somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যক্তিগত কাসুন্দিঃ হোস্টেল-২য় পর্ব

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই ঘটনার পর একদিন বিকেলে হোস্টেল সুপারের ঘরে আমার ডাক পড়ল। ফাহমিদা আপা আমাকে দেখেই বললেন,
-আছো কেমন তুমি, পায়েল?
আপা কখনো ‘তুমি কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করতে পারতেন না। শব্দগুলো উল্টাপাল্টা করে বলতেন। সবার সাথেই এভাবে বলতেন। মনে হত কাছের কোন আত্মীয়ের সাথে কথা বলছেন। আর তিনি তেমন রাগও দেখাতে পারতেন না। তবু মেয়েরা কেন জানি আপাকে খুব একটা পছন্দ করত না। উনার বিদায় অনুষ্ঠানের দিন অবশ্য উনার পেছনে ফুসুর ফুসুর করা মেয়েরাই বিদায়ী বক্তব্য পেশ করে বলেছিল, ‘ফাহমিদা আপা আমাদের মায়ের মতোই আদর-শাসন করেছেন। আমরা উনাকে ভালোবাসি।’ বলতে বলতে কেঁদেও ফেলেছিল। তবে আপা যে সত্যি সত্যিই ভালো ছিলেন সেটা সবাই বুঝতে পেরেছিল পরের হোস্টেল সুপার আসার পর। সেই ম্যাডামের নাম আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তিনি উচ্চতায় ছোট-খাটো ছিলেন, আর বদ মেজাজের দিক থেকে বড় মাপের ছিলেন। সবাই বলাবলি করল-‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ-এটাই সত্য।’ যাক গে, ফাহমিদা আপার কাছে ফিরে যাই।

আমি বললাম,
- আছি ভালো আমি, আপা।
উল্টো প্রশ্নের উল্টো উত্তর দিলাম। আপা সেটাকে কেয়ার করলেন না। সরাসরি গৌরচন্দ্রিকা থেকে বর্ণনায় চলে গেলেন এবং খুব দ্রুত উপসংহার টানলেন।
-তুমি নাকি সব মেয়েকে ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছ? এটা কি সত্য?
-আংশিক সত্য।
-সেটা কী রকম?
-সবাইকে দেখাই নি। মজা করে কয়েকজনকে দেখিয়েছি। সরি আপা।
-তুমি কি জানো, ভীত ব্যক্তি মেন্টালি সিক হয়ে পড়তে পারে?
আমি নিরুত্তর রইলাম।
-তোমার বন্ধু আঁখি অভিযোগ করেছে, তোমার জন্য তার অসুবিধা হচ্ছে। সে তোমার সাথে আর থাকতে চায় না।
আমি কিছু বললাম না। আপা বললেন,
-লাবনীদের রুমে একটা সিট খালি হবে। তুমি ঐটায় উঠে যাও।
-জ্বী, আপা।

আঁখির শাসন আমার কাছে যন্ত্রণার মতো লাগত। তাই মুক্তি পেয়ে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। চোখ মুছতে মুছতে রুমে ফিরে এলাম। আমি খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। সহজে হাসি, সহজে কাঁদি। যারা সহজে কাঁদে তাদের কান্না কেউ দেখেও দেখে না। দুঃখ, হতাশা, বন্ধুত্ব, ভালবাসা-যে কারনেই তারা কাঁদুক, সেটার কোন মূল্যায়ন হয় না। আঁখি আমার চোখের পানির তোয়াক্কা না করেই বলল,
-দেখ, আমি আর তোর সাথে থাকতে চাই না।
-আমি তোর অসুবিধাটা কীভাবে করলাম?
-তুই আড্ডা দিলে আমারও আড্ডা দিতে ইচ্ছা করে। মাস শেষে কতগুলো গল্পের বই কিনে নিয়ে আসিস। আমারও টেক্সট বই ফেলে সেগুলো পড়তে ইচ্ছা করে। তাছাড়া তুই পড়াশোনা করিস না। তোর দেখাদেখি আমারও পড়তে ইচ্ছা হয় না।
এরপর আর কিছু বলা যায় না। আমি নীরবে লেপ-তোষক গুটিয়ে ৪০৩ নম্বর রুমে উঠে এলাম। এরপরেও আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই থাকল। এক সাথে ঘুরি, খাই, মজা করি, টিভি দেখি। শুধু বুকের ভেতর কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস আটকা পড়ে রইল, একেবারে শৈশবের বন্ধু তো। তবু আমি আমার সেই দীর্ঘশ্বাসকে দ্বন্দে পরিণত হতে দিই নি। কেননা- আমার জন্য ওর রেজাল্ট খারাপ হবে এটা মানা যায় না।

৪০৩ নম্বর রুমে থাকে অনুপমা হাওলাদার, লাবনী দেবনাথ আর ববি সাহা। অনুপমা ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির বই সামনে রেখে কবিতা লেখে। একটা আয়নাও সব সময় সামনেই থাকে। কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে আয়না দেখে। যেন আয়নায় কবিতার লাইনগুলো দেখতে পাচ্ছে। মাঝে মাঝে চিরুনি চালিয়ে মাথা থেকে উকুন বের করে। উকুনগুলোকে আবার না মেরে একটা শিশিতে ভরে ফেলে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-উকুন না মেরে শিশিতে ভরার কি কোন যুক্তি আছে?
-না। উকুন এইভাবে কতক্ষণ টিকে থাকে দেখতে চাই।
-আর সামনে আয়না থাকে কেন?
-আয়না থাকলে কবিতা আসে।
-আজব তো! আয়নার সাথে কবিতার সম্পর্কটা কী?
-সম্পর্ক বুঝতে হলে ববির কাছে যেতে হবে।

ববির সাথে কথা বলেই অনুপমার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর যে বিষয়েই কথা হোক না কেন, সেটার সাথে তার বিশ্বজিৎ এসে পড়বেই। দিনে বিশ্বজিৎ দা’র নাম যত বার নেয়, ততোবার রাধা-কৃষ্ণের নামও নেয় না। দারুন অথবা নিদারুন প্রেম!

লাবনী খুব ভালো মেয়ে। সে যে কোন কিছুতে সিরিয়াসনেস দেখায়। সিরিয়াস না হলেও যে সিরিয়াসনেস দেখানো যায় সেটা তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বলবিদ্যার বই খুলে হুমায়ূন আহমেদ আর সমরেশ মজুমদার পড়ে। হোস্টেল সুপার আসার খবর পেলেই বলবিদ্যা ওপরে চলে আসে, হুমায়ুন-সমরেশ নিচে চলে যায়। গল্প করছে হয়তো, এর মধ্যেই চিন্তা করবে টিওটোরিয়াল পরীক্ষার পড়া রেডী হয়নি এখনো। তারপর বলবে, গল্পটা শেষ করেই পড়তে যেতে হবে।

অনুপমা আর ববি আবার গানের শিল্পী। তাছাড়া আমার ভূতের গল্পের খুব ভক্ত ওরা। আবার আমি যা লিখি তাই আগ্রহ করে পড়ে। আমার সেইসব অখাদ্য-কুখাদ্যের প্রথম মুগ্ধ পাঠক ওরা। তখন ফেসবুক-ব্লগ কিছুই ছিল না আমাদের। কিন্তু জীবন কতই না আনন্দের ছিল। সারা রাত গান-গপ্পো আর হাসি-ঠাট্টায় কেটে যেত। সকালে হয় ক্লাসে যেতাম না, না হয় ক্লাসে গিয়েই ঘুমুতাম। খেতে ইচ্ছে করলে খেতাম, ইচ্ছে না হলে খেতাম না। শাসন করার জন্য আঁখি ছিল না। তাই ডাইনিং হল-এ কম যেতাম। বাকীরাও আমার মতো। রাতে খিদে লাগলে মুচ মুচ করে চানাচুর-মুড়ি অথবা বিস্কুট চিবুতাম। ববি শেখাল কীভাবে চা দিয়ে চানাচুর খেতে হয়। একদিন লাবনীকে বললাম,
-লাবু, ববিটা কী অদ্ভুত! চা দিয়ে চানাচুর খায়।
লাবনী বলল,
-খাইলেই বুঝতি কতো মজা।
অনুপমাকে বললাম,
-অনু, লাবু আর ববি কী বলে জানিস? চানাচুর আর চা নাকি একসাথে মজা।
অনুপমা বলল,
-চানাচুর তো খেতেই হয় চায়ে ভিজিয়ে।
-তুই কি সিঙ্গাড়া আর সমুচাও চায়ে ভিজিয়ে খাস?
-তা খাই না।
যেদিন আমাদের প্রাইভেট পড়া থাকত না, সেদিনও আমরা বাইরে যেতাম। ব্যাগ নিয়ে বেরুতাম। হোস্টেলে বন্দী থাকতে ভালো লাগত না। আমরা বেশিরভাগ সময় হাঁটতে বের হতাম। শুধু হাঁটা। কলেজের পাশের রেল লাইন ধরে, কিংবা আবাসিক এলাকাগুলোর অলিগলি ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতাম। আমি আর লাবু একদিন হাঁটতে হাঁটতে পথ হারিয়ে ফেললাম। দুই তিনটা রাস্তা দিয়ে চেষ্টা করেও কলেজে পৌঁছাতে পারছি না। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল। আমরা তখনো হাঁটছি। সন্ধ্যার পর হোস্টেলের বাইরে থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আমাদের পা হঠাৎ থমকে গেল। পুরো জায়গাটাই একটা ধ্বংসস্তূপ। আর আশেপাশে একটা মানুষ পর্যন্ত নেই। আমার গা ছমছম করে উঠল। আশেপাশে আবার বাজে ছেলে-ছোকরা থাকে যদি। সেদিন কীভাবে রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলাম সেটা লম্বা গল্প। তবে পরে জানতে পেরেছি, ঐ ধ্বংসস্তূপটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার। পাকিস্তানীরা এলাকাটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। সেটা ওভাবে অবিকৃত রেখে দেয়া হয়েছে নাকি।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি অসুস্থ্য হয়ে পড়লাম। আমার রুমমেট বন্ধুরা অস্থির হয়ে পড়ল। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। বুকে ব্যথা হচ্ছিল। আর ব্যথাটা আস্তে আস্তে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। ববি পাশের রুম থেকে একটা মুসলমান মেয়েকে ধরে নিয়ে আসল কোরআন শরীফ পড়ে আমাকে ফুঁ দেয়ার জন্য। অনুপমা পানি ঢালল মাথায়। লাবনী আমার কাছ থেকে ইচ্ছা করেই স্মরণশক্তির একটা দুয়া মুখস্থ করেছিল-“রাব্বী জিদনি ইলমা”। দুয়াটা ও পরীক্ষার সময় পড়ত। কেন পড়ত জানি না। হয়তো ওর আত্মবিশ্বাস থাকত। সে ঐ দুয়াটা পড়েই ক্রমাগত আমাকে ফুঁ দিতে লাগল। হোস্টেল সুপারের কাছে খবর গেল। এ্যাম্বুলেন্স আসল। হাসপাতালে আমাকে অক্সিজেন মাস্ক পরানো হল। তখন আমার কষ্ট কিছুটা কমল। কিন্তু বার বার চোখ ভিজে উঠছিল ওদের এই মানবিকতা আর আন্তরিকতায়।

এখনকার ঐ বয়েসী ছেলে-মেয়েরাই দেখি ধর্ম নিয়ে কতো ক্রেজি। অথচ জাত-পাত আর ধর্মের ঊর্ধের যে মানুষ পরিচয়টা মানুষের আছে সেটাই সবচে মধুর। মানুষের কাছে না গেলে জানা যায় না কে কতটা সুন্দর। হোস্টেল জীবন কিন্তু আমাকে সেই সৌন্দর্য দেখিয়েছিল। আজও শত অবিশ্বাস আর দ্বিধার ভীড়ে সেই দিনগুলোই বেশি মনে পড়ে। কতো সহজ আর সুন্দর জীবন ছিল সেটা। আহা!

১ম পর্ব দেখতে হলে-
Click This Link
৩য় পর্ব দেখতে হলে-
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:১০
১২টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×