প্রথম পর্বঃ জীবন যেমন-১ (একটি সাধারণ কাহিনী)
দ্বিতীয় পর্বঃ জীবন যেমন-২
৭.
জানি না কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম ভেঙ্গে গেল এয়ারহোস্টেসের ঘোষণায়, কিছুক্ষণ পরেই প্লেনটা ল্যান্ড করবে। হাতব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত হলাম নামার জন্য। প্লেন ল্যান্ডের পর সমস্ত কার্যাবলী সম্পন্ন করে বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে, দেখলাম আমার নাম লেখা কার্ড নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। উনি যে গাড়ি নিয়ে এসেছেন তাতে উঠে বসলাম, আর গাড়ি চলতে লাগল আমার নুতন গন্তব্যের দিকে, যেটা সম্ভবত হতে যাচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ বাসস্থান। গাড়ির সীটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ উল্টে যেতে লাগলাম স্মৃতির এক একটা পাতা। দেশে রেখে আসা পরিবার পরিজন সবাইকে মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল তাকেও। জানি না সে কী করছে বা কোথায় আছে-৫টা বছর তো আর কম সময় না। ইচ্ছে করছিল তার সাথে একবার যোগাযোগ করতে, কিন্তু তা বড়ই বিব্রতকর হত। কারণ আমিই তো তার সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম, তার মেইল, ম্যাসেজ, ফোন কল এড়াতে নিজের ফোন নম্বর, ইমেইল এড্রেস পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম। এ অভিমানেও হয়ত সে আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখে নি, এমনকি বন্ধুদের মাধ্যমেও না। কেননা সে বাইরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আমি এক বন্ধু মারফত তাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে আমার জীবনে বিশেষ কারো আগমণ ঘটেছে, আর এজন্যই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি আমি, যদিও কথাটা ছিল সর্বৈব মিথ্যা। বছরখানেক আগে একবার শুনেছিলাম যে সে শিগগীরই বিয়ে করছে তারই এক সহপাঠীকে, মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে যে যাক, আমার মিথ্যেটা কাজে লেগেছে তা হলে, সে তার যোগ্য কাউকে পেয়ে গেছে। কিন্তু আমার জীবনে তার যে স্থান, এটা কি আমি অন্য কাউকে দিতে পারতাম? না, পারতাম না, তাই তো পরিবারের শত অনুরোধ সত্বেও বিয়েটা করা হয় নি আর। এতে সবার যে বিরূপ প্রক্রিয়া হয়েছিল, তা থেকেই বাঁচতে যেন আমার এ স্বেচ্ছা নির্বাসন, আর তাও এমন এক দেশে যেখানে পরিয়ার পরিজনই শুধু নয়, তার কাছাকাছি হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল না। নিজেকে তাই মনে হচ্ছিল এক ক্লান্ত সামুদ্রিক নাবিক, যার জীবনের তরী পাকাপাকিভাবে ভিড়ে গেছে নিঃসঙ্গতার বন্দরে....
৮.
বাসায় এসে গুছিয়ে বসতে না বসতেই দেখি মোবাইল ফোনে অনেকগুলো ম্যাসেজ। দেশ থেকেই ফোনটা রোমিং করে নিয়ে গিয়েছিলাম। একে একে সবার সাথে ল্যান্ডফোন দিয়ে কথা বললাম, জানিয়ে দিলাম শিগগীরই মোবাইল ফোন নেওয়ার কথা। আমার হাউসমেটের সাহায্যে ল্যাপটপে ইন্টারনেট সেট আপ করে মেইল চেক করলাম। দেখি একটা অপ্রত্যাশিত নিমন্ত্রণ-এখানে বর্তমানে স্থায়ী আমার কলেজের প্রাক্তন এক সহপাঠী ও অত্যন্ত প্রিয় বান্ধবী তার বাসায় আগামীকাল এক পার্টির আয়োজন করেছে সকল বাঙ্গালি বন্ধুদের নিয়ে। যেহেতু তাকে আগেই জানিয়েছিলাম আমার আসার কথা, তাই আমাকে মেইল করে অনুরোধ করেছে যাওয়ার জন্য। একবার ভাবলাম না করে দিই, পরে আবার চিন্তা করলাম যে হয়ত গেলে অনেকের সাথেই পরিচিত হওয়া যাবে, তাই রাজি হলাম। ঠিক করেছিলাম বেশিক্ষণ থাকব না, কিন্তু তখন কি আর জানতাম, যে এই যাওয়াটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে? সত্যি তা ভাবি নি, ভাবতে পারার কথাও না.....
৯.
পার্টিতে আসার সাথে সাথেই বন্ধু এগিয়ে এল অভ্যর্থনা জানাতে-প্রায় ৬ বছর পরে দেখলাম ওকে, বিয়ে করেছে, স্বামী আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক, যেখানে অধ্যায়ন হেতু আমার এদেশে আগমণ। কুশলাদি বিনিময়ের পর আমাকে নিয়ে গেল অপরিচিত কিছু মানুষের মাঝে, যাদের কেউ কেউ ওর স্বামীর কলিগ, কেউবা আমার নুতন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য সহপাঠী। হঠাৎ বন্ধুটি পিছন থেকে কাউকে ডাকল আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। ঘুরে তাকাতে যা দেখলাম, তা কখনোই চিন্তা করি নি-আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই মানুষটি, যার স্মৃতি আমার মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে অনন্তকালের জন্য, যার এক মুহূর্তের সান্নিধ্য ছিল আমার কাছে সহস্র বছরের সাধনালদ্ধ অর্জন, যদিও তাকে এড়িয়ে চলার জন্য আমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না কখনোই। মনে জোরে নিজেকে সংযত করে যন্ত্রের মত কুশলাদি বিনিময় করে সরে গেলাম তার সামনে থেকে, বাইরে বেরিয়ে এসে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, হঠাৎ পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে দেখি, আবারো সে, হাসিমুখে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল-
"কেমন আছ?"
"ভাল, আপনি?"
"আমার যতদুর মনে পড়ে আমরা পরস্পরকে তুমি করে বলতাম, তাই না?"
"না মানে, অনেকদিন পরে দেখা তো, তাই....."
"তোমার মনে আছে, প্রথম পরিচয়ের দিনেও তুমি আপনাকে আপনি করে বলেছিলে, পরে আমিই সেটা থেকে তুমিতে গিয়েছিলাম।"
"মনে আছে"
"যাকগে, এখন বল, কি করছ? এখানে কি পড়াশোনার জন্য, না স্বামীর সাথে চলে এসেছ? ওহ ভাল কথা, তোমার স্বামীকে দেখছি না যে, উনি আসেন নি?"
"না মানে....ও এখানে নেই, মানে আরো কিছুদিন পরে আসবে, ভিসা পেতে একটু দেরি হয়েছে" (মিথ্যে বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তাও চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওর চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না)
এরপরে দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ, অতঃপর নীরবতা ভেঙ্গে আমিই এবার প্রশ্ন করলাম-
"তোমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করাবে না?"
"হ্যাঁ, কেন না, ও আসবে একটু পরেই, কাজ শেষ করে ফিরতে দেরি হয়েছিল কিনা, তাই আসতেও দেরি হচ্ছে একটু।"
জানি না কেন, ওর মুখে ওর স্ত্রীর কথা শুনে গলার কাছটায় একটা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে উঠল, বুকটাও হু হু করে উঠল, অথচ এগুলোর কোনটারই এখন আর কোন অর্থ নেই। "একটু আসছি" বলে দলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ডাক পড়ল তার থেকে-"শোন"
"বল, কিছু লাগবে তোমার?"
সে এগিয়ে এল আমার কাছাকাছি, আমার বুকটা অসম্ভব কাঁপছিল তখন, মনে হচ্ছিল প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন গলতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছিল আর দাঁড়াতে পারছি না, আর সে তখন আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল-
"তুমি এখনো আমার চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলতে শেখো নি"
"মিথ্যে?....."কি-ক্কিসের মিথ্যে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না...."
"এদিকে তাকাও" চাপা স্বরে যেন গর্জে উঠল সে, আমার হাত চেপে ধরে আমাকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করালো-"আমার চোখের দিকে তাকাও। এবার বল, তুমি বিবাহিতা। বল, তুমি অন্য কারো, বল, চুপ করে থেক না, বল, বল, বল-তুমি আমার নও!"
বজ্রাহতের মত আমি নিশ্চুপ চেয়ে রইলাম তার দিকে, কিছুই বলতে পারলাম না, সে-ই আবার বলতে শুরু করল-"তুমি ভেবেছ আমি কিছুই জানি না, সূচনা আমাকে সব বলে দিয়েছে!"
(সূচনাই হচ্ছে আমার সেই বন্ধু, যার মারফতে ওকে আমি মিথ্যে সংবাদ দিয়েছিলাম যে আমি বিয়ে করে ফেলেছি, যখন "ন" এর সাথে ওর বিদেশে পড়তে গিয়ে দেখা হয়েছিল। এমনকি এই সূচনাই আমাকে জানিয়েছিল "ন"-এর সম্ভাব্য বিয়ের কথা, তাই খুব আশ্চর্য হলাম যে সূচনা কেন সত্যিটা বলতে গেল ওকে, ওর বিয়ের কথা পাকা জেনেও।)
আবার কথা শুরু করল সে-"আমি ৫টা বছর অপেক্ষা করেছি, কিন্তু কোন জবাব তোমার কাছে থেকে পাই নি। ছুঁড়ে ফেলেছিলে তুমি আমাকে নিজের জীবন থেকে, কিন্তু মন থেকে কি মুছতে পেরেছিলে? পার নি, আর পারবেও না, কারণ তুমি আমার, শুধুই আমার।"
আর চুপ করে থাকতে পারলাম না আমি-"ছিঃ, এসব কথা শোনাও পাপ, কারণ আজ তুমি নিজেই অন্যের, প্লিজ আমাকে যেতে দাও"
"সব কথা না শুনে তুমি যেতে পারবে না। তুমি কি মনে কর, আমার জীবন থেকে সরে গিয়ে তুমি খুব মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছ? যে খেলা তুমি খেলতে পার সেটা আরো কেউ ও খেলতে পারে, বুঝেছ?"
"মানে? কি বলতে চাও তুমি?" পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।
"তুমি কেন এটা বুঝ নি, আমি যে মনে শুধু তোমারই আরাধনা করেছি, সে মনে অন্য কেউ এসে জাঁকিয়ে বসবে, আর আমি তা হতে দেব? তোমার বিয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমি শেষ হয়ে গিয়েছি, দিনের পর দিন উন্মাদের মত আচরণ করেছি, খাওয়া দাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা সব শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার। আমার এই অবস্থা দেখেই সূচনা বাধ্য হয়ে সত্যিটা আমাকে বলে দেয়। তাই তোমার মুখ থেকে সত্যের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য বিয়ের মিথ্যে খবর দিতে হয়েছে আমাকে, তোমার কাছে। এখন বল, কেন এমন করলে তুমি? বিশ্বাস ছিল না আমার ওপর, আমার ভালবাসার ওপর? বল, চুপ করে থেক না অন্তরা, বল"
অশ্রুসজল চোখে তাকালাম ওর দিকে আমি, কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম-"তোমার ওপর বিশ্বাস আমি কখনোই হারাতে পারি না। কিন্তু নিজের ওপর তো বিশ্বাস ছিল না, ভয় হচ্ছিল, তোমার জীবনে হয়ত আমি সে দুর্বার উল্কাপিন্ডের মত আবির্ভুত হব, যা তোমার জগৎটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে......"
"প্লিজ এভাবে বলো না", আমার মুখের ওপর আলতো হাত রেখে আমাকে কথা শেষ করতে দিল না আর। "৫-৫টা বছর আমার হৃদয়ের এ ঊষর মরুভূমি শুধুই তোমার ভালবাসায় সিক্ত হয়ার অপেক্ষায় ছিল। দোষটা আমারই ছিল, আম নিজেই সাহস করে তোমাকে আমার মনের কথা বলতে পাই নি। আজ এ মিলন লগ্নে তাই আমার সমস্ত আকুতি নিয়ে তোমার কাছে এসেছি, বল, ভালবাসবে আমায়?"
কি বলব আমি? কি বলারই বা আছে আর? যাকে এত করে চেয়েছি, যার ভালবাসাকে বুকে ধারণ করে বরণ করে নিয়েছিলাম অসহনীয় একাকিত্বকে, পরম আরাধ্যের অশেষ কৃপায় আজ সে আমারই হতে যাচ্ছে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মত ধৃষ্টতা কি আমার মত নগণ্যের আছে? না, কখনোই না.....
(শেষ)