জীবনে অনেকগুলো ঈদ পেড়িয়ে এলাম। প্রত্যেক ঈদেরই কিছু না কিছু স্মৃতি রয়ে যায়, তবুও এর মধ্যে উল্লেখ করার কিছু থাকে কিছু থাকে না। যা থাকে না তা একান্ত নিজের মনের গহিনে লুকিয়ে রেখে হাসিকান্না দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। তবে আজকে আমি একটি মজার ঈদের স্মৃতি সবার সাথে শেয়ার করবো, যা কোনদিন কারো সাথে করিনি। অবশ্য সে রকম কোন পরিস্থিতি পরিবেশ হয়নি বলার মতো। সেটি ছিল রোজার ঈদের দিনের কথা।
ক্লাশ নাইনে যখন পড়ি, তারও অনেক আগে থেকেই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ উদযাপন করা বন্ধ হয়ে গেছে। বয়োবৃদ্ধ দাদা দাদী তাদের পল্লীজীবনের যবনিকাপাত ঘটিয়ে নাগরিক জীবনের স্বাদ গ্রহন করে ফেলেছেন ততদিনে। সবাই মিলে মিশে আমরা তখন জুরাইনে থাকি। অর্থ কড়ির প্রচণ্ড টানাটানিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে একান্নবর্তীর সুখ যেন চুইয়ে চুইয়ে বেয়ে পড়ছিল আমাদের ঘরে। তারপরেও আমার বাবার লম্বা জিহবার দুর্নামের প্রমানে প্রায়শই টুকরী ভর্তি বাজার নিয়ে মিন্তির (বোঝা বহনকারী) সাথে রিক্সায় এসে বাসার গেইটে হাক ডাক। টুকরীকে নিচে রেখে পাশে মিন্তিকে বসিয়ে রিক্সা চেপে দুজনে আসত। কখনো সকাল, কখনো দুপুর আবার কখনো বিকাল কিংবা সন্ধ্যা। সুযোগ পেলেই হল সময়ের কোন দাম নেই। মা প্রাথমিক আঘাতে কিছুটা গজ গজ করলেও শেষমেশ সবকিছু করতো তো ঠিকই। সুতরাং সে দিক দিয়ে বড় কোন অসুবিধা ছিল না সময় অসময়ের।
১৯৭৯ এর কথা, তখনো পর্যন্ত প্রাইভেট কারে উঠি নি। লঞ্চ, জাহাজ, ট্রেন, বাস মাইক্রো বাস, মিনি বাস, জিপ, মোটর বাইক, সব গুলোতে উঠা শেষ (বিমান বাদে), কিন্তু প্রাইভেট কারে উঠা হয়ে উঠে নি। উঠবো কিভাবে? তখন তো আমার ১৪ গুষ্ঠির মধ্যে কারো প্রাইভেট কার ছিল না। রেন্ট এ কারেরও প্রচলন শুরু হয় নি, এমন কি ট্যাক্সি ক্যাবও ঢাকায় পদার্পণ করে নি। বেবীট্যাক্সির একচ্ছত্র দৌড়াত্ব তখন সারা ঢাকা জুড়ে। আমি তো আর এমনি এমনি অচেনা কারো কাছে গিয়ে বলতে পারি না, ভাই কিংবা চাচা আমারে একটু আপনার প্রাইভেট কারে চড়িয়ে আমার কলিজাটা ঠাণ্ডা করে দিবেন? সে ক্ষেত্রে কলিজা ঠাণ্ডা করার পরিবর্তে পিঠে ডাণ্ডা পড়ার সম্ভাবনা ছিল বেশী। সে কারনেই শুধু রাস্তায় দেখে দেখে চিত্ত বিমোহিত করতাম, ভিতরে প্রবেশের সুখটা কেন জানি তখন কল্পনাতেও আসতো না। তখন বি আর টি সি কোম্পানি জাপান থেকে ব্র্যান্ড নিউ ইসুজু বাস আমদানি করে বিভিন্ন রুটে চালু করে। কয়েকটি বাস যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, পোস্তগোলা হয়ে ঢাকা - নারায়ণগঞ্জ(?!) হাইওয়ে দিয়েও যাতায়ত করতো। আহহ ঝকঝকে টকটকে লাল নতুন ইসুজু বাসটিকে কেমন যেন গর্বিত পথরাজের মতো সদম্ভে ছুটে চলা কোন বীর শার্দূল বলে কল্পনা হতো। দূর থেকে যদি আসতে দেখতাম আমি তখন পথের পাঁচালির অপু-দুর্গার মতো দৌড়ে কাছে চলে আসতাম আরও ভাল করে দেখার জন্য। বাসের ড্রাইভার কি আর আমার মনের কথা বুঝে? সে অবুঝের মতো সাই করে দ্রুত বেগে আমাকে অবজ্ঞা করে চলে যেতো। তারপরও ক্ষনিক দেখার তৃপ্তি নিয়ে মনটা আনন্দে ঝির ঝির করে দোলা দিতো।
সে সময়ই হটাত করে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাইভেট কারে চড়ার এক বিরল সৌভাগ্য আমার দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে। দিনটি ছিল ঈদের দিন। সবাই মিলে ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে আসি। আমার কোথাও যাবার নেই বলে, সেমাই পায়েস খেয়ে ঘরের এক কোনে বসে আছি মন খারাপ করে। বয়সের অবস্থা হয়েছে না ঘর কা না ঘাটকা। রবি ঠাকুরের ফটিকের যেন এক মূর্তমান প্রতীক আমি। একদম পিচ্চিদের সাথে মিশে দলবেঁধে মহল্লাবাজিও করতে পারছি না আবার বড়দের মতো ভালবাসার মনের মানুষের সাথেও মধু ভ্রমণে যেতে পারছি না। এমন সময় গেটের বাইরে গাড়ীর হঙ্কিং এর একটানা তীব্র আওয়াজ। কিছটা দ্বিধান্বিত মনে বেড়িয়ে দেখি আমার দুই ক্লাসমেট বন্ধু (এরা দুই ভাই একই ক্লাশে পড়তো) একটি প্রাইভেট কারে বসে আছে। আমাকে দেখেই রাজ হাসের মতো জানালা দিয়ে গলা বের করে বলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়, আমরা প্রাইভেট কার দিয়ে ঘুরবো আজকে। প্রাইভেট কারে ঘুরে বেড়ানো ছিল তখনকার দিনে স্বপ্নিল জগতের বিলাসিতা। আমি বলি কোথায় ঘুরবি? সমস্বরে বলে তা জানি না, তুই তাড়াতাড়ি আগে রেডি হয়ে আয় তো? বাসার সবার অনুমতি পেলেও দাদীর আপত্তিকে অনাপত্তিতে রুপান্তরের ঘামঝরানো প্রক্রিয়া শেষে প্রাইভেট কারের ভিতরে শুভ পদার্পণ করি। বসেই চমকে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য আতংক গ্রস্থ হয়ে ভাবছিলাম দৌড় দিয়ে বেড় হয়ে পরবো কিনা? দেখলাম আমি যেন মাটির সাথে লেপটে যাচ্ছি। নিজেকে অসম্ভব ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অনুজীবী মনে হতে লাগলো। এমনকি চির পরিচিত রিক্সাগুলোকেও অনেক উচু বিশাল লাগছে। বসেই অস্থিরতার সাথে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ঘুরতে যাবি? বলে.....এখান থেকে পোস্তগোলা হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরি, যাবো আর আসবো। আমি বলি হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরি গিয়ে কি করবি? দিয়াশলাই কিনবি? মনে মনে একটু হতাশ হলাম। জুরাইন থেকে পোস্তগোলা খুব বড়জোর ৫/৬ মিনিটের পথ। গাড়িটি কোত্থেকে, কিভাবে যোগাড় হল বলতেই আমি যেন মহাভারত অশুদ্ধ কিছু করে ফেলেছি এমন একটা ভাব নিয়ে দুই ভাইয়ের নিরুৎসাহিত সাংকেতিক উত্তরে যা আবিস্কার করতে পারলাম তা হচ্ছে গত এক সপ্তাহ ব্যাপী পিতার চরন যুগলে সাষ্টাঙ্গে জড়িয়ে ধরে ঈদের দিনে ১ ঘণ্টার জন্য তাদের বাবার মিলের প্রাইভেট কারটি নেয়ার অনুমতি আদায় করেছে। আমি বললাম তোদের জানি জিগর দোস্ত আশরাফুলকে বাদ দিয়ে আমাকে নিচ্ছিস যে? ওরা আমাকে বলে, ঐ ব্যাটা সকাল বেলাই বাবার মাইর খেয়ে বাড়ি থেকে ভাগছে, ওরে খুজে পাই নি। মনে মনে বলি খুব ভাল হয়েছে, নইলে কি আর আমি প্রাইভেট কারে চড়ার সৌভাগ্য অর্জন করি!
সেই যে ১৫/২০ মিনিটের জন্য জীবনের প্রথম প্রাইভেট কারে চড়া, এর পর বহুদিন আর চড়তে পারি নি। সেদিনের প্রাইভেট কার চড়াটি আমার ঈদের সকল নিরানন্দকে ভুলিয়ে দিয়ে আমার জীবনে ইতিহাস হয়ে গেথে গেলো।