somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার দ্বিতীয় অফিস

১৫ ই অক্টোবর, ২০০৬ সকাল ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লোকের সাধারনত প্রথম অফিসের কথা বেশি করে মনে থাকে । আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম । নানা কারনে আমার দ্বিতীয় অফিস আমার মনে দাগ কেটেছে ।
আমার প্রথম চাকরি একাশি দিনের মাথায় ছেড়ে দেবার পর বাড়িতে প্রায় নিষ্কর্মাই বসে ছিলাম । তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমার বন্ধুর ফোন এল । কোন একটা অফিসে কনট্রাক্টে কাজ হতে পারে । পরদিন আকাডেমীর সামনে দাঁড়াতে বলল । তার কথা মত পরদিন কলকাতার আকাডেমী অফ ফাইন আর্টসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । তাকিয়ে দেখলাম চারিদিকে পোস্টারের ছড়াছড়ি । আকাডেমীর ডিরেক্টরকে বানর সম্বোধনে ভূষিত করে অনেক পোস্টার পড়েছে । একটু পরেই আমার সেই বন্ধু এল । তার সাথে বাসে চেপে সেই অফিসে এসে হাজির হলাম । একটি পুরনো দিনের ফ্ল্যাট বাড়ির পাঁচতলায় সেই অফিস । বিরাট দরজা জানলা, উঁচু ছাদ, পুরনো আমলের পাখা আর সুইচ । তার মধ্যেই কমপিউটার সাজিয়ে অফিস করা হয়েছে । কলকাতায় আধুনিক অফিসের সাথে কোনভাবেই খাপ খায় না । আমরা গ্রাফিক ডিজাইনার । আমি একটি সিডি বার করে ম্যানেজার মশাই এর হাতে দিলাম । দেখে বুঝলাম ম্যানেজার মশাই অফিসের সর্বেসর্বা । গোঁফদাড়ি কামানো বেশ পরিচ্ছন্ন মুখ । প্রায় চল্লিশ বছর বয়েস হবে । সিডিটা কমপিউটারে চালিয়ে আমার কাজ দেখলেন । অফিসে আরেকজন রয়েছে যাকে দেখে ম্যানেজার মশাইয়ের চ্যালা বলে মনে হল । যাকে আমরা সু-দা বলে ডাকব । তার সূত্রেই আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে এসেছে । এরপর আমাদের জানানো হল এটা একটা কর্পোরেট কাজ । খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে । এখন রিসার্চ ওয়ার্ক চলছে । কয়েকদিনের ভিতরেই জানানো হবে কবে থেকে কাজ আরম্ভ হবে । অফিসে আরো একজনকে দেখলাম ।বেশ নাটা চেহারা । গোল মুখ । গোল চোখ । ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল । ইনি নাকি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর । দেখে মনে হল বেশ কনফিউজড মানুষ । একটা সাধারন কথা বলতে গিয়ে তিনবার হোঁচট খাচ্ছেন । ইনি হলেন র-দা ।
যাই হোক প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে বাড়ি ফিরে এলাম । কয়েকদিন বাদেই আমাদের ডাকা হল । এবং কাজও আরম্ভ হল ।
কাজে এসে পরিচয় হল আরো একজনের সাথে । ইনি হলেন তু-দা । দেখেশুনে বুঝলাম তু-দার অফিসে সেরকম কোনো কাজ নেই । কেবলি এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছেন । ম্যানজার মশাই বললেন তু- হল আমাদের অফিসের ট্রাবলশুটার ।
দুপুর বেলা মাঝে মাঝে দেখতাম তু-দা সোফায় বসে ঘুমোচ্ছেন । আমাদের ধারনা ছিল একমাত্র সরকারি অফিসেই দুপুরবেলা নাক ডাকিয়ে ঘুমোনো যায় । এখানে এসে দেখলাম সেরকম ভাগ্য হলে প্রাইভেট চাকরিতেও এ সুখ পাওয়া যেতে পারে ।
ওই ফ্ল্যাটের ভিতরে দুটি অফিস ছিল । দুই ভায়ের দুই অফিস । আমরা বড় ভাইয়ের অফিসে কাজ করতাম । আর ছোট ভাইয়ের অফিসে ছিল প্রচুর সুন্দরী মেয়ের আনাগোনা । প্রায়ই দেখতাম নিত্যনতুন মেয়ে আসছে । তারা কতক্ষন কাজ করত আর কতক্ষন মোবাইলে আড্ডা দিত তা তারাই জানে । সবসময়েই দেখতাম আমদের ঘরের সামনে দিয়ে তারা মোবাইলে কথা বলতে বলতে পায়চারি করছে ।
অফিসের ভেতরের পরিবেশটা কেমন ছিল একটু বলি । অফিসের ভেতরে দেখলাম সবাই বাংলা ইংরাজি এবং হিন্দিতে কাঁচা কাঁচা খিস্তি ব্যবহার করছে । কেউ কাউকে যে সরাসরি দিচ্ছে এমন নয় । বেশিরভাগই আড়ালে অথবা উড়ো দেওয়া হচ্ছে ।
দুটো নতুন বাচ্চা ছেলের সামনে এরকম গালাগালির জোয়ার ম্যানেজার মশাইয়ের বোধহয় একটু কিন্তু কিন্তু লাগছিল । তিনি আমাদের বললেন - আমাদের এখানে কিন্তু একটু গালাগালি চলে তোমাদের কোনো অসুবিধে নেই তো । আমরা বললাম না নেই ।
তারপর কাজ এগোতে লাগল । র-দা নিয়মিত ভাবে আমদের কনফিউজড করতে লাগলেন । একই ডিজাইন আমরা হাজার বার করে বানাতে লাগলাম । প্রায়ই ডিজাইন দেখে র-দা বলতেন ভালই হয়েছে বাট আই থিঙ্ক সামথিং ইজ রং । এই সামথিং ইজ রং টা যে কি তা কোনোদিনই তিনি বলতে পারতেন না ।
অফিসে একটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একশো বছরের সিডির সেট ছিল । একপেটি সিডি যা কখনও খোলা হয় নি । সেটা দেখে আমাদের ভীষন লোভ লাগল । যেভাবেই হোক সিডিগুলোকে রাইট করে নিতেই হবে । আমরা বললাম ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সিডিগুলো আমাদের লাগবে । কারন ওগুলো থেকে অনেক ভালো ভালো ছবি পাওয়া যেতে পারে । এইবলে পেটিটা খোলা হল এবং ওগুলো আমরা আস্তে আস্তে রাইট করে নিলাম । তারপর আবার বললাম না এগুলো থেকে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না । ওগুলো তুলে রাখুন ।
অফিস থেকে আরও কিছু পিকচার সিডির সেট বেশ কিছু গান ইত্যাদিও সংগ্রহ করা গেল ।
এরপর একদিন মালিক এলেন অফিসে । বেশ লম্বা চওড়া মুসকো চেহারা । বিরাট শিল্পপতির ছেলে । এনার আসল ব্যবসা নাকি কম্পানি কেনাবেচা করা । প্রচুর টাকার মালিক অথচ অফিসে এসেছেন একটা ছেঁড়া জামা আর চটি পরে অথচ একটা দামী গাড়ি চেপে । আমাদের নামটাও একবার জিগেস করলেন না দেখে বেশ খারাপ লাগল । পরে অবশ্য বুঝেছিলাম । ভদ্রলোক ভালই ।
কাজ যতই এগোতে লাগল অফিসে গন্ডোগোল তত বাড়তে লাগল । এই সময় দুজন ভদ্রলোক অফিসে এলেন কিছু ভিডিও এডিট করার কাজে । তাঁদের সাথেও আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠল । এদিকে কাজের ডেডলাইন পেরিয়ে প্রায় একমাস হয়ে গেছে । তাই আমদের প্রত্যেক রোববারেও অফিসে যেতে হত । অবশ্য রোববারে অফিসে খাওয়াটা পাওয়া যেত ।
অফিসে কাজ করতে করতে বোঝা গেল এই অফিসটি আসলে উঠে যেতে চলেছে । উঠে যাবার আগে এটাই শেষ প্রজেক্ট ।
মানে প্রদীপ নিভে যাবার আগে যেমন হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে সেরকম আর কি । আমাদের সামনেই অফিসের কমপিউটার টেবিল চেয়ার বিক্রির আলোচনা হতে লাগল । আমাদের কেরিয়ারের শুরুতেই আমরা দেখলাম কিভাবে একটা অফিস আস্তে আস্তে উঠে যায় ।
অফিসে সবার সাথে সবার গন্ডোগোল বাড়তে লাগল । অবশ্য আমাদের সাথে সবার সম্পর্ক ভালোই ছিল । খালি একদিন আমার বন্ধুর সাথে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর র-দার ঝগড়া বেধে গেল । আমরা তো এখানে চাকরি করি না কয়েকদিনের কনট্রাক্টে এসেছি । সুতরাং আমাদের উপর টেম্পার নিলে আমারাই বা ছাড়বো কেন । তবে র-দা লোকটা এমনিতে মন্দ নয় । তখন কিছু ব্যক্তিগত কারনে মেজাজটা ওনার খিঁচড়ে ছিল ।
ম্যানেজার মশাই অফিসে না থাকলে সবার সাহস একটু বেড়ে যেত । একদিন দেখলাম সবাই মিলে ভরদুপুরে অফিসে বিয়ার খাচ্ছে । অফিসে একএক জনের জন্য এক এক রকম নিয়ম ছিল । কেউ কেউ যেমন র-দা এবং নতুন দুই এডিটর অফিসের পয়সাতেই ভালমন্দ সাঁটাতো । কিন্তু আমরা বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যেতাম অথবা পিয়নকে টাকা দিয়ে আনিয়ে নিতাম ।
এই নিয়েও কিছু অশান্তি হয় । পরে নাকি মালিক আর ম্যানেজার মশাইয়ের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক হয় যে র-দার টাকা থেকে নাকি তাঁর রোজকার চোব্যচোষ্যের টাকা বাদ দেওয়া হবে । তবে সেটা হয়েছিল কিনা সেটা ঠিক জানা নেই ।
আশা করি এতক্ষনে সবাই বুঝতে পেরেছেন কেন এই অফিসটা আমার মনে দাগ কেটেছে । কলকাতা শহরে এরকম অফিস আর আছে কিনা তা জানা নেই । যাই হোক বহু ঝামেলার পর নানা জোড়াতালি দিয়ে প্রজেক্টটা মোটামুটি শেষ করে আনা হয় । সু-দার সাহায্যে আমি আর একটা অফিসে ইনটারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে যাই তাই প্রজেক্ট শেষ হবার প্রায় দিন পনেরো আগে আমি এই অফিস ছেড়ে দিই ।
আমার বন্ধু শেষ দিন অবধি ছিল । তার কাছে যা শুনেছি শেষ দিন অফিসে গিয়ে সে দেখে অতবড় অফিস পুরো খাঁ খাঁ করছে । সব কমপিউটার, আসবাব বিক্রি করে আছে । অফিসে বসবার মত কোন চেয়ারও অবশিষ্ট নেই । সবাই দাঁড়িয়ে আছে । আমার বন্ধুর আশা ছিল পড়ে থাকা কিছু ঝড়তি পড়তি মাল যেমন কিছু ভাল ছবি আর বই সে বাড়ি নিয়ে আসবে । কিন্তু সে কিছুই পেল না । সবই ম্যানেজার মশাই নিয়ে গেলেন ।
তারপর ফ্ল্যাটের মালিক এলেন । ফ্ল্যাটের চাবি তাঁর হাতে দিয়ে দেওয়া হল । এবং এই অফিসে বরাবরের মত তালা পড়ল। এইভাবে এই প্রজেক্ট শেষ হল ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×