অভিশাপ .....................দিনু
সকালে ক্লাশে যাবার সময় দরজার নিচে চিঠিটা চোখে পড়ে তানভীর রহমানের । হাতে তুলে নিয়ে প্রথমেই To এর নিচে নিজের নাম দেখে নিশ্চিত হলেন চিঠিটা ঠিক ঠিকানাতেই এসেছে । খাম খুলে চিঠি পড়লেন তিনি , তারপর পঁচাত্তর কিলোগ্রামের শরীরকে নিয়ে এমনভাবে শূন্যে লাফ দিলেন যেন তার বয়স তারপর পঁয়তাল্লিশ নয় বরং ২১ । হুম তিনি আজ খুশি, অনেক খুশি । খুশির সংবাদ সবার আগে প্রিয় মানুষদের দিতে হয় এটা নাকি নিয়ম । বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তানভীর রহমান তার মা বাবাকে হারিয়েছেন graduation এর আগেই, তারপর থেকে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি । আত্মীয় স্বজনদের সাথেও তাই আর যোগাযোগ নেই । মনে মনে প্রিয় মানুষদের খোঁজ করতে লাগলেন । কিন্তু Nano Technology নিয়ে তার প্রথম Paper " Impact of Nano Fiber on Human Respiratory System" শীর্ষক সেমিনারে Accept হয়েছে এই খবর শোনানোর মত তার কোন প্রিয় মানুষ নেই, কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতে খুশি মনের রঙ্গিন রংটা হঠাৎ করেই সাদাকালো হয়ে যায় । একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঘর তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন ।
আজ শনিবার । রাত সাড়ে ১১ টায় Flight প্রফেসর তানভীর রহমানের । ঢাকা থেকে অটোয়া পৌছতে সময় লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা । ২ ঘন্টা আগে বোর্ডিং এর জন্য Airport এ থাকতে হয় সেই হিসেবে সাড়ে ৯ টার মধ্যে পৌছলেই চলবে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত এই প্রকৌশলী গবেষক একটু আগেই বের হলেন বাসা থেকে । তিনি গেলেন বেগুনবাড়ির এক বস্তিতে । এই বস্তির প্রতিটি মানুষ তানভীর সাহেবকে চেনে মাস্টার সাহেব নামে। তিনি প্রতি সপ্তাহে এখানে আসেন এখানে । একেক সপ্তাহে একেক জনের ঘরে দুপুরের খাবার খান । আর এক বুড়ির জন্য ২ হাজার টাকা ওই ঘরের কর্তাকে বুঝিয়ে দিয়ে বুড়িকে দেখাশোনা করার জন্য বলেন । তিনি জানেন বুড়ির জন্য দেয়া সবগুল টাকা কেবল বুড়ির জন্যই ব্যয় হয় না ব্যয় হয় ওই ঘরের মানুষদের জন্যও । আসলে প্রকৃতি বড় বিচিত্র তার চায়েও বেশি বিচিত্র মানুষের মন, এই জগত সংসারে আপন বলতে যার কেউ নাই সেই কিনা অচেনা অজানা মানুষকে আপনের চেয়েও বেশি আপন করে নিয়েছে । মানুষ যে ভাবেই থাকুক না কেন তার অবচেতন মন সব সময় আপন মানুষের খোঁজ করে হোক না সে রক্তের বন্ধনহীন ।
তানভীর রহমানের উচ্চতা ভীতি (Altitude phobia ) আছে কিন্তু তারপরেও তিনি জানালার পাশের সিটের জন্য সবসময় Request করেন । মানুষ ভয়কে জয় করতে চায় তাই হয়ত তার মন নিজের অজান্তেই জানালার পাশের সিটে বসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে । প্লেন Take Off এর আগে সিট বেল্ট বাধার সময় মিষ্টি একটা শিশু তাকে বলে
-“Would you be please help me?”
-- Sure
তানভীর সাহেব বাচ্চাটিকে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
--Whats your name?
- I’m Nitu, and you?
-- I am Tanvir.
নিতুর গায়ের রং শামা কিন্তু চোখদুটো নীল । সেই নীল চোখের গাঢ়তা যে কোন মানুষকেই তার প্রতি স্নেহশীল এবং তার জন্য ভালোবাসার উদ্রেক করবে তানভীর সাহেব যখন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উল্টোদিকে মুখ করে থাকা নিতুর মায়ের দিকে তাকালেন আর ভুল দেখছেন ভেবে আবার তাকালেন । না, ভুল দেখছেন না তিনি; মেয়েটা নাইমা ই তো । “নাইমা ?” নিজের ঠোঁটের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে কখন যে ডাকটা নিতুর মা তথা নাইমার কান অব্ধি পৌঁছল তানভীর সাহেব তা নিজেও জানেন না । “কেমন আছো তুমি ?” নাইমা জিজ্ঞেস করল । “কেমন আছেন” প্রতিনিয়ত শুনতে অভ্যস্ত তানভীর সাহেবের কান যখন এই “কেমন আছো” বাক্যটি শুনলেন তখন গবেষকের মোড়কে মোড়া মানুষ তানভীর রহামান নিজেকে নিয়ে অনেকদিন পর একবার ভাববার সময় পেলেন আসলেই কেমন আছেন তিনি ।
- এইতো চলে যাচ্ছে , তুমি কেমন আছো ?
= ভালো । Canada যাচ্ছ কেন?
- একটা seminar আছে সেখানে, আমার একটা paper publish হবে । তোমার husband কি করেন ?
= গত বছর car accident এ ও আমদের রেখে চলে যায়” । বলতে বলতে নাইমার চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে ।
সেই ছলছল চোখ দুটো তানভীর সাহেবের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয় । নিজেই নিজের মনেকে বলে ওঠে এই চোখের জল তো মেয়েটা একদিন আমার জন্যই ফেলতে চেয়েছিল ।
সকালটা ছিল বর্ষার । কি কারণে যেন class suspend হয়েছিল । মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছিলো কারণ আজ নাইমার সাথে দেখা হবে । হুম নাইমা তাসভি নামের এই মেয়েটি মফঃস্বল থেকে আসা দরিদ্র তানভীরের জীবনের চিন্তা ধারা পুরোটা পাল্টে দিয়েছে । Typical Middle Class Family r চিন্তা যেমন থাকে – পড়াশোনার পরে চাকরি, তারপর ঘর সংসার , হাবিবের মনকে এই চিন্তার বৃত্ত থেকে বের করে আনা মেয়েটির নাম নাইমা । জীবনের প্রথম ভালবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করা মেয়েটির নাম নাইমা । অন্তর্মুখী স্বভাবের ছেলে হাবিবের জীবনের সেই দিনটি ছিল ২১ শে এপ্রিল যেদিন নাইমা নামের বান্ধবিটি তার হাতটা ধরে বলেছিল
“ তোর হাতটা আমি সারা জীবনের জন্য ধরে থাকতে চাই” ।
তারপর একসময় তুই থেকে তুমিতে প্রত্যাবর্তন হয় দুজনের মুখের ভাষা ।
আধা ঘণ্টা হয়ে গেল অথচ নাইমা এখনও এল না । নাইমা আজকে ক্লাসে আসে নি । কিন্তু আজ তাদের দেখা করার কথা তানভীরকে বলেছিল সাড়ে ১১ টায় থাকবে সে । এখন বাজে পৌনে বারটা । তানভীরের সমস্যা এইটাই নাইমার একটু আসতে দেরি হলেই মনের মধ্যে হাজার আজে বাজে চিন্তা ভির করতে থাকে; ওর শরীর ভালো আছে তো ? রাস্তায় কোন কিছু হয় নি তো এমনকি accident এর চিন্তাও মাথা ভীড় করে । তানভীরের এই সব দুঃচিন্তার মধ্যেই নাইমা এল । তার মুখটা আজ ভীষণ রকমের শুকনা লাগছে , চোখের নিচে কালি পড়েছে , চুলগুলোও উস্ক রুক্ষ ।
= কি হয়েছে তোমার ? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে ?
নাইমা কিছু বলল না, শুধু তানভীরের হাতটা ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো ।
কোন মানুষ তার সামনে কাঁদলে কি করা উচিৎ সেটা তানভীর কখনই নির্ণয় করতে পারত না , আজও পারছে না, তাই চুপ করে থাকল । হঠাৎ নাইমা নিজে থেকেই বলতে শুরু করে “কাল বাসায় আমাকে দেখাতে আসে বাবার এক বন্ধু ও তার full family । ছেলে কানাডা থাকে, কিসে জানি job করে । তারা আমাকে পছন্দ করে এবং কালই আমকে engagement ring পড়িয়ে যায় । আমি তোমার কথা মাকে বলেছি কিন্তু মা বলেছে 2nd year এ পরা যে ছেলের চাল চুলা কিছু নেই তার কছে মেয়ে বিয়ে দেব কোন যুক্তিতে । কিন্তু আমি কোন যুক্তি মানতে চাই ন্ আমি শুধু তোমাকেই চাই, শুধু তোমাকে” । কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাইমা তানভীরের মুখের দিকে তাকায় ।
“তোমার মা ভুল কিছু বলেন নি । তোমাকে বিয়ে করলে আমি কি খাওয়াব তোমাকে । বাস্তব আর কল্পনা অনেক অনেক বেশি দূরত্বে অবস্থান করে সরমি । বাবা মা যা করে সন্তানের ভালোর জন্যই করে । তুমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাও । আমার কিছুই করার নেই” । মাথা নিচু করে কথাগুলো বলে তানভীর । নাইমার চোখের দিকে তাকানর সাহস নেই তার ।
“তোমার সত্যই কিছু করার নেই” ? অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিয়ে তানভীর দিকে তাকিয়ে বলে নাইমা । এই হল মানুষের মন, এক বছরের পরিচিত যে মানুষটিকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভালোবাসার স্বপ্ন বুনেছে তার একটি কথাই সেই স্বপ্ন বোনা মানুষটির হৃদয়ে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণার জন্ম দেয় ।
তানভীর চুপ করে থাকে । নাইমা শেষ বারের মত তানভীরের দিকে তাকায় । ভালো থেকো তুমি, অনেক অনেক ভালো থেকো । তুমি এতটা ভালো থেকো যেন তোমার ঘরে কেউ কোনদিন ভেতর থেকে দরজা খুলে না দেয় । আমি অভিশাপ দিচ্ছি তুমি এতটাই ভালো থেকো যেন তোমার ঘরে কোনদিন সন্ধ্যা প্রদীপ না জ্বলে । আমি অভিশাপ দিচ্ছি তুমি এতটাই ভালো থেকো যেন তোমার জন্য কেউ কোনদিন রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা না করে”।
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল মুষলধারে । নাইমা সেই বৃষ্টিতে চলে গেল । তার চোখ তখনও অঝোর ধারায় ঝরছিল যা তানভীরের দৃষ্টিকে স্পর্শ করতে পারে নি কিন্তু মনকে স্পর্শ করেছিল । কিন্তু বাস্তবতার কঠিন শেকলে আবদ্ধ তানভীরের মন নিজেই নিজেকে বলে ওঠে “ আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে কষ্টে রাখতে পারব না” । পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই । তাই হয়ত কান্না আড়াল করার জন্যই বৃষ্টিতে হাঁটতে শুরু করে তানভীর । সেই বৃষ্টি কলেজে লেখা নিজের একটা কবিতা মনে করিয়ে দেয় তানভীরকে
তুমি চলে গেছো বেশ আগে, বৃষ্টি থামারও আগে
অভিশম্পাতিত হৃদয় আর বুকভরা কান্না নিয়ে
ভালবাসি, তাই ফিরিয়ে দিয়েছি তোমাকে
আমার নিত্য-সাথী দারিদ্রতা থেকে ।
প্লেন মেঘের মধ্যে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না । সেই অন্ধকার দেখতে দেখতে আপন মনে তানভীর সাহেব যখন নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ করছিলেন নাইমা তখন জিজ্ঞেস করল
- দেশের বাইরে যাচ্ছ, তোমার বউকে সাথে নাও নি কেন ?
= বিয়েই তো করিনি, বউ আসবে কোথা থেকে ?
- বিয়ে করনি কেন ?
= তোমার দেয়া অভিশাপ মিথ্যে হয়ে যাবে বলে ।
নাইমার চোখ আবার অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে । কিন্তু সেই অশ্রু তানভীর সাহেবের জন্য মূল্যহীন ভালবাসায় না করুণায় তা বোঝা গেল না ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


