somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গুজরাটে নির্মিত সূর্য মন্দিরের ইতিহাস

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সূর্য মন্দির সূর্যের উদ্দেশ্যে ১০২৬ সালে সোলাঙ্কি রাজত্ব কালে গুজরাটে নির্মিত একটি মন্দির। এটি আহমেদাবাদ থেকে প্রায় ১০২ কিলোমিটার দূরে পুষ্পবতী নদীর তীরে অবস্থিত। বর্তমানে মন্দিরটি উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হয় না বরং এটি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আছে। সম্পূর্ণ মন্দিরের বিভিন্ন নকশা,কারুকাজ এবং স্থ্যাপত্যের মাঝে বিভিন্ন গানিতিক সংখ্যা,জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের তাৎপর্যপূর্ণ সৌন্দর্য পরিপূর্ণ রয়েছে।


ব্রহ্ম পুরানোর মতে শ্রী রামচন্দ্র শ্রীলঙ্কা বিজয়ের পর ঋষি বশিষ্ঠের নিকট ব্রাহ্মণ অর্থাৎ রাবণকে হত্যার জন্য নিজেকে শুদ্ধ করতে তীর্থ যাত্রা করতে চান। ঋষি বশিষ্ঠ তাকে ধর্মারন্যে গিয়ে যোগ সাধনা করতে বলেন। এই ধর্মারন্যকে বর্তমানের মধেরা বলে ধারনা করা হয়। শ্রী রাম এখানে সীতা পুর নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন।১০২৬ সালে সোলাঙ্কি রাজা ভীমদেব ১ সূর্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরটি প্রথম ধ্বংস করার চেষ্টা করেন আলাউদ্দিন খিলজি।ধ্বংসের আগে এখানে গণেশ, শীতলা, বিষ্ণু, কালীর এবং নটরাজের মন্দির ছিল। মোট মন্দিরের সংখ্যা ছিল ১০৮টি। সেগুলো সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ধ্বংস করে দেন।যদিও ধ্বংস এবং ক্ষতি সাধনের পরও যা অবশিষ্ট আছে মন্দিরের বিশেষত্ব ও তাৎপর্য বোঝানর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। মন্দিরটি এমন ডিজাইনে তৈরি যা সে সময়ে ভারতবর্ষের জ্যোতিষশাস্ত্র, সংখ্যাতত্ত্ব, ইত্যাদির জ্ঞান কোন পর্যায় ছিল মন্দিরের স্থাপত্যকলা থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সূর্য যখন বিষুবীয় সময়ে পৌছায় তখন সূর্যের প্রথম রশ্মি মন্দিরে স্থাপিত একটি সূর্যের ছবির উপর পড়ত।

মন্দিরের ছিল তিনটি প্রধান অংশঃ সূর্য কুণ্ড,সভা মণ্ডপ ও গুরা মণ্ডপ। জলাধারের কেন্দ্রে পৌছাতে চারটি দেয়াল পার হতে হয়।ছোট পিরামিড আকৃতির ধাপ দিয়ে এই দেয়াল গুলো সর্জিত।বিভিন্ন দেব দেবীর ভাস্কর্য দিয়ে এই দেয়াল গুলোর গায়ের পাথরে খোদাইকৃত ভাবে সর্জিত করা। সোলাঙ্কি রাজত্ব কালে ভগবান বিষ্ণু ও শিব এবং দেবী শীতলমাতার বিস্ময়কর সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি হয়েছিল।সভা মণ্ডপের প্রবেশ পথে দুটি কারুকার্যময় তোড়ন আকৃতির খিলান রয়েছে।

মন্দিরটি প্রায় ৫৩.৬X৩৬.৬ মিটার যা সভা মণ্ডপের পূর্বমুখী ভাবে অবস্থিত। এখানে পবিত্র জল রাখা হত যেখানে ভক্তরা সূর্যদেব কে পূজার আগে অবগাহন করত।সূর্য মণ্ডপ তৎকালীন ভারতীয়দের জ্যামিতিক আর গানিতিক উৎকর্ষতার এক অনন্য নিদর্শন।এর চারিপাশ এর কম্পোজিশন করা ড্যাজলিং প্যাটার্নে । এটি অসংখ্য পাথরের তৈরি সিঁড়ি তে উপরে ওঠার পথ রয়েছে যাতে খুব সহজে ভক্তরা নিচে নামতে এবং ওপরে যেতে পারত। এই সিঁড়ি গাত্রে ১০৮ টি কুঠি তৈরি আছে।


সভা মণ্ডপটি তৈরি হয়েছিল ভক্তদের সমাবেশের জন্য।সভা মণ্ডপটির সব দিক দিয়ে খোলা।সভা মণ্ডপটি ৫২ টি অতি জটিল এবং দুর্বোধ্য কারুকাজময় নকশা খোদাইকৃত খিলান দিয়ে ভিত দেওয়া রয়েছে।এখানে ৫২ টি খিলান ব্যবহারের করা হয়েছে সৌর বছরের ৫২ টি সপ্তাহ বোঝানর জন্য।খিলান গুলোতে বিভিন্ন নকশার পাশাপাশি রামায়ণ, মহাভারত ও শ্রীকৃষ্ণ লীলা থেকে বিভিন্ন কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সভা মণ্ডপ এবং মন্দিরের মাঝে একটি সুন্দর হল ঘর রয়েছে যা আকর্ষণীয় পিলার এবং খিলানে নির্মিত।এর সম্মুখ ভাগ ধ্বংস করে ফেলা হয় যার অংশ বিশেষ পরবর্তীকালে পুনঃনির্মাণ করা হয়।দেয়ালে ১২ টি কুলঙ্গি রয়েছে যেখানে সূর্যের ১২ টি রূপ তুলে ধরা হয়েছে।এখানে ১২ সঙ্খ্যার তাৎপর্য হল সৌর বছর ১২ টি মাসের সমন্বয়ে পূর্ণটা বোঝানোর জন্য।


পদ্ম ফুল সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফোটে আর সূর্যাস্তের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য পদ্ম ফুলকে বলা হয় সৌর ফুল। মন্দিরটি সম্পূর্ণ একটি উল্টো পদ্ম ফুলের স্তম্ভমুলের চতুষ্কোণ পীঠিকাবিশেষের উপর স্থাপিত। এটি এমন ভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যেন প্রতি ২১শে জুন সূর্য যখন উদিত হবে এবং অস্ত যাবে তখন আলোক রশ্মি রথে পরিভ্রমণ রত সূর্যদেবের উপর পড়বে । ২১শে জুন হল সূর্যের অয়তান্ত – বিন্দু বা নিরক্ষরেখা থেকে সূর্যের দূরতম অবস্থান কাল।২১শে জুন সূর্যের গ্রীষ্মকালীন অয়ন্তন বিন্দু আর বিষুব হলো বছরের এমন একটি সময়, যখন দিন এবং রাত্রির দৈর্ঘ্য সমান হয়ে থাকে।বছরের দুটি দিন এরকম হয়। সেই দিন গুলিতে সূর্য বিষুব রেখা বরাবর অবস্থান করে। দিন দুইটি হলো -জলবিষুব / শারদীয় বিষুব - ২৩শে সেপ্টেম্বর,মহাবিষুব / বসন্ত বিষুব হল ২০শে মার্চ ।


রথের সারথি হিসেবে রয়েছেন অরুন এবং সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি ছিল অতি মুল্যবান রত্নখচিত।সূর্যের রথটি ৭ টি ঘোড়া সম্বলিত যা সপ্তাহের সাত দিনকে নির্দেশ করে এবং সারথি অরুন চতুর্থ ঘোড়ায় উপবিষ্ট।সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি একদম খাটি সোনার তৈরি ছিল। স্বর্ণ ভাস্কর্যটি একটি কূপ বা গহ্বরের উপর স্থাপিত যা ১৫ ফুট গভীর ছিল। সম্পূর্ণ গহ্বরটি স্বর্ণ মুদ্রায় পূর্ণ ছিল যা সোলাঙ্কি রাজারা তাদের বংশানুক্রমিক পুজ্য দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলেন।ইহিহাসবিধদের মতে সেগুলো মাহমুদ গজনী লুট করেন এবং সম্পূর্ণ স্বর্ণমুদ্রা সহ ভাস্কর্যটি নিয়ে যায়।


মন্দিরের বাইরের দেয়ালে সূর্যকে ১২ টি ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি দেখানো হয়েছে আর তার সাথে আছে ৮ টি দিক বা ৮জন দিকপাল। আরও আছে বিশ্বকর্মা যিনি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের স্বর্ণের দ্বারকা নগরী তৈরি করে দেন,সিদ্ধিদাতা গনেশ,শিক্ষা এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতী মাতা। তাছাড়াও রয়েছে সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য।


ভারতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শন যেমন বৌদ্ধ, জৈনদের মত সোলাঙ্কি রাজাদের নির্মিত এই সূর্য মন্দিরের বিভিন্ন অংশের শিল্পকলাতেও যৌনআবেদন মুলক বিভিন্ন মোটিফের দেখা পাওয়া যায়।সে সময়ে অর্থাৎ মন্দিরের নির্মাণকালে যৌনতাকে কোন নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে দেখা হত না বরং তখন যৌনতা ছিল সন্তান জন্মদানের একমাত্র মাধ্যম এবং একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। এইজন্য এই মন্দির গাত্রে যৌন কামনা উদ্রেককারী বিভিন্ন মূর্তি শিল্পেরও দেখা যায়।

তথ্যসূত্র এবং ছবিঃ
https://www.gounesco.com/heritage/sites/sun-temple-konarak/
এবং বাঙলা পিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েব পেজ থেকে নেয়া ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:৩৫
১১টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×