বৃত্তহীন (২য় পর্ব)
খুব রাগ হচ্ছে আনীলার । ক্লাস শেষ হতেই তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরে ফেইসবুক লগ ইন করে দেখে দেব্-এর চিঠি আসেনি । খুব মন খারাপ লাগছে তার । পিসি অন রেখেই বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল সে । জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে । আজ আকাশটা নীল নয় । নীল ! কি সুন্দর নাম দিয়েছে দেব্ । নীল...
তার ছোটবেলার অনেকগুলো দিন কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে । বাবা-মা'র যখন যেখানে পোস্টিং হয়েছে । বাবা-মা দু'জনেই সরকারী চাকুরে । এখন কাজের প্রয়োজনে দু'জন দু'জেলায় অবস্থান করছে । এই নিয়ে আনীলা কখনো কোনদিন তাঁদের প্রতি অভিযোগ করেনি । যদিও খুব একা একা বেড়ে উঠেছে সে। যমজ বড় দু'ভাইয়ের মধ্যে একজন ব্যাঙ্গালোরে এম বি এ করছে আর একজন বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছে ।...
বিছানা থেকে ওঠে ইনবক্স চেক করল । নাহঃ কোন ম্যাসেজ নেই । মনটা খুব ছটফট করছে । দেব্ কেন লিখছে না ! দু'দিনেই দেব্-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে সে । পুরোটা মুহূর্ত মন পড়ে থাকে দেব্ কাছে । এটা কি প্রেমে পড়া ? সে কি দেব্ কে সত্যি সত্যি ভালাবেসে ফেলল ? নিজেকেই প্রশ্ন করে আনীলা । আরে ধূর...এটাতো স্রেফ একটা কাব্য-খেলা । দেব্-এর ভাষায় মিথ্যে কাব্য করা...
দেব্ কি সুন্দর করে লিখে...প্রজাপতি ভুলে যায় তার শূয়োপোকা জীবনের কথা...। প্রজাপতি ! অনূপ প্রজাপতি খুব পছন্দ করত । ওর বেশিরভাগ কবিতায় প্রজাপতির কথা থাকত । প্রজাপতির ছবি এঁকে দেয়ালে সেঁটে রাখত । কিন্তু কোনদিন আনীলাকে প্রজাপতির ছবি এঁকে দিত না । খুব অবাক লাগত আনীলার । কারণ জানতে চাইলে বলত- ''প্রজাপতি ক্ষণিকের জন্য জন্মায় । তার সব সৌন্দর্য ক্ষণিকের । আর তুমি আমার আজীবনের আরাধ্য । তোমাকে ক্ষণিকের কোনকিছু দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে চাই না ।'' যুক্তিটা মোটেও পছন্দ ছিল না আনীলার তারপরও কোনদিন তর্ক বাঁধায়নি অনূপের সাথে । অথচ আজ...অনূপ আনীলাকে ছাড়াই দিব্যি সময় পার করছে ।...নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।...
ইনবক্সে একটা ম্যাসেজ পেয়ে চোখে খুশির ঝিলিক বয়ে গেল । নিশ্চই দেব্-এর ম্যাসেজ । কিন্তু না ! সামনে বিজয় দিবস সেজন্য গ্রুপ ম্যাসেজে অগ্রিম শুভেচ্ছা বার্তা । ধূর...খুব বিরক্ত লাগছে । একটা ম্যাসেজ লিখতে কি ত্রিশ ঘন্টা লাগে ? দেব্ কি করছে কে জানে...
আনীলা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল । কখন সন্ধ্যা হয়েছে টের পায়নি । আকাশে একটা দু'টো তারা । চৌদ্দতলা দালানের নয়তলা থেকে নিচে দেখা যাচ্ছে গাড়িগুলো এঁকে-বেঁকে চলছে । সিগনাল পড়ছে...থামছে । আবার চলে যাচ্ছে...। সবাই ঘরে ফিরছে । ওপর থেকে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে সে মানুষ দেখে । প্রতিটি মানুষই এক একটা আলাদা স্বত্তা । কোটি কোটি মানুষ কোটি কোটি মন, কোটি কোটি ভিন্নতা । ভিন্ন ভিন্ন চাওয়া-পাওয়া । কি অদ্ভুত মানুষের জীবন ! যতক্ষণ বেঁচে থাকা ততোক্ষণ সব আছে , মরে গেলেই সব শেষ । হায়ঃ মৃত্যু ! মৃত্যুর কথা ভাবতেই চোখ ভিজে গেল । তিন বছর আগে ড্রয়িং রুমে কাফনে ঢাকা ভাইয়ের লাশটা চোখের সামনে ভেসে উঠল ।...
বাইরে পৌষের কুয়াশা পড়ছে । থাইয়ের পাল্লাটা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় বসল । ডেস্কের ওপর কাজের মেয়েটা কখন সন্ধ্যার খাবার রেখে গিয়েছে টের পায়নি । খাবার মুখে দিতে দিতেই আয়নায় চোখ পড়ল । আয়না দেখতে তার মোটেও ভালো লাগে না । অথচ অধিকাংশ ক্লাসমেটগুলোর ব্যাগে ছোট্ট আয়না থাকে । এত বিরক্ত লাগে তার । কিন্তু এখন আয়নায় নিজেকে দেখতে কেন জানি খুব ভালো লাগল ! মৃদু পায়ে হেঁটে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়ালো । অনূপ বলত তার চোখগুলো নাকি খুব সুন্দর ! সত্যিই এখন তার কাছে তার চোখ দু'টি অসম্ভব ভালো লাগছে । পারতপক্ষে খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে আনীলা । মেধাবী । এস এস সি তে জিপিএ পাঁচের কাছাকাছি কিন্তু এইচ এস সি তে গোল্ডেন পাঁচ পেয়েছে সে । এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শেষ সেমিস্টারে পড়ছে । অন্য দশজনের থেকে খুব আলাদা । অনূপ চলে যাওয়ার পর থেকে কাওকে মনের মধ্যে স্থান দিতে পারেনি । এভাবেই একা কেটে যাচ্ছে দিনগুলো । ফেইসবুকে একেকজন নানাভাবে পটানোর চেষ্টা করে । হাই/হ্যালো বলতে না বলতেই একেক জন সেল নাম্বার পর্যন্ত চেয়ে বসে । খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার । কিন্তু দেব্...মনের মধ্যে একটা অন্যরকম স্থান করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে । দেব্-এর কথা মনে পড়তেই ডেস্কটপের সামনে গিয়ে ইনবক্স চেক করল । নাহঃ...দেব্ এখনো কোন চিঠি
লিখেনি ! ঘড়িতে নয়টার বেশি । ক্লাস টেস্টের পড়া নিয়ে বসল । আনীলার মেজর বিষয় মার্কেটিং। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পড়তে তার বেশি ভালা লাগে । কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে না মোটেই...
মন পড়ে আছে ফেইসবুকের ইনবক্সে । পড়া থেকে উঠে আবারো ইনবক্স চেক করল । একটা ম্যাসেজ এসে জমা হয়ে আছে । মনটা খুব দুরু দুরু করছে । আল্লাহর কাছে করডিয়্যালি প্রে করল ম্যাসেজটা যেন দেব্-এর হয় । মাউসের কার্সরটা ইনবক্সে এনে চোখ বন্ধ করে লেফট্ ক্লিক করল । তারপর চোখ খুলেই মৃদু কন্ঠে আনন্দ-চিৎকার দিয়ে বলল- দেব্ !...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




