সাপ্তাহিক এ লেখা টা পরে মনে ধরলো, তাই পোস্ট করলাম। (http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=5067)
পলাশ রহমান ইতালি থেকে লিখেছেন,,,,,,,,,,,,,,,
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের প্রধান নেতা। বিশ্বের সেরা ৫০ জন চিন্তাবিদের অন্যতম একজন তিনি। বিশ্বসেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় লিখা হয়েছে তার নাম। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তাকে দেয়া হয়েছে বিশেষ (সম্মানসূচক) ডক্টরেট। ১৯৮০ সালের পরের ডিকশনারিতে Micro Cradit শব্দটি যোগ হয় মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে। নোবেলসহ বিশ্বের সেরা পুরস্কার ও স্বীকৃতিগুলো একে একে জমা হয় তার ড্রয়িংরুমে। এত বেশি পুরস্কার, অ্যাওয়ার্ড ও ডিগ্রিধারী মানুষ এখন আর বিশ্বে দ্বিতীয় জন নেই, অন্তত গিনেস বুক তাই বলে। এসব কিছুর চেয়ে আমার কাছে মুহাম্মদ ইউনূসের বড় পরিচয় হলো তিনি একজন বাংলাদেশি। যে কাদামাটি গায়ে মেখে বড় হয়েছি আমি, সেই কাদামাটির দেশেই জন্ম নিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ আমি প্রফেসর ইউনূসের দেশের মানুষ। অথবা আমার দেশের সন্তান ড. ইউনূস। যেভাবেই বলি না কেন এ আমার বড় গৌরবের, বড় অহঙ্কারের।
২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ওলে ডানবোল্ট মিউস বলেছিলেন, ‘গণমানুষকে দারিদ্র্যের শেকল ভেঙে বের করে আনতে না পারলে বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সে রকমের একটি আলোকবর্তিকা। জামানত ছাড়া দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেয়ার ধারণা ছিল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস মাত্র তিন দশক আগের যাত্রা করা গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে। তিনি ছোট ঋণকে দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন দরিদ্রতা দূর হলে পৃথিবীতে শান্তি আসতে বাধ্য।
২০০৮ সালে প্রফেসর ইউনূসের সাড়া জাগানো বইয়ের ইতালীয় সংকলন ‘উন মোন্দ সেনছা পোভেরতা’ বা ‘একটি দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে রোমে এসেছিলেন তিনি। তখন জানতে চেয়েছিলাম- আপনার বইয়ের কোন কথাটা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জানা উচিত?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথম কথাটাই, যেটা বইয়ের শিরোনাম। দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে হবে, আমরা একটা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে পারি। মানুষ যেন বিশ্বাস করতে শেখে বিশ্ব থেকে একদিন দরিদ্রতা মুছে ফেলা সম্ভব। যত তাড়াতাড়ি মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্ম দেয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য বিদায় হবে।
এর পরেই বলেছিলাম- এ বিশ্বাস কি আপনার দেশের মানুষের মনে জন্ম দিতে পেরেছেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, অবশ্যই পেরেছি। তবে বাধা কিছুটা এসেছে বা আসছে মানুষের বোঝার ভুলের কারণে। রাজনৈতিক কারণে। সংবাদ মাধ্যমগুলো এমন কিছু খবর পরিবেশন করে যা মানুষের মনে ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয়। রাজনীতিকরা এমন কিছু কথা বলেন যা সাধারণ মানুষকে একটা ভুল ধারণার উপর দাঁড় করায়। তাদের মধ্যে ধারণা জন্ম নেয় আমি গরিব মানুষকে কষ্ট দিচ্ছি। আমি অতি মাত্রায় সুদ খাই। এসব কথা বারবার শুনতে শুনতে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে এটা বোধহয় সত্যি।
আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিল- বাংলাদেশের মানুষই যখন আপনার বা গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করে তখন কিভাবে নেন?
প্রফেসর ইউনূস উত্তরে বলেছিলেন, যারা সমালোচনা করে তাদের কাছে সঠিক খবর নেই। তারা অনেকটা না জেনে অথবা না বুঝে সমালোচনা করে। কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। অনেকে বলে গ্রামীণ ব্যাংকে সুদের হার বেশি। প্রশ্ন হলো কার থেকে বেশি? নিজের তুলনায় না অন্যের তুলনায় বেশি? কেউ যদি বলে তার নিজের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার বেশি। তখন আমাদের কিছুই বলার থাকে না। তবে যদি কেউ বলে, অন্যের তুলনায় বেশি, তবে বলব আপনার কাছে সঠিক খবরটা নেই। এ ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় আছে। তা হলোÑ যে ব্যক্তি তুলনা করছেন তিনি তুলনার অর্থ সঠিকভাবে বুঝেছেন কিনা বা কার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে তা দেখার দরকার আছে ? এখন কেউ যদি বিশেষ মতলব নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য তুলনা করেন সে তো ভিন্ন কথা।
কবি রবীন্দ্রনাথের পরে আর কোনো বাঙালি আমাদের দেশ ও জাতিকে বিশ্ব দরবারে এতটা উঁচুতে তুলতে পারেননি যতটা পেরেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। আর তাই তাকে নিয়ে আমাদের বিদ্বেষহীন অহঙ্কারের শেষ নেই। আমরা যেমন অহঙ্কার করি তাকে নিয়ে তেমনি কৃতজ্ঞ তার প্রতি। তার মতো সৃজনশীল নিবেদিত মানুষের যোগ্য মূল্যায়ন করার মতো সংস্কৃতি ও মানসিকতা এখনো আমাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় সৃষ্টি হয়নি। এর জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। অথচ গরিবমুক্ত বিশ্ব আন্দোলনের নেতা প্রফেসর ইউনূস ও তার ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রে-ক্রেডিট আজ বিশ্বনন্দিত। তিনি স্বীকৃত ‘গরিব না থাকাই মানুষের অধিকার’ এই সেøাগানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মাইক্রো-ক্রেডিটের জনক হিসেবে। ১৯৮০ সালের পরের ডিকশোনারিতে Micro Cradit শব্দটি যোগ হয় মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে। যা বর্তমানে Micro Finance নামে অভিহিত এবং বহুল আলোচিত। বিশ্বের ১৩১টি দেশের ১২ কোটি মানুষ আজ তার এই ক্ষুদ্রঋণের আওতায় তাদের ভাগ্যোন্নয়নের লড়াইয়ে লিপ্ত। এদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ রয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূসের এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ বর্ষ হিসেবে পালন করা হয়েছিল জাতিসংঘ থেকে। এর আগে প্রায় ২ ডজন মামলা করেছে তার নামে। পত্রপত্রিকাগুলো নির্দয়ভাবে একটা বিদেশি টেলিভিশনের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে কোনো প্রকার বাছ-বিচার ছাড়াই খিস্তি করেছে। এখনো করছে। যেসব রাজনীতিক এবং সম্পাদক-লেখকরা খিস্তি করছেন তারা হয়ত জানেন না যে, তাদের মতো রাজনীতিক, সম্পাদক-লেখক বাংলাদেশে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম প্রতিদিন হয় না। একজন ইউনূসের জন্য একটা জাতি বা গোটা পৃথিবীকে যুগযুগ অপেক্ষা করতে হয়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মুহাম্মদ ইউনূসকে দারুণ রকম নাড়া দেয়। ক্ষুধায় ধুঁকে ধুঁকে মানুষের মৃত্যু তার মানসপটে গভীর দাগ কাটে। চিন্তার জগতে উন্মেষ ঘটে নতুন ভাবনা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বিনাচাষে পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ অনাবাদে জমিতে ফসল করার উদ্যোগ নেন। গড়ে তোলেন নবযুগ তেভাগা খামার। সুফলও আসে। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি দেখেন, গরিব মানুষ অর্থাভাবে মহাজনী জোঁকের দ্বারা শোষিত হচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদেরই ঋণ দিচ্ছে, যাদের আছে। ড. ইউনূস প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করেন ক্ষুদ্রঋণ পাওয়ার অধিকার সবার আছে। স্থানীয় জোবরা গ্রামের ৪২টি হতদরিদ্র পরিবারকে নিজের পকেট থেকে মাত্র ৮৫৬ টাকা দৈনিক কিস্তিতে ঋণ দেন। শুরু হয় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। এর সফলতার পথ ধরেই ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের বুড়িচর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামেই খোলা হয় একটি প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প। ১৯৭৯ সালে প্রকল্পটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সমর্থনে টাঙ্গাইলে সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের আর্থিক সাহায্যে প্রকল্পটি ঢাকায় সম্প্রসারিত করা হয়। প্রকল্পটির সফলতার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্পটিকে গ্রামীণ ব্যাংক নামকরণ করে একটি বিশেষায়িত ঋণদান প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে মোতাবেক গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ জারি করা হয় এবং একটি স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে পেরিয়ে যায় সিকি শতাব্দী। প্রফেসর ইউনূস হয়ে ওঠেন বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্তি আন্দোলনের প্রধান নেতা। বিশ্বের সেরা সেরা পুরস্কার ও স্বীকৃতিগুলো একে একে জমা হতে থাকে তার ড্রয়িংরুমে। এত বেশি পুরস্কার, অ্যাওয়ার্ড ও ডিগ্রিধারী মানুষ এখন আর বিশ্বে দ্বিতীয় জন নেই, অন্তত গিনেস বুক তাই বলে। অথচ আমরা কি নিদারুণ প্রতিদান দিলাম তাকে। অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, মুহাম্মদ ইউনূসের বয়সসীমা ফুরিয়ে গেছে। তখন খুব জানতে ইচ্ছা করে আমাদের অর্থমন্ত্রীর বয়স কত? এই বয়সে তিনি কিসের বিনিময়ে ভারতকে ট্রানজিট দিলেন? কি পেল বাংলাদেশ? কোথায় গেল শেয়ারবাজারের টাকা? কি হবে এই সর্বহারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের? আরো জানতে ইচ্ছে করে, রাষ্ট্রপতির বয়স কত? বয়সের ভার আর রাষ্ট্রপতির ভার একসঙ্গে নেয়ার সক্ষমতা কি তার আছে? বয়স কত হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর? এত বড় একটি দলের প্রধান এবং রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি কি তার আছে ?
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ড. ইউনূস আমেরিকায় বসেই স্বাধীনতার পক্ষে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বিদেশিদের জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও মানবিক প্রচারণা চালান। সেখানে তিনি বাংলাদেশ নাগরিক সমিতির সচিব এবং মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রকাশিত একটা সংকলন সম্পাদনা করেন। দেশপ্রেমিক মুহাম্মদ ইউনূসকে তখন বিশ্বের সবচাইতে উন্নত দেশে অধ্যাপনাসহ আকর্ষণীয় সুবিধা ও স্থায়িভাবে বসবাসের প্রলোভনও আটকে রাখতে পারেনি। তিনি ১৯৭২ সালে নিজের কাদামাটির বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। এই অলস কাজ একদম ভালো লাগেনি প্রফেসর ইউনূসের। তিনি কমিশনের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন। নতুন রূপে ভাবতে শুরু করেন বিধ্বস্ত দেশকে নিয়ে, দেশের দরিদ্র মানুষকে নিয়ে। অথচ আজ এই ব্যক্তিটিকে নিয়ে বাতাসে উড়ছে নানা কথা। চারিদিকে শুধু একটাই প্রশ্ন কেন সরকার হঠাৎ করে মুহাম্মদ ইউনূসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ? পক্ষে-বিপক্ষে নানা জন নানাভাবে মন্তব্য করছে। তবে সরকার যা বলুক বা যাই ভাবুক সাধারণ মানুষের সহানুভূতি এখন মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে। অন্তত প্রবাসী বাংলাদেশিরা শত ভাগ মনে করে সরকার ভুল করছে। কারণ একজন প্রবাসীই জানে মুহাম্মদ ইউনূস তাকে কতটা সম্মানিত করেছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



