বাইক থেকে বাসর - অনুরাধা এবং আমি............ ..দিনু
বাইকটা কিনেই ফেললাম অবশেষে । প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বাস- যুদ্ধ সাথে জ্যাম-যন্ত্রণা, সব মিলিয়ে মুক্তির সহজ ও সস্তা উপায় এটা । মটর সাইকেলে বেশি Accident হয় এই চিরায়ত অজুহাত দেখিয়ে আম্মু নিষেধ করেছিল কিনতে, কিন্তু প্রয়োজন ও ভাব দেখানোর তাগাদায় নিষেধটা আর টেকেনি ।
আজ রবিবার, সপ্তাহের প্রথম অফিস । নতুন বাইক নিয়ে আজকেই প্রথম বের হচ্ছি – একটু ভাবেই আছি বলতে হবে । মেইন রোডে এসে দেখি বাসের জন্য অপেক্ষারত মানুষের অস্বাভাবিক ভিড় । ভিড়ের কারণ আমাদের জন দরদী(!) কোন এক রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশ । মহাসমাবেশকে বিফল করার নিমিত্তে সরকারী দল সকল বাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে জনগণের মহা কল্যাণ (!) সাধন করছে । বাইক নিয়ে বাস Counter এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনলাম এক পরিচিত কণ্ঠস্বরের । পেছনে ফিরে দেখি সাদা ওড়নায় মাথা ঢাকা নীল চুড়িদার সালোয়ার- কামিজের উপর শুভ্র আপ্রন পরিহিত অনুরাধা । বুঝলাম অপেক্ষারত মানুষের ভিড়ের মাঝে সেও একজন । ওর অবস্থা বুঝে বললাম “ওঠ” ।
সে বাইকে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল “কবে কিনলেন ? অফিস যাচ্ছেন ? ঠিকমত চালাতে পারেন তো ?
এই মেয়েটা এরকমই , যখন প্রশ্ন করা শুরু করে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ।
= কাল কিনেছি ,আজই প্রথম বের হচ্ছি ।
-মানে আমি আপনার প্রথম পাসেঞ্জার ।
বলেই শব্দহীন হাসি । মনে মনে বললাম “আমি তো এতাই চেয়েছিলাম” ।
অনুরাধা তার বাম হাতটা দিয়ে পেছনে carrier এর plastic টা ধরে রেখেছে বেশ শক্ত করেই । মোটর সাইকেল ভালই চালাচ্ছিলাম কিন্তু সামনের বাসটা হঠাৎ করেই ব্রেক করল, অগত্যা আমাকেও hard break করতে হল । অনুরাধার তার ডান হাতটা আমার কাঁধে রেখে দুজনের মাঝে সংঘর্ষ এড়াল এবং বলল “আস্তে চালান”। কাজটা আমি ইচ্ছা করে করিনি তাই sorry বলার প্রশ্নই আসে না তারপরেও সে আবার কি মনে করে তাই বললাম Sorry . তারপর সারা রাস্তা তার ডান হাতটা আমার কাঁধেই রইল, তবে সেটা ভবিষ্যৎ ব্রেকের আশংকায় না পরম নির্ভরতায় সেটা বোঝা গেল না !
বাস চলাচল কম ছিল তাই রাস্তা ফাঁকাই ছিল । বেশ দ্রুতই তাই শাহবাগ চলে আসলাম । ওর মেডিকেল কলেজের সামনে এসে বাইক থামালাম । মেয়েটা কোন কথা না বলে ওর স্বভাব সুলভ দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে গেল ! “সামান্য একটা থ্যাংকস দেয়ার চিন্তাও করল না” এ কেমন মেয়ে ! – এই চিন্তা করতে করতে আমি মতিঝিল চলে আসলাম ।
অফিসে গিয়ে cell phone টা হাতে নিয়ে দেখি অনুরাধার একটা এসএমএস
Thanks a lot. I need your motor cycle lift on every Thursday.
আমি কোন Reply দিলাম না ।
আজ বৃহঃস্পতি বার । “Be at bus counter sharply at 9.15” – sms টা পাঠিয়ে বাসা থেকে বের হলাম । বাস counter এ এসে দেখি অনুরাধা আগে থেকেই wait করছে । বাইকটা ওর সামনে থামালাম । ও নিশ্চুপে ওঠে পড়ল ।
এভাবে প্রতি বৃহঃস্পতি বার আমি অনুরাধাকে কলেজে পৌঁছে দিতে দিতে কিভাবে যে একটা বছর কেটে গেল! এর মানে এটা নয় যে অনুরাধা আমার প্রেমে পড়েছে । আর আমি, সে তো বাইক কেনার বহু আগেই তার প্রেমে পরেছি । সেই প্রথম দিন তার হাত আমার কাঁধে উঠেছিল তারপর আর ওঠে নি ।
গত বছর এই দিন রবিবার ছিল আজ সোমবার । সকালে ঘুম ভেঙে যায় অনুরাধার ফোনে ।
- আজ আপনার সাথে কলেজে যাব, ঠিক ৮ টায় থাকবেন, একটু তারাতারি যেতে হবে ।
=আজ তো বৃহস্পতিবার না।
- আমি জানি, আপনার কোন problem আছে ?
= না নাই ।
এরপর লাইনটা কেটে দেয় সে ।
এখন ৮ টা ৫ বাজে তার আসার নাম নেই । আমি খুব অস্থির প্রকৃতির মানুষ বিশেষ করে কারও জন্য wait করার ক্ষেত্রে সেই অস্থিরতা চরম পর্যায়ে চলে যায় । তাই call করলাম, call কেটে দিল সে । বুঝলাম হয়তো এসে পড়েছে । সে আসল কিন্তু সেটা আরও ১৫ মিনিট পরে । ইচ্ছা হচ্ছিল আজ ওকে প্রচণ্ড একটা ঝারি দেব কিন্তু যখন ওকে দেখলাম দেখি একটা পরী । নীল শাড়িতে ঢাকা এক নীল পরী । এই পরীকে কিভাবে বকা দেব আমি !
-কি ব্যাপার আজ এত সাজগোজ ? কলেজে কি কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি ?
= আরে নাহ , কলেজ তো বন্ধ ।
-তাহলে তুমি যে বললে কলেজে যাবা ?
=মিথ্যে বলেছি । আজ Dating এ যাব , তারাতারি চলেন তো ও বোধহয়য় চলে আসছে ।
আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি বাইকে করে নিয়ে যাচ্ছি তার Dating এ, প্রকৃতির কি নির্মম রসিকতা !
৯ টার মধ্যেই শাহবাগ এসে পড়লাম । বললাম
-নামো
=এখানে নামব না মধুর canteen এ চলেন ।
৫ মিনিটের মধ্যেই মধুর canteen এ চলে আসলাম ।
ও নামল, বলল “চলেন আমার সাথে” ।
= তোমাদের dating এ আমি গিয়ে কি করব ?
-আমি বলছি তাই যাবেন ।
= আমার অফিস আছে
“একদিন অফিস না করলে কিছু হয় না” বলেই আমার হাতটা ধরে ও ভেতরে নিয়ে গেল ।
আমরা দুজন বসে আছি । একটু পরে ছেলেটা আসল। ছেলেটা মানে অনুরাধার প্রেমিক । লম্বা উচ্চতার সাথে যুগল কালো ভ্রু, তার নিচে একজোড়া মায়াবী চোখ, সেই চোখের মায়ায় অনুরাধা কেন যে কোন মেয়েই পড়তে বাধ্য । আর চেহারা যেন সাক্ষাৎ রাজপুত্র । ছেলেটার নাম আমি জানি কিন্তু তাকে রাজপুত্র নামেই পরিচিত করতে ভালো লাগছে তাই তার আসল নামটা আপনাদেরকে বলছি না ।
অনুরাধা পরিচয় করিয়ে দিল । রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে বলল “ তোমাকে কাল যার কথা বলেছিলাম ইনি আমার সেই ভালোবাসার মানুষ” । তার কথা শুনে আমি আর রাজপুত্র দুইজনই অবাক । আমার অবাক হওয়া যথেষ্ট logical কিন্তু রাজপুত্রের অবাক হওয়ার বাপারটা বুঝলাম না । তিনজন একসাথে চা খেলাম ।
অনুরাধা আবার বাইকের পেছনে উঠল আর বলল চলেন লং ড্রাইভে যাব” ।
-আমার এটা তো ৪ চাকা না, ২ চাকা” ।
=আমি ২ চাকাতেই যাব ।
বাইক চলছে, অনুরাধার হাতটা আমার কাঁধে তবে তাতে কোন অজানা হার্ড ব্রেকের আশংকা নেই আছে পরম নির্ভরতার ছোঁয়া ।
-আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে আমি আপনার বাইকে প্রথম উঠি ? আপনার মনে আছে?
= হ্যাঁ ? কিন্তু মুখের ভাষা আপনি কেন ?
-জানি না ।
অনুরাধার মুখে লজ্জার আভা, যে আভা আমি হয়তো দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু অনুভব করতে পারছি ।
নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন মনে হচ্ছে । কিন্তু মানুষের সুখের সময় নাকি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না । তাই বোধকরি পাশে থেকে একটা পিক –আপ আমার বাইকটাকে ধাক্কা দেয় ।
আমার জ্ঞান ফিরলে বুঝলাম আমি আমি হাসপাতালের বিছানায়, চোখ সহ পুরো মাথা ব্যান্ডেজে বাধা । কেউ একজন আমার হাতটা ধরে আছে তাতে টপটপ করে পানি পড়ছে কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না । এই কান্না করা মানুষটির সাথে আমি আমার জীবনের প্রথম দিন থেকে পরিচিত – এটা আমার মা ।
-মা কাঁদছ কেন?
=কোথায় কাঁদছি , হাতের উপর গ্লাস থেকে পানি পড়েছিল ।
আমি জানি মা কাঁদছে কিন্তু মা স্বীকার করছে না ।
-আচ্ছা মা আমার চোখে ব্যান্ডেজ কেন ?
= এমনি !
আমি বুঝতে পারছি মা কিছু লুকচ্ছে, Accident এ আমার চোখে বড় কোন সমস্যা হয়েছে । আমার sixth sense ভালো কাজ করে ।
মাথার ব্যান্ডেজ কয়েকদিনের মধ্যেই খুলে দেয় ডাক্তার । মাথায় নাকি ৫ টা সেলাই দিতে হয়েছে, কপালে ২ টা সেলাইয়ের দাগ রয়ে গেছে । কিন্তু চোখের ব্যান্ডেজ খুলবে আগামি সপ্তাহে ।
আজ চোখের ব্যান্ডেজ খোলার দিন । গজ কাপড় গুলো কেটে ডাক্তার আমাকে বললেন “আস্তে আস্তে চোখ খুলেন”।
চোখ মেলে দেখি মা নিরবে কাঁদছে আর প্রার্থনা করছে ।
“আমার সামনের সবাইকে আমি দেখতে পারছি মা” - আমার আনন্দ -চিৎকার ।
তখন আমার কেবিনের সবার মুখে হাসি শুধু আপ্রন পরা একজন বাদে, যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তখনও চোখে মুছছিল ! তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে যেন তার জন্যই আমার এই অবস্থা ।
আমার কপালের ২ টা সেলাইয়ের দিকে তাকিয়ে আজও সে কাঁদছে । আমি তাকে আমার বুকের মাঝে নিয়ে বললাম “ধুর বোকা আজকে কান্না কেন?” সে কিছু বলল না শুধু আমার কপালে ২ টা চুমু দিল ।
আজ আমাদের বাসর রাত । পাঠকেরা সবাই যান ঘুমান!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


