somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তৃতীয় পরিচয়

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তৃতীয় পরিচয়
[For the Rohingya]
[অরুন্ধতী রায় রচিত "The God of Small Things" অবলম্বনে]

তুলরঙ্গে মাসটা গরম।তবে হঠাৎ করে বৃষ্টিও আসে-অনাহূতের মত করে যেমন করে তারা ওইদেশ থেকে এদেশে এসেছে।সামনে আসতে থাকা বনঝাড়গুলো লম্বা আর ঘন যা তাদেরকে বিপদের সময়গুলোতে পালিয়ে থাকতে সাহায্য করবে।গাছগুলো ধূসর তবে মৃত্যুর মতো নয়,মুমূর্ষ রোগীর মতো।দূরে মাছিগুলো ভনভন করছে চারপাশে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর উপর,খাচ্ছে না,মৃতদেহগুলোও বেশি পচে গেছে।মৃতদেহগুলোও অনাহূত।
রাত প্রায় শেষ।মনে হছে শান্তভাবে কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করছে,আদতে তা না।চারপাশের মানুষের কাছে রাত্রি এখন বেশি প্রার্থিত,যেমন্টা মায়ের কাছে সন্তানের।
তবে সকালের আগমন কেউ ঠেকাতে পারবে না,যেমন করে তার মায়ের মৃত্যুও কেউ ঠেকাতে পারেনি।ঈশ্বরও না।দিন আসছে।তারা তৈরি হচ্ছে আরেকটি লড়াইয়ের জন্য- বেঁচে থাকার অথবা ভালভাবে মারা যাওয়ার।কে বলে মৃত্যু হঠাৎ করে আসে,আসলে কি তাই?না,কাল সকাল পর্যন্ত তারা যেটার জন্য তারা অপেক্ষা করছে সেটা হঠাৎ নয়।শেষরাতে বৃষ্টি হল।কাদা রাস্তা ভিজে উঠল।পুরাতন টায়ারের দাগ ভেঙ্গে একাকার হল।তারা খুশি হয়ে উঠল।তাদের এখানে আস্তে অসুবিধা হবে।জীব্নসময় বাড়ছে।দুঃখ বাড়ছে।দূরে ছবি তুলে বেড়ানো কিছু লোক দেখতে পাচ্ছে-ফটোসাংবাদিকরা।ওরা ছবি তোলার সময় মুখে চুক চুক শব্দ করে আর ওদের ছবি তুলে পাঠায়-যেন ওদের খুঁজে পায়।ওরা পাপাচির মথ ওরা।ও কাঁদছে।তার মায়ের মৃত্যুর সময় ও এতটা কাঁদেনি ,প্রিয় ছনের বাড়িটা পুড়িয়ে ফেলার সময় না।কিন্তু এখন তার কান্না পাচ্ছে-ভীষণ।বাড়ির পাশে বুনো হয়ে যাওয়া ছোট ছোট প্রাণের ফিসফিসানির মত ওর কান্নার ব্যপ্তি।কেউ একজন বলল- কেঁদে কেঁদে সময়,শক্তি নষ্ট কোরো না,সামনে আরো পথ হাটতে হবে।কত দূর হাঁটতে হবে,অসীম পর্যন্ত?কান্না থামানোর জন্য সে পেটে জ্বলতে থাকা ক্ষুধার দিকে নজর দিল।সে কি শেষ কি খেয়েছিল মনে করতে পারছে,আশ্চর্য সে কবে শেষ খ্যেছিল তাই মনে করতে পারছে না।প্রাণের ফিসফিসানি ক্রমশই নিশ্চুপ হচ্ছে।নিঃশব্দ শব্দকে খাচ্ছে।
"তারা আমাদের নয়,তারা এসেছিল ছুঁচোর মত।তারা অনাহূত,তাদের আমরা কখনই এদেশে চাইনি।তারা শত্রু,তারা এদেশের নয়।আমরা তাদেরকে তাদের দেশে পাঠানোর সর্বাত্বক চেষ্টা করছি।"
লোকটি একটা কুৎসিত গালি দিয়ে শেষ করল।ও কথাগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল,লুকিয়ে লুকিয়ে।সে 'সর্বাত্বক চেষ্টা' আর 'তাদের দেশ' কথাটির অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছিল।যদিও অর্থটি তার হাতের কাছেই ছিল তবু সে তা ধরতে পারছিল না,ছুঁতে পারছিল না।পেন্সিলের শিষ আর হিরার মাঝের অংশটুকুর মত।
পরদিন তারা এল শান্তি রক্ষার জন্য আর ও "সর্বাত্বক চেষ্টা" কথাটির অর্থ বুঝতে পারল।তারা এসেছিল ঝড়ের মত,স্থায়ীরূপে।তখন ছিল দুপুরবেলা-প্রথাগত দুপুরবেলা যা আলাদা কোনো আবেদন ছিল না।তারা যখন একেকটি ঘরে ঢুকছিল তখন তার এতদিনের শেখা গোপন মূল্যবোধ মৃদু বুদবুদের মত ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল।বুদবুদ ফাটার জন্যই তৈরি হয়।ওরা ওর বাবার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিল আর মাকে মেরে ফেলল।মাকে মেরে ফেলার সময় তারা নাম না জানা "Whore" গালি দিয়ে ট্রিগার টেনে দিল।গুলির মাথা দিয়ে গুলি বের হচ্ছিল যেমন করে শীতকালে মুখ থেকে বের হয়।ধোয়া বের হওয়া শেষ হওয়ার আগেই তারা আরেকবার ট্রিগার টেনে ধরল।ছেঁড়ে দিল।ওর মায়ের চোখ আর্শ্চজনকভাবে শুকনা ছিল,শীতকালের পাতার মত।তবে শুধু চোখ না দেহও প্রানহীন ছিল।তারা ফিরে যাওয়ার সময় ওর বাবা চিৎকার করে কাঁদছিল,যা সে কোন দিন দেখেনি,বাবা তাদেরকে সে গুলি করে শেষ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছিল-মেরুদন্ডের ব্যথা অসহ্য ছিল।শেষ হলে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।কারণ এখানে নতুন কিছু ছিল না।হাড্ডি চিবানর মত(যা সে গত বছর খেয়েছিল),শেষ হয়ে গেছে।চলার পথে মৃতদেহের গন্ধে তার নাক কুঁচকে উথল।পচা,চেনা যায় না।লাথি দিয়ে তারা লাশগুলোকে ফেলে দিল,নুড়ি পাথরের মত।তারা শুধু আমাদের লোকদেরই মারেনি।নিবারণ নামের সাইকেল সারান লোকটিকেও তারা মেরে ফেলেছিল।তারা চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছিল না,তার চোখ উপরে ফেলা হয়েছিল।ধারালো কিছু দিয়ে নয়,আঙ্গুল দিয়ে।পরদিন সকালে ওরা নাইলক্ষ্যায় আসে।নৌকা নামক ভেলায় করে।আসার পথে তারা অজস্র লাশ দেখতে পেল।নৌকার চেয়ে লাশের সংখ্যা অনেক বেশি।ওর কাছে হঠাৎ করেই "সর্বাত্বক চেষ্টা" কথাটির অর্থ পরিস্কার হয়ে অঠে। আসার পথে ওদের মধ্যে কেউ একজন মারা যায়।অন্য একজন বলে ওঠে-"বেঁচে গেল"।মৃতুর মধ্য দিয়ে ওরা বেঁচে অঠে।অবশেষে ওরা তীরে এসে পৌছায়।তীরে পুতুলের মত লাশের সারির ভেতরে একজন মেয়ে;যে সম্প্রতি তার কুমারীত্ব হারিয়েছে তার বাবার লাশ খুঁজতে থাকে।সময় নষ্ট করা যাবে না।মেয়েটিকে রেখেই ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।চোরের মত।দূরে ওরা আলো দেখতে পায়।তবে সবসময় আলো শুভ কিছু বহন করে না।হিরোশিমা-নাগাসাকিতেও বোমা ফেলার পর চারিদিক ছিল আলোকিত।আলো বহনকারী মানুষগুলো পুলিশ।এতক্ষণ ধরে ওদের দলটির নেতৃত্ব দেয়া পুরুষগুলো(তাদের মধ্যে অনেকরই নপুংসক করা হয়েছে যেন ওদের ভবিষ্যৎ না হয়) পেছনে চলে আসে।আর সামনে পাঠায় নারী আর শিশুদের।নারী আর শিশুরা সহজে সহানুভূতি আদায় করতে পারে।পুলিশ গুলো অদেরকে ফিরে যেতে বলে।তবে সে কণ্ঠে জোর নেই।অবশেষে তারা না দেখার ভান করে যায়।ওদের মধ্যে একজনের কাছে রেডিও আছে যা সে দুখ-অপমানসহ তার পূরবপুরুষের কাছে থেকে পেয়েছিল তার ফ্রিকুয়েন্সি ঠিক করতেই শুনতে পায়-
"আমাদের প্রিয় দেশ থেকে সন্ত্রাসীদের উৎখাত অভিযান সফল হয়েছে।এজন্য যারা আমাদের
সাহায্য করেছে তাদেরকে ধন্যবাদ"
ওরা উখিয়া অতিক্রম করে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।এখানে নাকি ওদের পূরবপুরুষরা বাস করত।মেরিন ড্রাইভ দিয়ে হাঁটার সময় অরা-একটি সাইনবোর্ড দেখতে পায় যার একপাশে লেখা স্বাগতম আর অন্যপাশে ধন্যবাদ আবার আসবেন।যদিও ওরা জানে তাদের এখানে দুইটয়ার কোনটিই নেই।হাঁটতে হাঁটতে ওদের মধ্যে একজন বলে-"কাল খাবার আসবে"।যদিও ওরা জানে আসবে না,আসতেও পারে।এ সবই হল প্রায় নিভে যাওয়া প্রদীপকে জ্বালানোর শেষ চেষ্টা।ও পাশের সমুদ্রটার দিকে তাকায়।স্রোত তৈরি হচ্ছে।মিলিয়ে যাচ্ছে।ওরাও সম্ভবত কয়েকদিনের মধ্যে মিলিয়ে যেতে যাচ্ছে।আবার ক্ষীণতোয়া নদীর মত তারা টিকেও থাকতে পারে।তবে তাতে স্রোত নেই।অল্প পানি আর বিরাট নদী কোনোটিই স্বাভাবিক নয়।যেমন তাদের জীবন নয়, মৃতুও নয়।জন্ম,মৃত্যু,সুখ-দুঃখ,আন্নদ,বেদনা,কষ্ট,উচ্ছাস,ভাবালুতা সবই নাকি জীবনের অংশ।তবে ওদের দেশে এসব কিছুই নেই।শুধুই মৃত্যু।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এদেশের কেউ একজন ওদের উদ্দেশ্য করে বলে-"এরা আমাদের জ্বালানোর জন্য এসেছে।"

থুয়া নামক ১৬ বছর বয়সী কিশোর হঠাৎ করেই নিজেকে শিকড়হীন মনে করে।থুয়া মানে সে জানে সূর্য-কিন্তু সে শুধুই অন্ধকার দেখে এসেছে মৃত্যুর পর থেকে।মৃত্যুর আগে সে কি নিজের দেশ কোনটা দেখে যেতে পারবে।"জারজ" শব্দটি শোনার থেকেও দেশহীন থাক যে কষ্টের সেটা এদেশ-ওদেশ কেউই বুঝবে না।শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর চেয়ে বড় বাস্তবতা নেয়-এটা তার চেয়ে ভাল আর কেউ বোঝে না,কেউ না।ঈশ্বরও না সম্ভবত।।যদিও কেউ স্বীকার করেনি।তৃতীয় পরিচয় বড় হচ্ছে,অনেক বড় হচ্ছে মুসলমান তৃতীয় পরিচয়।মুসলমান,হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান-সবই তৃতীয় পরিচয়।মানুষ পরিচয় ছাড়িয়ে বার্মার নাগরিক শব্দটা ছাড়িয়ে তৃতীয় পরিচয় মুসলমান পরিচয় ক্রমাগত বড় হচ্ছে।বড় হতে হতে অসীমে মিলিয়ে যাচ্ছে না।যাবেও না।এই তৃতীয় পরিচয়।।

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×