০১ জুন ২০১০। আমার স্ত্রী তখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।পূর্বের দিন ডাক্তারের পরামর্শে তাকে যশোরের একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার বলেছে, যে কোন সময় তার অপারেশন করানো হতে পারে। চাকরী সূত্রে আমি সে সময় সিলেটে একটা কাজে অবস্থান করছিলাম। তাই সবকিছু তার বাবা মা দেখাশুনা করছিলেন।
সকাল থেকেই খুব টেনশন হচ্ছিল। কোন কাজেই মন বসাতে পারছিলাম না। সকাল নয়টায় আমার স্ত্রী'র ফোন পেলাম। জানতে পারলাম ঐ দিনেই তার অপারেশন করানো হবে। বারোটায় তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে।
এ কথা শোনার পর, আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এদিকে কাজ শেষ হতে আর মাত্র দু'দিন বাকী । তাই কিছু অফিসিয়াল প্রসিডিওর এর কারনে সে সময় ছুটি নিয়ে যাওয়া এবং আসা একটা জটিল ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমার মনটাকে কোন ভাবেই শান্ত রাখতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সব চিন্তা ছুড়ে ফেলে আমার কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানিয়ে ছুটির জন্য আবেদন করলাম।
আমার স্ত্রী'কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার আগে, আমি আবার তার ফোন পেলাম। সেই প্রথম বারের মত আমাকে জানাল, আমি তার পুত্র সন্তানের বাবা হতে চলেছি। এ কথা শোনার আমি কি এক মুগ্ধতায় বিভোর হয়ে রইলাম। আমরা দু'জনেরই কেউ কখনও ছেলে কিংবা মেয়ে সন্তানের প্রেফারেন্স নিয়ে মাথা ঘামাইনি। তাই সন্তান যেই হোক আমরা তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতাম।
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল। আমি কিছুক্ষন পরপর ফোন করে খোজ নিচ্ছিলাম। দুপুর একটায় আমি সেই সুসংবাদটা পেলাম, আমি এক পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছি। আনন্দে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না।
এদিকে শেষ পর্যন্ত দুপুর তিনটায় ছুটির জন্য অনুমতি পেলাম। দেরি না করে রওনা হলাম যশোর এর উদ্দেশ্যে। সিলেট হতে ঢাকা আবার ঢাকা হতে যশোর এ পরদিন ভোরে পৌছলাম। সরাসরি হাসপাতালে চলে গেলাম, সেখানে আমার শ্বশুড় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
তার সাথে প্রথমে শিশু ওয়ার্ডে গেলাম। ওয়ার্ডের একটা বেডে আমার শ্বাশুড়ী বসে ছিলেন। তার সামনে ছোট্ট ফুটফুটে একটা শিশু। আমার বুঝতে বাকী রইল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত দুরুদুরু বুকে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। এটাই কি আমার সেই সন্তান !! আমিই তার বাবা !! এতোদিন যে নিজেকে আমি অত্যন্ত নগন্য মনে করতাম সেই আমি এখন একজন গর্বিত বাবা !! আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোন এক স্বপ্নের মাঝে ডুবে আছি। তার হাতের আংগুল, পায়ের পাতা আলতো করে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। সে এতো নরম তুলতুলে, কোলে নিতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার শ্বাশুড়ী তাকে আমার কোলে তুলে দিলেন। তার গালের সাথে আমার গাল ঘষতে ইচ্ছা করছিল খুব। এভাবে তাকে অনেকক্ষন কোলে নিয়ে বসে ছিলাম। কিছুক্ষন পর সেখানে ডাক্তার চলে আসায় আর থাকতে পারলাম না।
আমার স্ত্রী ছিল আই সি ইউ ওয়ার্ডে, সেখানে গেলাম। ওয়ার্ডের ভিতর ঢুকেই আমার স্ত্রী'কে খুজতে লাগলাম। সব পেশেন্ট একই রকম ড্রেসে থাকায় তাকে আলাদা করতে পারছিলাম না। আমি অন্যদিকে চলে যাচ্ছিলাম, ওয়ার্ড অ্যাটেন্ডেন্ট আমার স্ত্রী'র বেড টা দেখিয়ে দিল। আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন তার কাছে দৌড়ে ছুটে যাই। ভালোবাসা, আদর, মায়া প্রভৃতি আবেগের এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল আমার মধ্যে। তার পাশে গিয়ে হাত দু'টি ধরে বসে রইলাম। তাকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে ইচ্ছা করছিল।
সেদিন দুপুরেই স্ত্রী ও সন্তান দুজনকেই কেবিনে নিয়ে আসা হল। দুপুরের পর বাজারে গেলাম। স্ত্রী ও নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করলাম। ফিরে এসে স্ত্রী ও সন্তান এর সাথে সময় কাটাতে লাগলাম, আর কিছুক্ষন পরপর মনে হচ্ছিল আবার রাতে ফিরে যেতে হবে।
রাত ৮:১০ এ ট্রেনের টিকিট আগেই করা ছিল। সন্তানকে আদর করে, স্ত্রী'র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বের হয়ে পড়লাম।একটু ব্যাস্ততা ছিল, তাই খুব আবেগতাড়িত হতে পারিনি। স্টেশনে যাওয়ার পথে জ্যাম এর জন্য ট্রেনটা মিস করলাম । উপায় না পেয়ে সেখান থেকে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে রাত বারোটায় একটা বাসের টিকিট ম্যানেজ করতে পারলাম। বাস আসতে তখনও আরো অনেক সময় বাকী ছিল। এই সময়টা বাস কাউন্টারেই বসে ছিলাম আর তাদের কথা মনে পড়ছিল, চেহারাগুলি সামনে ভাসছিল।
বারোটায় বাস আসল। বাসে একটা জানালার পাশে বসলাম। শো শো করে বাস ছেড়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দু'পাশে অন্ধকার। দূরের গ্রামে দু'একটা মিটিমিটি আলো জ্বলছিল। আমি তাকিয়ে রইলাম ঐ আলো'দের দিকে। কখন যেন টুপ করে আমার চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ল। আমার তখন শুধু আমাদের আগত ভবিষ্যতের কথা মনে পড়ছিল।
উৎসর্গঃ লিসা' কে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



