somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নেরা জেগে থাকে আঁধার রাতে পিদিম জ্বেলে

১৩ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেল তসলিম সাহেবের। মনে হলো ঘুমের ঘোরে নিজের নাম শুনছেন। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন শব্দগুলো। মনে হলো কেবিনের দেয়ালগুলো যেন থরথর করে কাঁপছে। পিজির সামনে তুমুল মিছিল! মুহূর্মুহূ শ্লোগান দিচ্ছে বেশকিছু তরুণ ছেলেপেলে। বেল টিপে নার্সকে ডাকলেন তসলিম সাহেব।
ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো নার্স। চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। তসলিম সাহেবের কাছে মনে হয় কিছু একটা অস্বস্তি লুকাতে চাইছেন।
তসলিম সাহেবঃ কিসের মিছিল?
নার্সঃ ইয়ে মানে, আপনার মুক্তির দাবীতে মিছিল হচ্ছে! হাসপাতালে পুলিশ প্রহরা বেড়েছে, ডিবির লোকেরাও এসে ঝামেলা করছে ডাক্তারদের সাথে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তসলিম সাহেবের বুক চিরে। মনে পড়ে গেল, প্রায় এক বছর আগের কথা! শাহবাগের জাদুঘরের সামনে তারা সমমনা বেশ কয়েকজন জড়ো হয়েছিলেন মোমবাতি হাতে। রাস্তার মাঝখানে গোল করে মোম জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন ট্রাইবুনালের রায়ের। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে জেগে কাটিয়েছেন সেখানে। একটি দাবীতে সারাদেশ কেঁপে উঠেছিল। বহুদিন পর জনতা জেগেছিল তাদের প্রাণের দাবিতে। এক দফা এক দাবি! কিন্তু সরকারের সইলো না। একদিন বিকেলে তারা সারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মিছিল করে প্রদক্ষিণ করে এলো। এরপর শওকত ভাই, তৌহিদ ভাইসহ আরো কয়েকজন মুখ চেনা ভাই যাদের সাথে এই শাহবাগে এসেই পরিচয়, টং-এর দোকানে বসে ফুচকা খাচ্ছিল।বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলছিল, কিভাবে এই আন্দোলনকে আরো বেগবান করা যায়, আরো নতুন মাত্রা করা যায়, সেটা নিয়েই তর্ক-বিতর্ক! একজন রেগে মেগে বললো, শালা! সরকার পদ্মা সেতুর মতো এখানেও দূর্নীতি শুরু করলো! জনগণের আবেগ নিয়ে খেলা! চলেন, আমরা বরং এই রাজপথে থেকেই দূর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি। আমার বিশ্বাস এই জাগ্রত তরুণ প্রাণগুলো আমাদের সাথে থাকবে। বলার সময় তিনি খুব আশান্বিত আবেগ নিয়ে মঞ্চের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন। হঠাত কোথা থেকে কি হলো, শুরু হলো লাঠিচার্জ। বেধড়ক লাঠিচার্জে তৌহিদ ভাই ছিটকে পড়লেন টুল থেকে। মনে হলো মাথার পিছনে ফেটে গেছে, উনার বাবরি চুলগুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্বভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তসলিম সাহেবের হাতে হ্যান্ডকাপ পরালেন পুলিশ। এরপর পিঠের উপর এমনভাবে লাঠি দিয়ে মারতে লাগলো যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। আঘাত এরপরও চলতে লাগলো, একজন পুলিশ বুট দিয়ে কোমরে বেশ কয়টা লাথি মারলো, তিনি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলেন। এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখেন হাসপাতালের কেবিনে। বাইরে পুলিশ প্রহরা। ডাক্তারকে জিজ্ঞ্যেস করে জানলেন মেরুদন্ডে কয়েকটা মেজর অপারেশন হয়েছে, কোমরের দিকে জয়েন্ট প্রায় ছুটেই গিয়েছিল। তরুণাস্থির তরলগুলো শুকিয়ে গেছে। ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছিল সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু আদালত অনুমতি দেয়নি, জামিনও পায়নি। বেশ কয়েকটা মামলা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সেদিন নাকি তারা নাশকতার ষড়যন্ত্র করছিল ওই টং-এ বসে। ডিবি পুলিশ নাকি শুনেছে পাশে দাঁড়িয়ে। আর তিনিই পুলিশকে ইনফর্ম করেছেন। সরকারী তিনটি সংস্থা যৌথভাবে ঘটনাটির তদন্ত শুরু করে। মিডিয়াতে এতোটাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় বিষয়টি যেন তারা সেদিন সেখানে বসে দেশে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছিল! সারাদেশের মানুষ ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয় শাহবাগের আন্দোলনকারীদের উপর, ঘৃণায় সাধারণ জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়।
পত্রিকা পড়তে দিত হাসপাতালে, কেবল একটি, যুগান্তর। সেখানেই এসব খবর পড়েছে তসলিম সাহেব। হতাশায় হতবাক হয়ে গেছেন তিনি! কি ঘটনা, কি রটলো! নিশ্চয়ই এসব গোয়েন্দা গুজব! সরকারের কারসাজি!
ডিজিএফআই তো তাকে একেবারেই মুক্তি দেবার পক্ষে নয়, যেকোন ভাবে নানারকম মামলা দিয়ে সারাজীবন জেলে পঁচানো যায় কিভাবে সেটার পরিকল্পনা করেছে, দুই একবার খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টাও চলেছে। তার কেবিনের দায়িত্বরত তিনজন নার্স সৎ, বুদ্ধিমতী বলে এসব ষড়যন্ত্র থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। এজন্যে তিনি তাদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। নার্সের সাথে তার বেশ আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এরই মাঝে। থ্যারাপী দেয় যে নার্সটি বিকেলে, তার সাথে বেশ গল্প গুজব করেন তসলিম সাহেব। মেয়েটি অনাথ। ছোটবেলাতেই বাবা-মা হারিয়েছে, আপন বলে তেমন কেউ নেই। দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে থেকেই বড় হওয়া, এতোদূর আসা। মেয়েটি দেখতে বেশ! চোখের চাহনিতে কিছুটা অসহায়ত্ব, কিছুটা কাতরতা। যেন কারো উপর নির্ভরশীলতা চায় মেয়েটি। তসলিম সাহেব ভাবেন, মেয়েটির একটা ভালো বিয়ে দিতে হবে। জেল থেকে মুক্তি পেলে খুঁজে দেখবে ভাল ছেলে পাওয়া যায় কিনা যার উপর নির্ভর করা যাবে, আস্থা রাখা যাবে। এ কয়দিনেই মেয়েটিকে নিজের ছোটবোনের মত ভাবতে শুরু করেছেন তিনি। কি আশ্চর্য! মানুষের সম্পর্কগুলো বড়ই অদ্ভূত!
খুব কাছেই করিডোরে কারো ত্রস্ত পায়ের শব্দে বাস্তবে ফিরে এলো তসলিম সাহেব। পুরু সোনালি ফ্রেমের চশমা পরিহিত অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান স্বয়ং এসেছেন। চেহারায় ভীষণ বিরক্তি!
এসেই বলা শুরু করেছেন, এরা পেয়েছেটা কি! যখন খুশি তখন একটা মানুষের হাড় গোড় ভেঙ্গে প্রায় পঙ্গু বানিয়ে দিবে, আবার যখন খুশি তাকে একেবারে সুস্থ সবল বানিয়ে রাস্তায় নামাবে! মানুষ কি মেশিন নাকি! এখনো আপনার কোমরের জয়েন্টে ভাল করে জোড়া লাগেনি, তরুণাস্থির তরল পদার্থগুলো এখনো সেভাবে তৈরী হওয়া শুরু হয়নি, অথচ ডিবি পুলিশের আদেশ আপনাকে সম্পূর্ণ সুস্থ ঘোষণা দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে। আদালত থেকে তারা আপনার জামিন নিয়ে এসেছেন। সরকার বেশ বেকায়দায় আছে আপনাকে নিয়ে। এরই মাঝে সব ফাঁস হয়ে গেছে! সবই মিথ্যে অভিযোগ, ষড়যন্ত্র!। শাহবাগের সেদিনের তুমুল মিছিল দেখে সরকার ভয় পেয়েছে, তাই সেটি নষ্ট করতে এতো মামলা সাজানো, দেশি বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাহিনী সাজানো! সব জেনে জনগণ আবারো রাস্তায় নেমেছে, আপনাকে মুক্তি দেবার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। একটু থেমে পকেট থেক রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন তিনি।
গত কয়েকদিন শরীরটা খুব বেশি খারাপ যাওয়ায় পত্রিকা সেভাবে পড়া হয়নি। বাথরুমে যেতেও কেবিন বয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে। কোমরে ভীষণ ব্যাথা হচ্ছিল, হাঁড়ে হাঁড়ে যেন ঠোকর খাচ্ছিল। অস্থির জয়েন্টগুলো কেমন যেন শক্ত হয়ে গেছে। পা ফেলতে, পায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। কোন ফাঁকে এমন মিরাকল ঘটে গেল, কিছুই জানতে পারেননি তিনি।
একটু পরেই ডিবি অফিসার দ্রুত পায়ে সেখানে ঢুকলেন। ঢুকেই বললেন, তসলিম সাহেব, আপনি এখন মুক্ত। আদালত আপনাকে বিশেষ আদেশে জামিন দিয়েছে, জনগণের দাবী মেনে। জানেনই তো, সরকার মানেই আদালত, আদালত মানেই সরকার! বলেই একটা ক্রূর হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে।
তসলিম সাহেব অস্বস্তিতে দেয়ালের দিকে মুখ ফেরালেন। অফিসারটি থামলো না, বলেই চললো। বাইরে হাসি মুখে বেরোবেন, সবাইকে বলবেন আপনি বেশ সুস্থ, কোন সমস্যাই নেই। বেশ হাঁটতে পারছেন, খাওয়া-পরা, চলাফেরা সবই করতে পারছেন কোন অসুবিধা ছাড়াই। জনগণকে শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে আহবান জানাবেন, ছাত্রদের বলবেন পড়াশোনায় ফিরে যেতে, নিজেও ঘরে বসে বিশ্রাম নেবেন। এ শর্তেই আপনার মুক্তি ... ...
এরপর অফিসারটি আরো কি কি যেন বলতে লাগলো। কিন্তু সেদিকে আর মনোযোগ রাখতে পারলেন না তসলিম সাহেব। চিন্তার জগতে হারিয়ে গেলেন। তাহলে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনকে দমিয়ে দিতেই এই মুক্তি! এই ছলনা! এভাবে আর কতদিন জনগণের চোখ ফাঁকি দিবে সরকার? আর কতদিন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় পঙ্গু হবে নিরীহ, সাধারণ, সচেতন জনগণ!
আজ জেগেছে এই জনতা!
ধীরে ধীরে অফিসারটির কন্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। তসলিম সাহেবের মনে হয় অনেক দূর থেকে কেউ একজন তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে যাচ্ছে, আরো দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কোলাহল, শ্লোগান...
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×