চুলগুলো ছিল আমার শণের মত । তেল দিতে চাইতাম না । তেল দিলে মাথা গরম হয়ে যেত । আম্মা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কত যে লজেন্স ঘুষ দিয়ে, আদর করতে করতে শেষমেশ আমার মাথায় তেল দেয়ার পারমিশন পেত । রোজদিন বিকালবেলা সুন্দর দুটো তেলচুপচুপা বেণী করে তাতে লাল ফিতা বেঁধে তারপর পাঠিয়ে দিত নিচে খেলতে । আমি ছটফট করতাম, কখন শেষ হবে চুল বাধা, খেলতে যাবো । ৬-৭ মিনিট হতে না হতেই বলা শুরু করতাম, “ থাক আম্মা আর লাগবে না । ছাড়ো, ওই বল্টুরা বোধহয় চলে এসেছে ।“ আম্মা বলতো, “ এই তো হয়ে গেল।“ , “এই তো একটু ।“ চুল বাধা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করতাম । কিন্তু আম্মা হাত ধরে টেনে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলতো, “ যা” । এখন মনে হয় আগে যদি জানতাম আম্মাকে এত অল্প সময়ের জন্য পাব তাহলে ৬-৭ মিনিট না , মিনিটের পর মিনিট শুধু চুলই বেধে নিতাম । আম্মা চলে যাওয়ার পর আপুই আমাকে দেখাশোনা করতো । কিন্তু আম্মার মত হত না । হাজার চেষ্টা করেও চুলে তেল দিতে পারত না । শণের মত চুলগুলো বাধতে গিয়ে জট ছাড়াতেই পারত না ঠিকমত । কোনমতে একটা বেণী করতো । পরে বড় হওয়ার পর চিন্তা করে দেখেছি আপুই আসলে আমার দেখাশোনার দায়িত্বটা নিজ থেকে কাধে তুলে নিয়েছিল । ছোট থাকতে খাইয়ে দেয়া, স্কুলে টিফিন দেয়া, ময়লা জামা কাপড় ধুতে দেয়া, কোন জামা পরবো সেটা ঠিক করা, বাইরে যাওয়ার জামা ইস্ত্রি করা, লেখাপড়া দেখিয়ে দেয়া, রাতে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে না ঘুমানো পর্যন্ত পাশে শুইয়ে থাকা খুঁটিনাটি কত কি যে করতো বলে শেষ করতে পারব না । কিন্তু সেসময় আমি আপুর এই মাতৃসুলভ ভালবাসা, দায়িত্ববোধ কিছুই উপলব্ধি করতে পারিনি । উপলব্ধি করার মত বয়স হলেও ম্যাচিওরিটি হয়নি তখনও আমার । মনটা সারাক্ষণ পরে থাকতো বাইরের জগতের দিকে । সেই ছোট থাকতেই পাড়ার কয়েকজন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিলাম একটা দল । পাড়ার সবাই মজা করে বলতো বল্টু বাহিনী । আমি, বল্টু (জিন্তু কাকার ছেলে ), ঢ্যাঙা (আসল নাম রাফিক, ডাক্তার কাকুর একমাত্র সন্তান ), বিবিসি (আসল নাম প্রবাল, শান্তা অ্যান্টির ছেলে ), টর্চ (আসল নাম ফাইজা, বিবিসির বোন, খুব ফর্সা দেখতে, আর অনেকটা অভিনেত্রী মিতা নূরের মত ছিল । মিতা নূর অনেক আগে সানলাইট ব্যাটারির অ্যাড-এ টর্চ নিয়ে নেচেছিল বলে ওর নাম টর্চ দেয়া হয়েছিল), মাষ্টারণী (আসল নাম ত্রপা , এত জ্ঞানী যে ওর সামনে জ্ঞানের কথা বলতে সবাই ভয় পেতাম ) । আমরা সবাই একই ক্লাসে পড়তাম, তবে ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে । বল্টু অবশ্য একই ক্লাসে পড়লেও বয়সে ছিল আমাদের চেয়ে এক বছরের বড় আর তাই ওই ছিল আমাদের স্বঘোষিত টিমলিডার । বল্টুকে আমরা সবাই অবশ্য টিমলিডার হিসাবেই মেনে নিয়েছিলাম, মাঝে মধ্যে শুধু মাষ্টারণীর সাথে একটু আধটু টক্কর লেগে যেত, তবে ওটা খুব সামান্য । বল্টুর আসল নাম বল্টুই ছিল, সাইজটা বল্টু বল্টু মার্কা বলে ওর নামটা আর বদলানো হয়নি ।
একদিন আমরা সবাই বসে আমার বাড়ির সামনে আড্ডা মারছি । আমাদের পুরনো দোতালা বাড়ি, সামনে আর পিছনে বড় উঠোন । সামনের উঠানে ছিল বিরাট একটা কাঁঠাল গাছ । সেটারই ছায়াতলে বসে আড্ডা মারছি, এমন সময় দেখলাম আমাদের সামনের একতলা টিনওয়ালা ছাদের বাসা থেকে নতুন একটা ছেলে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে । সাথে সাথে বিবিসি বলা শুরু করলো, “ দারোগা কাকুর ভাইয়ের ছেলে , দু’দিন হল এখানে এসেছে গ্রাম থেকে , ঢাকায় এসে পড়্রাশনা করবে বলে ।” ঢ্যাঙা সারাক্ষণ কুঁজো হয়ে বসতো কিন্তু হঠাৎ সটান করে সোজা হয়ে কেমন যেন ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো, “ এদিকে আসে কেন ?” টর্চ ভীষণ রেগেমেগে চেঁচাতে শুরু করলো, “আমাদের দলে ঢুকতে পারবে না, পারবে না, পারবে না.... ” আর মাষ্টারণী বলল, “হ্যাঁ দলের মেম্বার আর বাড়ানো ঠিক হবে না ।কিছু শেয়ার করতে গেলে ভাগে কম পড়বে ।” সবাই এই জ্ঞানের কথায় মুগ্ধ হয়ে সায় দিল । বল্টু হঠাৎ মাটির দিকে তাকিয়ে বলল “সবাই চুপ, শুনে ফেলবে । সবাই নরমাল ।” এত চাপা উত্তেজনার মাঝেও আমার কিন্তু চোখে পড়লো ছেলেটির হাতে লাল মলাট বাঁধানো বিশাল খাতাটির দিকে । এত বড় খাতা আগে কখনো দেখিনি । ছেলেটা আমাদের গেটে ঢুকে একেবারে কাছে চলে এলো । কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছে মাত্র আর অমনি ঢ্যাঙা মুখ ফসকে, “ তুমি আমাদের দলের মেম্বার হতে পারবে না ।” বলে কেমন বোকার মত তাকিয়ে রইলো ।
ছেলেটা হেসে ফেলল, “আমি তোমাদের দলের মেম্বার হতে আসিনি ।এখানে বসে ছবি আঁকা যাবে নাকি জিজ্ঞাসা করতে এসেছি ।”
মাষ্টারনী বলল, “ এটা তো সোহানাদের বাসা, ওর পারমিশন নিতে হবে ।”
“ সোহানা কে ?”
সবাই আমার দিকে তাকাল । প্রতিটা চোখে এমন আর্তি, আমি যেন ‘না’ বলি । ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম । কি করি, বন্ধুদের মন রাখতে গেলে কেমন যেন নিষ্ঠুরতা করা হয় । মনটা খচখচ করছিল । কিছুতেই ‘না’ শব্দটা মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না । এদিকে মাষ্টারণী পাশ থেকে সমানে চিমটি কাটছিল । অবস্থা বেগতিক দেখে কিছু না বুঝেই হঠাৎ বলে ফেললাম, “তুমি ছবি আঁক ?”
ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ”
“তোমার সাথে আছে কোনো ছবি ?”
“হ্যাঁ, এই যে এখানে ।” বলে লাল মলাটওয়ালা খাতাটা দেখাল ।
আমার ব্যাপার দেখে সবার চক্ষুচরকগাছ হয়ে গেল । আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমাদের দেখাবে ?”
ছেলেটা এবার খুব খুশী হয়ে, বিশাল একটা ‘হ্যাঁ’ বলে , মাটিতে আমাদের পাশে বসে পরে খাতাটা খোলা শুরু করলো । সবাই আগ্রহ ভরে খাতার উপর ঝুঁকে পড়লাম । ঢ্যাঙার নীচের চোয়ালটা ধপ করে ঝুলে পরে মুখটা একটা বিশাল হা হয়ে গেল । মাষ্টারণী খুব সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাসা করলো, “ এগুলো তুমি এঁকেছ ?”
ছেলেটা কেমন একটা গর্বিত ভাব নিয়ে হেসে মাথাটা ঝুকালো । মাষ্টারণীর কিছুতেই বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছিল না , বলল, “ এখন একটা ছবি এঁকে দেখাতে পারবে ?”
ছেলেটা আরো দশগুণ উৎসাহের সাথে বলল, “ এখানে বসার পারমিশন পেলে এঁকে দেখাতে পারবো ।”
সবাই আবার আমার দিকে তাকালো । আমি এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে বললাম, “ বসো ।” ঠিক পনের মিনিটের মধ্যে ঢ্যাঙার বিস্মিত মুখের এমন অভিব্যক্তিপূর্ণ অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবি এঁকে আমাদের সবাইকে তাক করে দিল যে, আমাদের টিমলিডার বল্টু স্বপ্রতিভ হয়ে বলল, “ তুমি আমাদের দলের মেম্বার হবে ?” সবাই বেশ আগ্রহ সহকারে হু হু করতে লাগলো । মাষ্টারনী বলল, “ স্কুলের হোমওয়ার্কের ছবি আঁকাতে ও আমাদের হেল্প করতে পারবে ।” মাষ্টারনীর এই পয়েন্টটাতে সবাই অনুভব করলাম আমাদের দলের মেম্বার হওয়াটা এই নবাগত ছেলেটির জন্য অনিবার্য হয়ে পড়েছে । তবে প্রথমে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে ছেলেটির সাথে, তাতে অনায়েসে সে ‘না’ বলে দিতে পারে । এই আশঙ্কায়, মানে আমাদের দলের এত বড় একজন প্রতিভাবান আর্টিস্টকে হারানোর আশঙ্কায় (যার ঘাড়ের উপর ড্রয়িং হোম ওয়ার্ক চাপানো যাবে) আমরা চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে ওর উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
আগের মতই এক গাল হেসে ছেলেটি বলল, “ অবশ্যই হেল্প করবো ! আমার নাম সাগর । তোমাদের নামগুলো কি ?”
সেদিন বুঝিনি এই সাগরই যে আমার জীবনে কি সাংঘাতিক হেল্প করবে ।
......চলবে
১ম পর্ব