যতদুর মনে পড়ে, ২০০৮ সালের দিকে একদিন আম্মা আমাকে বললেন, "এই ঢাকা শহর আর ভাল লাগছে না! তোরা সবাই বড় হয়েছিস, বিয়ে করেছিস, তোদের মত করে তোরা থাকিস, তোদের ছেলে মেয়ে আছে, তোরা তোদের মত করে থাক। আমি কারো কাছেই থাকতে চাই না, যদি পারিস আমাকে গ্রামের বাড়িতে একটা ঘর তুলে দে"! বলে রাখা ভাল, আমরা তিন ভাই এক বোন, বোন ইটালীতে স্বামীর কাছে থাকে। আমরা তিন ভাইএর দুই ভাই আমি ও ছোট ঢাকা এবং বড় ভাই চট্রগ্রামে থাকেন। বাবা চাচারা ১০ ভাই বোন, কয়েক চাচা ও তাদের পরিবার গ্রামে থাকেন। বাড়ী ভাগাভাগি হয়েছে, কিন্তু আমাদের ভিটে শূন্য, ঘর নেই! বাবা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে, আম্মা ঘুরে ফিরে ভাইদের কাছে থাকেন তবে ছোট ভাইয়ের কাছেই স্বাচ্ছন্দ পেতেন! আমি তখন আলাদা ছোট দুই রুম নিয়ে থাকি!
সেদিন রাতে আমি মুলত আর ঘুমাই নাই, আমি সারা রাত কেঁদেছি আর ভেবেছি! একটা মানুষ বয়স হয়ে গেলে কত একা হয়ে যায়, সব কিছু থেকেও কিছুতেই যেন নাই, এমন একটা অবস্থায় এসে যায় (এখন আমি নিজেই বুঝি)! পাশে প্রিয়তমা স্ত্রী ও আমার বড় ছেলে (তখন আমার এক ছেলে, বয়স ৬ বছরের) কেহ কিছু বুঝে নাই! এবং শেষ রাতের দিকে মসজিদের আযান কানে বাজছে, তখনোও আমি ভেবে চলেছি! আমার হাতে কিছু টাকা আছে এবং সেটাই মুলত আমার জমানো টাকা ছিল। ঢাকাতেও আমি নিজে তেমন কিছু করি নাই, জমি বা ফ্লাট কিছুই নেই (তবে এতদুর মনে আছে জায়গা ভেদে ১২-১৫ লাখেই হাজার বারশত স্কয়ার ফিটের ফ্লাট পাওয়া যেত), বেসরকারী চাকুরী টাকা হাতে না থাকলে হঠাত চাকুরী গেলে চলবো কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি!
মাথায় যত ভাবনাই আসছিলো, সব মায়ের মুখের কাছে উড়ে যাচ্ছিলো, দুনিয়ার সব কিছুই তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো! এমতাবস্তায় আমি একাই সিদান্ত নিয়েই ফেললাম, হ্যাঁ মায়ের জন্য গ্রামে বাড়ী বানিয়ে দিতেই হবে, আমার সাথে কেহ থাকুক আর না থাকুক, আমার সব টাকা গেলে যাক। তিনি অন্তত নিজের মত করে নিজে আনন্দে বাঁচতে পারবেন, গ্রামে তার অনেক সঙ্গী সাথী মিলবে, চাচা চাচীমাদের সাথে উনার সময় ভাল কাটবে। তিনি নিজেই নিজের দেখা শুনা করতে পারবেন, কাজের লোক থাকবে! প্রয়োজনে তিনি যে কোন স্থানে বেড়াতে যেতে পারবেন, আবার ফিরে যাবেন নিজের ঘরে, মানে বুঝতে পারছিলাম তিনি নিজেই আবার একটা কেন্দ্রবিন্দু হতে পারবেন! আমরাও সবাই তাকে কেন্দ্র করে আবার বাঁচতে পারবো! ব্যস, পরদিন ঘুম থেকে উঠে অফিস এবং বিকেলেই ছুটি নিয়ে বাড়ী চলে গেলাম!
চাচাদের সাথে কথা বলে নিলাম, জায়গা চিনহিত করে নিলাম! ভাইদের জানালাম, বললাম, কেহ যদি দাও দিবে, না দিলে নাই! আমি একাই মায়ের জন্য বাড়ী বানাবো! ভাইয়েরা তখন নিজেরাও খুব স্বচ্ছল ছিল না, দিনে আনে দিনে খায় অবস্থা, তবুও ওরা নিজেরা সায় দিলো এবং যা পারে দিবে বলল! আমি আর দেরী করলাম না! ঢাকায় ফিরে এসে মাকে বললাম, আমি বাড়ী বানানোর সিধান্ত নিয়েছি! তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে দোয়া করলেন, আমি কেঁদেছিলাম আবারো! (এই লেখা লিখতেও আমি কাঁদছি!)
ব্যস, সেই সপ্তাহেই গ্রামে আমার এক চাচার (তিনি চাচাদের মধ্যে ৬ষ্ট) একাউন্টে টাকা ট্র্যন্সফার করলাম, ইট কিনতে বললাম! এদিকে আমি এক্সেল শিটে নকশা করতে বসে পড়লাম, অফিস শেষের পরে! কয়টা রুম হলে ভাল, সবাই গেলে কোথায় বসতে পারবে ইত্যাদি সাধারণ চিন্তা নিয়ে এক্সেল সিটেই ড্রাফট ফাইন্যাল এবং প্রিন্ট নিয়ে নিলাম! পরের শুক্রবারেই মাটিতে কোপ পড়লো, গর্ত হল! এর পর টানা ৮/১০ মাস প্রতি বৃহস্প্রতিবার রাতে বাড়ী শনিবার সকালে ঢাকায় ফেরা, সরাসরি অফিস! বাড়ী ফাইন্যাল হয়ে গেল, সবাই আনন্দিত। আম্মা পুরো এই কয়েক মাস বাড়ীতেই ছিলেন এবং নিজেই দেখাশূনা করেছেন, এবং বেশ খুশি মনেই সময় কাটিয়েছেন!
একদিন বাড়ী থাকার পুরাই উপযুক্ত হল, আমরা ভাইরা সবাই স্ত্রী সন্তানদের নিজে বাড়ীতে গেলাম, সবার সেকি আনন্দ! সেই আনন্দের দিন ভুলে যাবার নয়! তবে যতদুর মনে পড়ে, এর মাস ছয়েক পরে আম্মা তার মেয়ের কাছে ইটালীতে চলে যান এবং সেই বাড়িতে তালা পড়ে, আমি ও ভাইরা কদাচিৎ যাই দেখে আসি, একজন চাচীমা মাঝে খুলে কাজের লোক দিয়ে পরিস্কার করেন! এভাবেই! তবে বছর দুয়েক পরে আম্মা আবার ফিরে আসেন এবং সেই বাড়ীতে আবারো থাকতে শুরু করেন! (ক্রমশ)
শুরুটা ঠিক এভাবেই হয়েছিল!
কাজ চলছিলো!
মাঝে মাঝেই নিজের ছবি তোলাতাম!
আস্তে আস্তে ছাদ ঢালাই হল!
ভেতরের কাজ হল!
দেয়ালের কাজ শেষ!
জানালার কাজ হচ্ছিলো!
ফাইন্যাল রঙের কাজ!
আমি আর আমার ছোট ভাই, বড় ভাইএর সাথে ছবি নেই, কারন তিনি যখন আসতেন আমি তখন পেতাম না, চট্রগ্রাম থেকে তিনি যে কোন দিনেই আসতেন, আর আমরা থাকতাম শুক্রবারে!
তখনো ব্লগিং করতাম, সামুর পাশাপাশি আরো অনেক ব্লগেই লিখতাম, বাড়িতে বসে অনেক পোষ্ট দিয়েছি, তখন ফোন নেট লাইন খুব স্লো ছিল তবুও ইচ্ছার কাছে সব পরাজিত হত!
পুরো ভিউ!
গত কয়েক বছর আগে আমরা পরিবারের সবাই এক্ত্রিত হয়েছিলাম! পরিবারের সবাইকে নিয়ে এটা আমাদের বিবাট ছবি বাড়ির ছাদে, শুধু বাবা নেই! এই আফসোস এই জীবনে যাবে না! তিনি আমাদের সুখ দেখে যেতে পারলেন না!
সবাইকে ধন্যবাদ! মায়ের দোয়ায় এখন ভাল আছি! আপনাদের ভালবাসা কাম্য!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৩২