somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি তো কবিতা পড়িনি, কবিতা আমার উপর পড়েছে!!

০৪ ঠা জুন, ২০২০ রাত ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





.... স্কুলে বাঙলার একজন শিক্ষক নিয়োগ হবেন। তার লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা সব শেষ!
টিকে যাওয়া দুজনের মধ্যে একজন সুঠামদেহী অপরজন স্থূলকায়!
প্রাক্টিক্যাল হচ্ছে!
প্রথমজন ক্লাসে এলেন; তার কণ্ঠ ভেদ করে শব্দসমূহ বের হয়ে এলো বাক্য হয়ে- ছেলেরা, কেমন আছো?
আমরা হাফপ্যান্ট আর অল্পবিস্তর ফুলপ্যান্ট পরা খুদে জনতা মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দেই- জি স্যার!
: তোমাদের একটি কবিতা পাঠ করে শোনাই!
আমাদের হ্যা কিংবা না- কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করেননি। তার দরাজকণ্ঠে আবৃত্তি করলেন মহাকবির কপোতাক্ষ নদ!

সারাজীবন পাঠ মুখস্থ করেছি, তা সে গদ্য আর পদ্য যাই হোক না কেন! দাড়ি, কমা, সেমিকোলন, জিজ্ঞাসা চিহ্নকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু, আপকামিং স্যারের কণ্ঠে যেন যাদু!
আমাদের যিনি বাঙলা পড়াতেন, তিনিও ক্লাসে ছিলেন, একেবারে শেষ বেঞ্চে!
ক্লাসশেষে হবু স্যার বিদায় নিলে আমাদের অরিজিনাল স্যার এলেন সামনে!
: কী বুঝলি?
আমরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠি, জি স্যার!!
উনার মনোবাসনা শতভাগ মিলে গেলো আমাদের চিন্তার সাথে!

মিনি আফসোস! উনি টেকেননি!!

তবে, ফিলিংস একখান জাগ্রত হইলো- কবিতা শোনা যায়, পড়া যায়... একনাগাড়ে গড়গড় করে মুখস্থ করা শুধু নয়!

কে যেন বলেছিলেন, মানুষ আর কম্পিউটারের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- কম্পিউটারে একশ' কবিতা রাখলে সেগুলোই ফিরে পাবে। মানুষকে একশখান গেলাতে পারলে নয়া দু চারটি সে উদ্গীরণ করতেও পারে!
ভুল, সবই ভুল... একশ'য়ের বেশি কবিতা আমি পড়েছি, কিন্তু কম্পিউটারের মতো তা অবিকল ফেরৎ দিতে পারবো না। আবার মানুষের মতো নয়া দু'একটা তৈরি করে দিতেও পারছি না!

শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বহুকাল কেটেছে ঝিকরগাছায়। আমরা যেখানে থাকতাম, তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ। কৈশোরেও দেখেছি কপোতাক্ষের রূপ, সাঁতার কেটে ওপারে চলে গেছি। তার স্রোতে এই ঘাট থেকে ওই ঘাট- কখনোই মিলতো না। পরে কৌণিক হিসেব করে সাঁতরাইছি!
এই নদে বিসর্জন হতো মা দুগ্গার! আমরা নৌকা, পরে যন্ত্রচালিত নৌকায় চড়ে কয়েক পাক দিয়ে তবেই বিসর্জন দিয়েছি দেবী দুর্গাকে!
ডুব দিলেই দেখা যেতো ছোট ছোট মাছ, শ্যাওলা- স্ফটিকস্বচ্ছ জলে!

যাহোক, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ- সবকালেই খুব ভোরে ঘরে শুয়ে শুয়ে মন্দিরার টুন টুন শব্দের সাথে প্রতিবেশী উজ্জ্বলা দেবীর কণ্ঠে শুনতাম- “রাধে গোবিন্দ রাধে গোবিন্দ... লও হে গোবিন্দের নামও রে...”
ঘুম ভাঙতো পাখির কুজনে, বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙতো উজ্জ্বলা দেবীর আরাধনায়।
উনি গাইতেন রাধে গোবিন্দ... আমি বুঝতাম রাঁধে গোবিন্দ!
একদিন সকালে রবিদাকে জিজ্ঞেস করি ( রবিদাদের বাসায় থাকতেন সত্তরোর্ধ্ব উজ্জ্বলা দেবী), দাদা গোবিন্দ তো রাঁধে, তাইলে বাজার করে কে?
উনি মুচকি হেসে বললেন, চৈতন্য!
উজ্জ্বলা দেবীকে একসময় বললাম, ঠাম্মা- আমি তোমার কণ্ঠে রাঁধে-গোবিন্দের ছন্দ শুনে মুখস্থ করে ফেলেছি!
উনি বেশ খুশি খুশি চোখে আমার পানে চান; বল তো শুনি!
আমি শুরু করি, “রাঁধে গোবিন্দ রাঁধে গোবিন্দ...
বাজার করে শ্রী চৈতন্য...!”

যেভাবে আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন, ঠিক তার চেয়ে বেশি রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমাকে ধাওয়া করলেন- ”বদমাশ, ইয়ার্কি হচ্ছে দেবতাদের নিয়ে!”

আমার ছন্দ মেলানোর কাজ দূরীভূত হলো!

ঋতুবদলে এক বর্ষায় আশপাশের স্কুলগুলোতে দেয়ালপত্রিকার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। স্কুলের সব ক্লাসের ছেলেরা (তখন শুধু ছেলেরাই পড়তো আমাদের ওই স্কুলে) কৌতুক, কবিতা, ছড়া, ভ্রমণকাহিনি নানা রকমের লেখা দিচ্ছে। আমাদের কয়েকজনের কাজ হলো সেগুলো লাল নীল সবুজ হলুদ কালি দিয়ে লিখে দারুণ করে সাজিয়ে দেওয়া।
আমারও ইচ্ছে হলো- সেখানে একখান ছড়া বা কবিতা টাঙানোর!
লিখি, ”রাস্তায় বিশাল কাদা-
পড়ে গেলেন কিনু দাদা!”
পরের লাইন আর মেলাতে পারছি না। দাদা পড়ে গিয়ে কোমরে না পায়ে ব্যথা পেলেন! হাড় ভেঙে গেছে, নাকি মচকে গেছে! হাসপাতালে নেবে, না রহিম ডাক্তারের চেম্বারে... দূরছাই! কাগজে লিখি, আর ছিঁড়ে ফেলি! কিছুই হয় না।
শরতের শিউলির মতো কাউকে যেন দেখে ভাবলাম, তাকে নিয়েই দু’এক লাইন লিখে ফেলবো!
বিকেলে শুরু করি, রাত হয়ে যায়... পরদিন আবার! নাহ, শিউলি যেমন রাতে রাতে ফোটে, সকালে কুয়াশায় গড়াগড়ি খায়, আবার লেখাগুলো তার চেয়ে দ্রুতগতিতে ঘরময় গড়াগড়ি খায়!

বুঝলাম, ছড়া কবিতা লেখা আমার কম্ম না। তারচেয়ে বরং এতে ইস্তফা দেওয়াই বেটার!

স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা। বাঙলার টিচার বললেন, পরীক্ষায় যেন বেশি বেশি কবি-সাহিত্যিকদের উক্তিগুলো রেফারেন্স হিসেবে দিই। এতে নাম্বার বেশি পাওয়া যাবে।
স্যারের কথা মেনে তারই দেওয়া নোট থেকে কবিতার উদ্ধৃতি দেই। হাতেকলমে রেজাল্ট পাই!
দেশমাতৃকার জন্যে গুণী মানুষদের লেখার কত্তো কদর!
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা- কবিতায় আর কী লিখবো, বুকের রক্তে লিখেছি একটি নাম... কিংবা আসাদের শার্ট পড়ে গায়ে কাঁপন আসা শুরু!
এরপর সুকান্ত ভট্টাচার্য পড়ি! কতো অল্প বয়সে কী মারাত্মক সব কবিতা লিখে গেছেন তিনি!
আস্তে আস্তে রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ...
পড়তে ভাল লাগে জীবননান্দ দাশ, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ. শক্তি মুখোপাধ্যায়!
কথোপকথনের একটি লাইন পড়ে ভাবি, পূর্ণেন্দু পত্রী লোকটাকে দেখার দরকার। আমার মানসে তখন তিনি ৩৫ কিংবা ৪০ বছর বয়সী হবেন!
পরে জানলাম, তার বয়স! হা হা হা... ওই বয়সে তিনি কত্তো রোমান্টিক!

বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় বাংলাদেশের একটি জাতীয় পত্রিকার অংশবিশেষ হস্তগত হলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, বেরুনোর কোনো স্কোপ নেই! কাগজের ওই অংশটাতে কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতার পাশে আবার সুন্দর সুন্দর স্কেচ!
কী আর করা! পড়তে থাকি...
একটা কবিতায় আমার দৃষ্টি আটকে যায়! একটা বিদেশি কবিতার অনুবাদ। কোন দেশের কবি আর কে অনুবাদ করেছেন- কিছুই মনে নেই! শুধু মনে আছে কয়েকটা লাইন। যে লাইনগুলো আমার উপরে বিষমভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আমি কবিতা লিখতে জানিনে, আবৃত্তি করার স্পর্ধা কষ্মিনকালেও দেখাতে পারিনি, পারার কথাও না; কিন্তু ভালোবাসাটা অন্তর্গত, সেটি নিয়ে কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারে না।
সেই কবিতার নামও মনে নেই, শুধু মনে আছে- লেখা ছিল :

”শুনেছি, দেবতারা ছাইয়ের দিকে তাকালে
ছাই সোনা হয়ে যায়!
আমার প্রেমিকা ব্যতিক্রম;
সে আমাকে সোনা বলে ডাকে-
কিন্তু তার দৃষ্টি আমাকে ছাই করে দেয়!”

৬ মে ২০২০


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২০ রাত ৯:২২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×