঠাত খেয়াল হল আয় হায় ঝামেলা তো শেষ হয় নাই! হয়তো জিয়া পঁচা আলু বসে বসে অপেক্ষা করতেছে কখন আমরা আসব! নাম-টাম কেটে দেওয়ার ব্যাপার আছে। আজকে আবার পরিক্ষার প্রবেশপত্র দেওয়ার কথা। আল্লা জানে এতক্ষণে সেটা দিয়ে দেওয়া হইছে কিনা! আমারও মনে হল আসলেও তো আমরা ভুল কাজ করতেছি এভাবে কি বাঁচা যাবে? আমি সবাইকে বললাম-‘চলো ক্লাসে যাই যা হওয়ার হবে। মিথ্যা কথা বলে যেমন টেকা যায় না আমরাও এভাবে মিথ্যা কাজ করলে তো ধরা খেতেই হবে।’
তখন সবাই ফিরতি হাঁটা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করা হল ক্লাসে গিয়ে সবার আগে শাওনের পাছায় কষে একটা লাথ মারা হবে। তিনজন পালাক্রমে। কিন্তু আগে তো পৌঁছাই! কলোনীর ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সবার বুক কাঁপতেছে। আল্লাহ জানেন কোথায় কোন দাড়িওয়ালা টিচার খাড়ায়ে আছে! নাকিব তো বকবক চালাইতেই আছে-‘আল্লা আমার কি হবে! আল্লা আমার আব্বু দেখলে কি ভাববে!’ (নাকিবের বাবা এ স্কুলের টিচার) আমি বললাম-‘এগুলা বলে লাভ কি। এখন কি করার সেইটা ভাব।’ অবশ্য আমার নিজেরও খুব ভয় লাগতেছে। সারা বছর এত গুডি বয় ইমেজ, এখন ঠিক এই শেষ দিনে এমন হাঙ্গামায় পড়ব এটা ঠিক মানতে পারতেছিলামনা। শাহরিয়ারও একে ওকে দেখে চমকায়া উঠতেছে। সবাইকে মনে হচ্ছে টিচার। কিন্তু আনন্দের ব্যাপার পথে কিছু হল না। আমরা নিরাপদে গেটে পৌঁছলাম। গেটের কাছে গিয়ে শুনি বাচ্চাদের কোলাহল! আরে কি ব্যাপার! সব ছাত্রভাই নিচে? একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমরা যাওয়ার একটু পরই নাকি কাশেম স্যার এসে বলছে ছেলেরা যাও সবাই টাকা তুলে খানা-পিনা কর!
এখন তারপর ক্লাসে গেলাম। শাওনের উপর মেজাজটা খারাপ হলেও বুঝলাম ওর তো কিছু করার ছিল না। তো আর কি, চুপচাপ বসে থাকলাম। ফাকভাই(ওমর ফারুক) এর সাথে কিছু গল্প-স্বল্প হল। তারপর বিভিন্ন ঘুঞ্জাঘুঞ্ঝির মাঝে ছাত্রভাইদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করলাম। কত চেনা অচেনা সাথীভাই! মিষ্টি বিক্রেতা সাঁথিলের সাথে কথা হল সে কবে আমাদের মিষ্টি খাওয়াবে। সে বললো আগে বিয়ে করে নিক তারপরে। আরো অনেকের সাথে কোলাকুলি করলাম। অবশেষে লেডিস ক্লাবের চেয়ারম্যান ‘বিশিষ্ট পরহেজগার বান্দা’ সৈকত ভাইসাহেবের সাথে মুসাফাহা করার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের অশেষ নেকি হাসিল করলাম।
ক্লাসের খানাপিনাতেও শাওন ক্যাশিয়ারের গুরুদায়িত্ব পালন করল। সব টাকা তার কাছে। কয় হাজার কত জানি। টিফিন টাইমে সেই টাকার সিংহভাগ দিয়ে বেশির ভাগ পোলাপানকে খাওয়ানো হল। কি খাবার সেটা বলে লজ্জা দিতে চাই না। গরিব স্কুলের গরিবী খাবার। তবে ছাত্ররা এই সামান্য খাবার অত্যন্ত আহলাদের সাথে খেল। আমি শাওনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে ভাই, আমাদের খাবার টাকা আছে তো?’ সে মিচমিচে হেসে প্যান্টের ফোলা পকেট দেখিয়ে বললো, ‘হ দোস্ত আটশ টাকা আছে, ছুটির পরে চন্দন পার্টির সবাই খামু!’
বিরাট আনন্দ। শেষ পিরিয়ডে ছাত্রদের গুডবুকে আছেন এমন সৌভাগ্যবান কিছু স্যারের সাথে ছবি তুললাম সবাই। অনেক ছেলেই ক্যামেরা আনছে দেখা গেল। আমি ছবি তুললাম গাঞ্ঝুইট্টির ক্যামেরায়! তারপর আর কি, ছুটি হয়ে গেল। পোলাপান হো হো করতে করতে নামল। বিরাট আলন্দ!
এখন ছুটির পরে পার্টির সবাই ফুটপাতে একত্রিত হয়ে ভাবলাম কি খাব আমরা? আটশ টাকা আট-দশজনের জন্য খুব বেশি কিছু নয়। সমস্যা হল কেউ কিছু বলতে পারছে না। নভো বড়লোকের ছেলে ফাস্টফুড খায়। সে খুব উতসাহ নিয়ে বললো-‘দোস্ত চল একটা পিতজা কিইন্যা সবাই এক কামড় কইরা খাই!’ তার মতামত ধোপে টিকল না। শালা একটা ‘চাঘা’(ছাগল) বোঝা গেল। এখন সবাই ঠোঁট কামড়াইয়া ফাটায়ে ফেলতেছে দেখে আমি বললাম, ‘আচ্ছা আমি একটা মতামত দেই। চল আমরা ওই পরোটা মাংস কি কি আছে না চল ওগুলা খাই। আফটার অল এটা জাস্ট আমার মতামত কারণ কেউ তো কিছু বলতে পারতেছে না। এখন খাওয়া তো হবে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সবার পছন্দ হলেই খাওয়া হবে নাইলে অন্য কিছু...’
কেউ এটা সাপোর্ট করতেছে না বোঝা গেল। সবাই সজোরে ঠোঁট কামড়াচ্ছে! কিন্তু কি করা। এর চেয়ে ভাল কিছু বের হল না। অতএব সামনে একটা পুপলা হাউস মত দোকান দেখে ঢুকলাম। ভিতরে পাতি কাবাব, চিকি কাবাব ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই হাত-মুখ ধৌত করে টেবিলে বসলাম। খানার আইটেম সামান্য। কি এক জাতের কাবাব-পরোটা আর সাথে একটা দুই লিটারের সেভেন আপ। পুপলা হাউসের খাবার পরিবেশন পদ্ধতি হিন্দুয়ানি স্টাইলে। বিরাট বড় কাঁসার থালা তার মাঝে বিভিন্ন খোপে আমাদের খাবার। দেখা গেল কাবাবের খোপ সবচেয়ে ছোট! যাহোক খাবার মোটামুটি ভালই হল। ফাস্টফুড নভো কিঞ্চিত অসন্তুষ্ট স্বরে বললো-‘হোহ কি খাবারই না খেলাম!’
আসলে খাবার কত উন্নত কত দামি সেটা কিন্তু বিষয় না, এতগুলা বন্ধু একসাথে আনন্দ করে খেলাম এইখানেই তো আসল পরিতৃপ্তি!
যা হোক অবশেষে একশ টাকা বাঁচছে, সেটা দিয়ে সবার হাতে ইগলুর বাটি কাপ আইসক্রিম ধরায় দেয়া হল। তারপর আর কি, রিকশায় বসে সেটা খেতে খেতে বাসায় ফিরলাম।
আমার কথাটি ফুরাল,
নটে গাছটি মুড়াল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




