প্রায়ই কোনো না কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠে আমাদের পাহাড়। অতি সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় আবারো উত্তাল হয়ে উঠেছে আমাদের পাহাড়ি জনপদ। ইতোমধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন, এর মধ্যে সেনাবাহিনীর তিনজন অফিসার সহ ১০ জন সেনা সদস্য ও গুইমারা থানার ওসি সহ ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে অনেক বাড়ি, ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যা সত্যি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যেখানে ন্যায়বিচার ও সহমর্মিতার দাবি তোলে, সেখানে উল্টো সহিংসতা ও বিভাজন আরও ঘনীভূত হওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
আমি আগেই বলেছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তি নতুন কিছু নয়। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জাতিগত বৈচিত্র্য, ভূমি ও বসতি সংক্রান্ত বিরোধ এবং বহিঃশক্তির কৌশলগত প্রভাব এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে দীর্ঘদিন ধরেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাটি কেবল ধর্ষণের বিচার নয়, বরং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতারই প্রমাণ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক জটিল অধ্যায়। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, খিয়াংসহ প্রায় ১১টি প্রধান নৃগোষ্ঠীর বসতি যেমন আছে, তেমনি আছে সমতল থেকে আসা বাঙালি জনগোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর থেকেই এখানকার রাজনৈতিক কাঠামোতে বিভাজন ও অবিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এস. এস. উবানের তত্ত্বাবধানে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স এবং মুজিব বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ দল পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে অভিযান চালায়। এই অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহীদের হটানো। ভারত সরকারের অভিযোগ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে ভারতীয় বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা। সেই সাথে তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় স্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন।
সব মিলে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স এবং মুজিব বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ দলের অভিযানে রাঙ্গামাটিতে একদিনে ৩২ জন মানুষ নিহত হন। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সংবিধানে ‘জাতিগত স্বীকৃতি’ ও ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’ বিষয়গুলোতে অনাগ্রহ দেখালে পাহাড়িদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মায়। সেই ক্ষোভ এবং ভারতের মদদে ১৯৭৩ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। পরবর্তীতে তাদের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গড়ে তোলে এবং দীর্ঘ দুই দশকের গেরিলা আন্দোলন চালায়।
১৯৯৭ সালে জেএসএস ও শেখ হাসিনার সরকারের সাথে হওয়া শান্তি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন অনেক পাহাড়ি জনগণ। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এর পর জেএসএস ও ইউপিডিএফ উভয় সংগঠনই দুইটি করে মোট চারটি ভাগে বিভক্ত হয়। এছাড়া ২০২১ সালে নাথান বমের নেতৃত্বে বম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তরুণদের নিয়ে গড়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এছাড়াও মারমা সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে চাকমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টি। এই পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো প্রায়ই নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পাহাড়কে অশান্ত করে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী অবস্থান এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করেছে। বিভিন্ন গবেষণা ও গোয়েন্দা সংস্থা তথ্যের ভিত্তিতে দেখেছে যে বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত রাখতে ভারতের বিশেষ সংস্থা সক্রিয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগ পর্যন্ত জেএসএস-এর শান্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বিশেষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-শস্ত্র পেয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা " র " শান্তিবাহিনীকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে। ভারতের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে দমনে সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বিশেষ করে চাকমা ও ত্রিপুরদের ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে ঘনিষ্ঠ। এই নৈকট্যকে কাজে লাগিয়ে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পক্ষে মানবিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানের কথা বলে প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও অশান্তির বড় কারণ। বিশেষত চাকমা নেতৃত্বের প্রাধান্য নিয়ে মারমা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিদ্যমান।
ধর্ষণ সমাজের এক ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু পাহাড়ে ধর্ষণের বিচার প্রথাগত সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে করার প্রবণতা অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করছে। অপরাধীরা রাষ্ট্রীয় শাস্তির মুখোমুখি না হওয়ায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সংবিধান ও প্রচলিত আইন পাহাড়েও সমানভাবে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে পাহাড়ে ধর্ষণ মামলার বড় অংশ আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় না। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা, আঞ্চলিক সংগঠন কিংবা সালিশি ব্যবস্থার চাপের কারণে মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়।
বাংলাদেশে বাঙালি ও পাহাড়িদের সহাবস্থান একটি অনিবার্য বাস্তবতা। তবে এই সহাবস্থান কখনো মসৃণ হয়নি। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুললেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা সহাবস্থানের সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোচিত হয়েছে যে, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অবৈধ অর্থের একটি অংশ পাহাড়ে অশান্তি তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে।
পাহাড়ে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ধর্ষণসহ যেকোনো অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। প্রথাগত নেতাদের দায়িত্বশীল করে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগে তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত করা জরুরি। ভারতের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে কূটনৈতিক উদ্যোগ ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে তাদের অর্থের উৎস, কার্যক্রম ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততা বিষয়ে কড়া নজরদারি করতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাঙালি ও পাহাড়িদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড়ি নারীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা পরিকল্পনা, সচেতনতা কার্যক্রম ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


