সপ্তাহখানেক আগে একটা রোগী আসল আমার সান্ধ্যকালীন ডিউটির শেষ দিকে। তার ডানকান থেকে একটা দেশলাই কাঠি বেরিয়ে আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সহজ কেস- কেবলদেশলাই কাঠিই তো ঢুকিয়েছে। হিস্ট্রি নিতে গিয়ে জানলাম এতো পুরো লিকুইডইঞ্জিনিয়ারিং করে এসেছে। ঘটনা সামান্য, কানে সে মটরদানা ঢুকিয়েছিল। বের করতেচেষ্টা করতেই তা আরো ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর তার এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দেয়, দেশলাইকাঠির একপ্রান্তে সুপার গ্লু লাগিয়ে তা কানে আলতোভাবে ঢুকিয়ে মটরদানার গায়ে স্পর্শকরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই মটরদানা আটকে যাবে। তারপর টুক করে বের করে নেওয়া যাবে।যেই ভাবা, সেই কাজ। কিন্তু বিধি বাম। গ্লু এর পরিমাণ বেশী হওয়ায় মটরদানা আর দেশলাইকাঠি দুটোই কানের ভেতর আটকে যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া এ ধরনের কেস কারো চেষ্টাকরা অনুচিত। কারণ বেশী টানাটানি করলে কানের ভেতরের চামড়া এমনকি কানের পর্দা সহ চলেআসতে পারে।
যাই হোক, কানের ভেতরে অনাকাঙ্খিত জিনিষ এবং তা নিয়ে আপনাদের কি করনীয় এবং বর্জনীয়তা জানাতে আমার এই লেখা। আপনারা চাইলে নামে-বেনামে এই লেখা শেয়ার করতে পারেন, আমারবিন্দুমাত্র আপত্তি নেই এবং আমার অনুমতিরও প্রয়োজন পড়বে না।
(ক) প্রথমত কানে খৈল বা ময়লাঃ কানে খৈল জন্মানো, জমা হওয়া সম্পূর্ণস্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কারো কারো বেশী পরমাণে জন্মে এবং জমে। অনেক ক্ষেত্রেশ্রবণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।সচেতন প্রাপ্ত বয়ষ্করা সাধারণ গোসল ও অন্যান্যভাবে যেমন ওযু করার সময় বা কান চুলকানোর মাধ্যমে পরিষ্কার করে ফেলেন। বাকিটাসাধারণত আমাদের চাপার হাড়ের যে নড়াচড়া তাতেই বেড়িয়ে আসে। কিন্তু শিশুরা, বাচ্চারাএবং অসচেতন মানুষেরা কানে খৈল নিয়ে সমস্যায় পড়েন। এক্ষেত্রে ঘরে কটন বাড (cotton bud) ব্যবহার করা হয়। এতে অনেক সময় কানে কটন বাড আটকেকিম্বা কানের পর্দাকে ময়লা মনে করে বের করে আনার মত দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। আমারপরিচিত অনেকেই এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। মনে রাখবেন, কানের পর্দা ছিড়ে গেলেতা শিশুদের ক্ষেত্রে জোড়া লেগে যেতে পারে। কিন্তু বেশ খানিকটা ছিড়ে গেলে, কিম্বাপ্রাপ্ত বয়ষ্কদের ক্ষেত্রে জোড়া লাগার সম্ভাবনা কমে যায়, কানে ঘন ঘন সংক্রমণ (ইনফেকশন)হবার হার বেড়ে যায় এবং শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে কমে যায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কানেখৈল হলে কি করবেন? খুব সহজ সমাধান। বাচ্চাদের এবং বড়দের জন্য সমাধান একই। ওলিভওয়েল (olive oil)বা লিকুইড প্যারাফিন (liquid paraffin) হল নিষ্ক্রিয় তেল। অর্থাৎ এরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি করে না। কিন্তু কানের খৈলকে নরম করে এবং আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে সাহায্যকরে। রাতে ঘুমানোর আগে আপনার বাচ্চার বা আপনার নিজের কানে কয়েক মাস পর পর দু-তিনফোটা করে দিতে পারেন। এতে করে কানে খৈল জমবে না। তবে কানে আগে থেকে প্রদাহ (ব্যথা)বা সংক্রমণ (ইনফেকশন) থাকলে অবশ্যইবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
(খ) কানে জীবন্ত কিছু ঢুকেছেঃ এটা আসলেই খুব কষ্টকর একটা ব্যপার। কারণজীবন্ত পোকা নাড়াচাড়া বা কামড় দিয়ে পরিস্থিতি খারাপ করে তোলে। যদি আপনি বুঝতে পারেন কানের ভেতরের পোকাটা জীবন্ত অবস্থায় রয়েছে তবে কানের সামনে একটা আলোর উৎস যেমন জ্বলন্ত মোমবাতি কিংবা লাইট ধরতে পারেন । কেননা সাধারণত , পোকা মাকড়েরা আলোর দিকে আকৃস্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে আলো দেখে তা আপনা আপনি বের হয়ে আসতে পারে । তা না হলে, দ্রুততার সাথে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হোন। তবে তা যদি দ্রুত সম্ভব না হয়, আক্রান্ত ব্যক্তির একটা উপকার আপনি কতে পারেন পোকাটি মেরে ফেলে। কিভাবে? ঐ যে অলিভ ওয়েল বা লিকুইডপ্যারাফিন। এর কোনটাই যদি না থাকে, আমি আবার বলছি, এ দু’টোর কোনটাই যদিনা থাকে তবেই কেবল পানি ব্যবহার করবেন। তারপর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।ডিসপেন্সারী বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নেবেন না। ওরা কেরোসিন তেল, সয়াবিন তেলএমনকি সর্ষের তেলও ব্যবহার করে দেখে। আর যেনতেন রকমের যন্ত্র দিয়ে কানের ভেতরখুঁচিয়ে দফারফা করে রাখে।
(গ) কানে জড় পদার্থঃ সাধারনত বাচ্চারা ঘড়ির ব্যাটারী, মটরদানা, পুঁতি,পাঞ্জাবীর বোতাম (এটা আজ পেয়েছি), বালি, নাকফুল ইত্যাদি ঢুকিয়ে থাকে। বড়দেরক্ষেত্রেও এর খুব একটা ব্যতিক্রম হয় না। অনেক মা আসেন বাচ্চা তাঁর ঘুমিয়ে থাকারসুযোগ নিয়ে কিছু একটা কানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কানে ব্যাটারী ছাড়া অন্য কিছু ঢুকলেআপাতত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কানে কোন ড্রপ বা তেল দেবেন না, কারণ তা ঐ বস্তুটাকেআরো পিচ্ছিল করে তুলবে যার কারনে বের করে আনা আরো কষ্টসাধ্য হবে। আর মটরদানা, বুট,শিমবিচি ইত্যাদি হলে ফুলে ফেঁপে আরো আটকে যাবে। তাই চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হোন।কারণ এ ধরনের জিনিষ বের করে আনার যন্ত্রটা দেখতে সামান্য হলেও কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞচিকিৎসক বা তার তত্ত্বাবধানে থাকা নবীশ চিকিৎসকের হাতেই আপনার জন্য নিরাপদ।অন্যথায় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ব্যাটারী ঢুকলে একটু দ্রুততার সাথে চিকিৎসকের কাছেআসবেন, কারণ অনেক সময় ব্যাটারী থেকে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ বেরিয়ে কানের ক্ষতিকরতে পারে।
আজ এটুকুই। ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। বিশেষ জিজ্ঞাসা থাকলেআমাকে সরাসরি বলুন। আমার ভুল থাকলে শুধরে দিতেও পারেন।
ভালো থাকবেন।
অনেক অনেক ভালো...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৩ রাত ১০:৩৮