প্রতিষ্ঠার পর থেকে ই কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল অনেকটা নমনীয় । মূলত ভারতীয়দের মাঝে রাজনৈতিক ভাব ধারার বিকাশ এবং শাসন ব্যবস্থায় ভারতীয়দের অংশগ্রহনের পূর্ব প্রশিক্ষনের মাধ্যম স্বরুপ এই প্রতিষ্ঠান টিকে তৈরি করা হয়েছিল। শুরুর দিকে এটি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধতা প্রকাশ না করলেও ক্রমেই তা বিভক্তির দিকে আগাতে শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই এর প্রধান চাহিদা হয়ে দারায় ভারতের স্বাধীনতা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯০৭ সালের দিকে দলটির মাঝে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়, এক দিকে, বাল গঙ্গাধর তিলক এর নেতৃতাধীন"গরম দল" বা Extrimist দল অন্যদিকে গোপাল কৃষ্ণ গোখালে র নেতৃতাধীন "নরম দল" বা মডারেট পন্থিরা। তিলকের ব্যক্তিগত নেতৃতের কারিশমায় কংগ্রেস ই প্রথম রাজনৈতিক দল যা আপামর জনতাকে এক প্লাটফর্মে দাড়া করায়, শুধুমাত্র একটি ইস্যু নিয়ে আর তা হল স্বাধীনতা। এখানে উল্লেখ যোগ্য হল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিন্তু সেসময় টা তে কংগ্রেসের এক জন প্রথম সারির নেতা ছিলেন, যিনি পর্বরতীতে নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগে যোগদান করেন। যে ব্যাপারে আমি পরে আসব।
রাজনৈতিক দামাদলে টাল মাটাল ব্রিটিশ রাজ ১৯০৫ সালে যখন বংগ ভঙ্গ সিদ্ধান্ত নেয় তখন কংগ্রেসের অবস্থান ছিল মূলত এর বিপক্ষে। এবার আসুন দেখি কি ছিল এই বংগ ভঙ্গ ? কেমন ছিল এর প্রেক্ষাপট? পূর্ব বাংলা র মানুষ কি ভাবছিল একে নিয়ে?
মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর কাছে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের পর থেকেই বাংলার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগ নেমে আসে। ফল স্বরুপ মোঘল আমলের বাংলার উল্লেখ যোগ্য শহর বা ব্যাবসা কেন্দ্র গুল অবহেলিত হতে শুরু করে কেননা , ততকালনিন সময়ে ইংরেজ ব্যবসা বা রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক সব ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক । আর এই কলকাতা ছিল ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদদে তৈরি এ নগর যা ১৬৯০ সালে নবাব আলীবর্দী খা র কাছ থেকে ব্যাবসার প্রসারের জন্য লীজ নিয়েছিল ব্রিটীস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় কলকাতা, সুতানুটি,গোবিন্দপুর নামক তিন টি গ্রাম নিয়েই এ শহরের পত্তন। কাল ক্রমে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় যখন পুরদমে কোম্পানি শাসন চালু হল সে সময় থেকেই ক্রমান্বয়ে কলকাতা ব্যবসা বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হল। এখানে বলা যেতে পারে যে, অনেক্ টা ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহায়তাই এ শহরে শিক্ষা দিক্ষা র প্রসার ঘটে, যার প্রত্যক্ষ ফল ভোগি হোয়ে দাঁড়ায় এ খানে বসবাস কারি হিন্দু প্রধান জন গোষ্টিরা। কালক্রমে এক টি মধ্যবিত্ত ব্যাবসায়ি শ্রেনীর বিকাশ ঘটে । এই মধ্য বিত্ত শ্রেনির মূল ধারাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। কেননা প্রায় পাচশ বছর মূসল্মান শাসনের পর ইংরেজ রাই প্রথম তাদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে ,তা ছাড়া ও সামজিক ভাবেও তারা বেশ নিজেদের স্বার্থ সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। আর তারই Spill over Effect এর মত কলকাতা কেন্দ্রিক এক টি নগরায়ন তৈরি হয় যা পরবর্তি কালে এই ভূখন্ডের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক পরিমন্ডল কে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করবে।মোগল আমলের এ ভুখন্ডের উল্লেখ যোগ্য শহর ঢাকা ( যা ১৬১০ শালে প্রথম রাজধানি হিসেবে স্বিকৃতি পায়) সে সময় অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পরে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এর সাথেই পূর্ব বাংলার মুসল্মান সম্প্রদায় ওঁ পিছিয়ে পরতে শুরু করে।
প্রসংগত একটি ব্যাপার আলোচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। আর তা হল চিরস্থায়ী বন্দবস্ত।১৭৬৪ সালের বক্সারে যুদ্ধের পরে ই্সট ইন্ডিয়া কোম্পানী মূলত মোঘল আমলের প্রাচিন জমিদারী প্রথার সংস্কার করা শুরু করে চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত (Permanent settelment)নামে। এ অনুসারে পূর্বের মোঘল রাজ কর্তিক মননীত দেওয়ানি র আয়ত্তাধীন জমিদার দের খাজ আদায়ের নিয়ম পরিবর্তন হয়ে দশবছর মেয়াদী জমিদারি র মালিকানার নিয়ম করা হল, যেখানে কোম্পানীর দেওয়ানিকে ফিক্সড রেটে মূল্য পরিশোধ করতে হোত । চিন্তা করা হয়ে ছিল এ ভাবে জমিদাররা এ সময়টাতে সরকারি খাজনা আদায় করার পর ভূমির উন্নয়নে মনযোগ দেবে । কিন্তু নির্ধারিত দিনে সূর্যাস্তের আগেই সমুদয় জমিদারের দেনা কোম্পানিকে পরিশোধ না করতে পারলে জমিদারি নিলামে উঠে যেত। যা হোক এ ভাবেই ১৭৯৩ সালে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনের কারনে অনেক জমিদার তাদের জমিদারি হারায়, যা নিলামে কলকাতা কেন্দ্রিক কোম্পানীর কর্মচারি ,ব্যবসায়িদের হস্তগত হয়। কেননা তখন কলকাতাই সকল ব্যবসায়িক চালিকা শক্তি, কাচা অর্থের উৎস। এ সকল নব্য জমিদার দের অধিকাংশ ই হল হিন্দু, কিন্তু তাদের জমিদারি দূগম ময়মন্সিং, নাটোর, বরিশাল, দিনাজপূর কিংবা কুমিল্লার মত স্থানে। আর এসমস্ত এলাকার শত করা আশি ভাগ ই মূসল্মান চাষি। এক দিকে কোম্পানীর ফিক্সড রেটের মুনাফা উদ্ধার অন্য দিকে জমিদারির সামগ্রীর এলাকার সাথে সম্পর্ক হীনতা আর non committent থাকয় এ সমস্ত ব্যাঙ্কার, ব্যাবসায়ি, গোমাস্তা শ্রেনী কে অনেক টা অপরিনাম দর্শি মত ই কেবল বেশি লাভের তাগিদে চাষাবাদের জমিতে জোর পূর্বক নীল চাষ করতে বাধ্য করে নি্রীহ মুসলিম চাষি দের। এর কারনে জমি গুলোর উর্বরতা ব্যাপক ভাবে কমে যায়,পরিনামে দূর্ভীক্ষ, খরা। মীর মোশারফ হোসেনের ''নীল দর্পন" এমন ই দুর্যোগের গল্প ই তুলে ধরে আমাদের সামনে।
এভাবেই কলকাতা ও আশে পাশের এলাকা গুল তে যখন ব্যাপক উন্নয়ন এর ছোয়া লাগছিল ওঁ ঠিক সেইসময়ই সুবিশল বাংলা বিহার ,অড়িশ্যা ,আসাম যা কিনা ততকালীন ইউরোপীয় ফ্রান্সের সমতুল্য ছিল অনেক টা পশ্চাত কামী অঞ্চলে পরিনীত হয় যার জন্য অনেকাংশে যোগাযোগ ব্যাবস্থা দ্বায়ি।
কিন্তু সবচাইতে মারাত্মক প্রভাব টি পরে ছিল সামজিক ভাবে । মুসলমান প্রজা রা ভাবতে শুরু করে তাদের হিন্দু জমিদাররা তাদের কাছের লোক না। সুদূর কলকাতা থেকে তারা কেবল ই শোষন ছাড়া আর কিছুই করছে না। এ সময়ে যে কিছু মুসল্মান জমিদার ছিল তারাও অই একই মন মান্সিকতা থেকে হিন্দু প্রজাদের শোষন করছিল।তবে এ সকল জমিদার দের সংখ্যা ছিল নিতান্ত ই নগন্য।
এ খানে লক্ষনীয় যে এই বিশাল এলাকায় সামাজিক ব্যবস্থা ধর্ম নামক এক টি গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর এর উপর নির্ভরশীল। সাধারন জনগোষ্টির মধ্যকার পারস্পোরিক সম্পর্ক আলোচনায় আনলে এর প্রভাব আরো কঠিন। সনাতনি প্রথা মোতাবেক হিন্দুরা বেশ কিছুটা রক্ষন শীল।যে কারনে আমরা সে সময় কার নানা উপন্যস বা সাহিত্যে জাত প্রথা বা মুসলমানদের অসূচ মনে করার প্রবনতা্ সামাজিক বিভাজনের কারন হয়ে দাঁড়ায় । মূলত এরকমএকটা পরিস্থিতিতে মুসল মান সমাজ ওঁ নান গোড়ামিতে মত্ত। তাদের ব্রিটীশ বিদ্বেষ প্রকারান্তে ব্রিটিশ শিক্ষা বর্জন, চাকুরি ক্ষেত্রে নিয়োগ না পাওয়া তাদের সার্বিকভাবে একটি অনগ্রসর সমাজের পরিনত করে। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু ও মুসল্মান সম্প্রদায় পরস্পরের সহযোগি না হয়ে প্রথমে সামাজিক প্রতিদ্বন্দি ওঁ পরে বিদ্বেষী হয়ে উঠে। দিনে দিনে এই এর মাত্রা বাড়তে থাকে।
যা হোক এ সব কিছুর ফলেই এই বিশাল অনগ্রসর মুস্লমান অধ্যুসিত জনগোস্টি ক্রমেই কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার বিভক্তির অপেক্ষা করছিল। এই সময়ে ১৯০৫ সালে স্যার লর্দ কার্জন বঙ্গ ভঙ্গ র ঘোষনা দেন। মূলত আগের বাংলা প্রদেশ ভেঙ্গে নতু্ন দুটি প্রদেশ করা হয়, যেখানে পশ্চাতপদ পূর্ববাংলা ,আসাম একটি নতুন প্রদেশ হিসেবে জন্ম লাভ করে যার রাজধানি হয়ে ছিল ঢাকা। অন্য দিকে কলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিম বাংলা, বিহার আর অড়িষা নিয়ে নতুন প্রদেশ তৈরি করা হয়।
তাতক্ষনিক প্রতিক্রিয়া স্বরুপ কলকাতা র বাঙালি সম্প্রদায় এর প্রতিবাদে মূখরিত হয়। তারা একে বঙ্গ মাতা কে দ্বিখন্ডিত করার চক্রান্ত বলে চিত্রায়িত করে। আমাদের কবি গুরু ঠিক এই সময়ই "আমার সোনার বাংলা " রচনা করেন। বলা বাহুল্য জোড়া সাকোর এই জমিদারের পরিবা্রের অনেক জমিদারি সম্পত্তি ই ছিল পূর্ব বাংলায়। অন্যদিকে পূর্ব বাঙ্গালার অধিবাসিরা একে সাধুবাদ জানায়। ঠিক এই সময় কংগ্রেস ব্যাপক ভাবে এই বিভক্তির বিরোধীতা করে । এ প্রসংগে তারা স্বদেশী আন্দোলনের ডাক দেয়। সেসময় কার স্বদেশী রা ইংরেজ পন্য বর্জন থেকে শুরু করে ,রাজনৈতিক সহিংস তার আশ্রয় নেয়।
ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় অই সময় কার প্রেক্ষাপটে এই রকম একটি বিভাজন সম্পূর্ণ স্বার্থের বিরোধ(conflict of interest) ছাড়া কিছুই না। ব্রিটিস সমর্থিত বাঙ্গালি হিন্দু প্রভাব বলয়ে (sphere of influence) বাঙালি মুসল্মান রা বিকশিত হচ্ছিল না । সামাজিক ভাবে অবহেলিত, শিক্ষা ,চাকুরি ব্যবসা ক্ষেত্রে পিছিয়ে অনেকটা নির্জিব এই জনগোষ্টীর চাহিদা ছিল বিকাশ লাভে উন্মুখ । কিন্ত সেসময়কার সবচাইতে বড় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এই অবহেলিত কৃষক শ্রেণির আবেগ কে না বুঝে অনেক টা নিখিল ভারত ভিত্তিক প্রেক্ষাপট কে বড় করে দেখে , যার কারনে স্বদেশি আন্দোলন এর মত কর্মসূচি দিতে তারা দ্বিধা বোধ করে না। এখানে যে কথাটা কে সবচেয়ে হাই লাইট করার মত তা হল, কংগ্রেস কলকাতা ভিত্তিক পাব্লিক সেন্টিমেন্ট কে বড় করে দেখে ছিল, সমস্যার গভীরে যায় নি। ভারতের স্বামগ্রিক স্বাধীনতা র জন্য পূর্ব বাংলার স্বার্থ কে এমন ভাবে বিরোধীতা করে কংগ্রেস মূলত পরবর্তিকালের হিন্দু মুস্লমান ঐক্যের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়। একই সাথে রাজনৈতিক দল হিসেবে অসাম্প্রদায়িকতার তকমাকেও সন্দিহান করে তোলে,
ফলে মুস্লিম বাঙ্গালায় কংগ্রেস জনপ্রিয়তা হারায়। তখন ই বাংলায় মুস্লিম স্বার্থ রক্ষার ব্রত নিয়ে আসে "নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগ"। মুসল্মান পাব্লিক সেন্টিমেন্ট কে পূজি করে তৈরি হয়া এই দল টি পরবর্তি কালে অনেক ঘটনাকে প্রভাবিত করে।
চলবে...।।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



