
বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ উত্তাল ও রক্তাক্ত পথের আজ একটি অধ্যায় চিরতরে সমাপ্ত হলো। " বেগম খালেদা জিয়া আর নেই " এই বাক্যটি কেবল একটি মৃত্যুর সংবাদ নয় এটি একটি সময়ের অবসান, একটি রাজনৈতিক ধারা ও একটি সংগ্রামী জীবনের পরিসমাপ্তি। যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ছিলেন দেশের আপামর জনমানুষের হৃদয়ের কেন্দ্রে , যিনি কারাগারের অন্ধকারে থেকেও ছিলেন রাজপথের মানুষের আশা, রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থেকেও যিনি ছিলেন আপোসহীন সংগ্রামের প্রতীক সেই বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল তার গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক অনন্য অধ্যায়। বেগম খালেদা জিয়া তিনি ছিলেন না কোনো রাজনীতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী। রাজনীতির পাঠশালায় বড় হওয়া কোনো নেত্রীও ছিলেন না তিনি। বরং ইতিহাসের নির্মম চাপে পড়ে, ব্যক্তিগত শোককে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রের দায়ে রূপান্তর করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সেই বিরল চরিত্রের প্রতিনিধি, যার জীবন ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের মধ্যে অবিরাম দোলাচলে আবর্তিত হয়েছে।
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতবর্ষের জলপাইগুঁড়ির নয়াবস্তিতে জন্ম নেওয়া শান্তি নামের শিশুটি কোনো দিন কল্পনাও করেনি, একদিন তার নাম উচ্চারিত হবে রাষ্ট্রক্ষমতা, গণতন্ত্র ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। ব্যবসায়ী বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের সংসারে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটির জীবন ছিল সাধারণ, নিরিবিলি ও রাজনীতিমুক্ত। দেশভাগের পর দিনাজপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে পরিবারটি। সেখানেই তার পড়াশোনা, সেখানেই তার কৈশোর, সেখানেই তার স্বপ্ন ছিল সীমাবদ্ধ একটি সংসার, একটি পরিবার, একটি স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু ইতিহাস ব্যক্তিগত ইচ্ছার ধার ধারে না। কলেজ জীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিবাহ তাকে নিয়ে যায় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে। সামরিক জীবনের শৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা ও স্থানান্তরের বাস্তবতা তাকে পরিচিত করায় রাষ্ট্রক্ষমতার কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে। তবুও তিনি তখনও রাজনীতির নন তিনি একজন স্ত্রী, একজন গৃহিণী।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সেই কালরাত্রি শুধু একটি জাতির ভাগ্য বদলায়নি, বদলে দিয়েছিল খালেদা জিয়ার জীবনও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সূচনার মুহূর্তে তার স্বামী তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তিনি হয়ে ওঠেন দখলদার বাহিনীর চোখে "রাষ্ট্রদ্রোহীর স্ত্রী " । দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে আত্মগোপন, বন্দিত্ব, অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুভয়ের মধ্যে কেটেছে তার মুক্তিযুদ্ধকাল। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে বন্দী হতে হয় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে , দীর্ঘদিন গৃহবন্দী রাখা হয়। স্বাধীনতার বিজয়ের দিন তিনি মুক্তি পান ঠিকই, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তাকে আজীবনের জন্য বদলে দেয়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন রাজনীতির বাইরে। স্বামী রাষ্ট্রপতি হলে তিনি ফার্স্ট লেডির দায়িত্ব পালন করেছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু ক্ষমতার আলোয় থেকেও তিনি নিজেকে রাজনীতির কেন্দ্রে আনেননি। মনে হয়েছিল, তার জীবন বুঝি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৮১ সালের ৩০ মে রচিত হয় এক নির্মম ইতিহাস , যেদিন বাংলাদেশ হারায় তার রাষ্ট্রপতিকে, আর খালেদা জিয়া হারান তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় জিয়ার রহমানকে। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি রাজনৈতিক হত্যাই ছিল না এটি ছিল একটি পরিবার, একটি দল ও একটি রাষ্ট্রের জন্য গভীর সংকটের সূচনা। বিএনপি পড়ে যায় নেতৃত্বশূন্যতায়। সেই শোকস্তব্ধ মুহূর্তেই ইতিহাস খালেদা জিয়াকে সামনে ঠেলে দেয়। তিনি তখনও রাজনীতির ভাষা জানতেন না, আন্দোলনের কৌশল জানতেন না। কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা এবং সময়ের নির্মম দায় তাকে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে রাজপথে নামতে বাধ্য করে। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। একটি জীবন, যা পরবর্তী চার দশক বাংলাদেশের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
খুব অল্প সময়েই তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এই উত্থান কোনো সহজ পথ ছিল না। একই সময়ে দেশে শুরু হয় জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন। বন্দুকের নলের শাসন, গণতন্ত্রের দমন, বিরোধী কণ্ঠ রোধের এক ভয়াবহ অধ্যায় তখন বাংলাদেশকে গ্রাস করে। এই অন্ধকার সময়েই বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ। সাতদলীয় জোট গঠন করে তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম শুরু করেন। বারবার গ্রেপ্তার, বারবার কারাবরণ, নিষেধাজ্ঞা, হুমকি কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার কারাবরণ তার রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের রাজপথের সংগ্রামী মানুষ তখনই তাকে " ‘আপসহীন নেত্রী " উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতন ঘটে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এটি ছিল কেবল একটি ব্যক্তিগত বিজয় নয় এটি ছিল বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম মেয়াদেই তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতার ভার সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেন যা ছিল তার গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের স্পষ্ট প্রমাণ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেন, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের বিষয়ে তার অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়।
১৯৯৬ সালে তিনি আবার ক্ষমতায় এলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার রাজনীতির বিপরীতে তার এই সিদ্ধান্ত ছিল বিরল ও ব্যতিক্রমী। যদিও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, নির্বাচন বিতর্ক ও ক্ষমতার পালাবদলে তিনি বিরোধী দলে চলে যান, তবুও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই সময় তার সরকার নারী শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক মহলেও তার অবস্থান সুদৃঢ় হয়। ২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করে যা তার রাজনৈতিক প্রভাবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তবে তার জীবনের বড় অংশজুড়েই রয়েছে নির্যাতন, মামলা ও কারাবরণের ইতিহাস। ২০০৭ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, সাব-জেলে বন্দী রাখা হয়। সেই বন্দিত্বকালেই তিনি হারান তার মাকে একটি ব্যক্তিগত বেদনা, যা কারাগারের দেয়ালে আরও ভারী হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে আবারও তাকে কারাবন্দী করা হয় দুর্নীতির মামলায়, যেগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করে। দীর্ঘ কারাবাস, চিকিৎসার অভাব, শারীরিক দুর্বলতা সবকিছুর মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি। শর্তসাপেক্ষ মুক্তি, গৃহবন্দিত্ব, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়েও তিনি ছিলেন তার দলের নেতাকর্মীদের আশার নাম।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা ছিল রাজপথের নেতৃত্বে নয়, বরং নৈতিক ও প্রতীকী। দীর্ঘ কারাবরণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তিনি স্বৈরতন্ত্রের জীবন্ত সাক্ষ্য হয়ে ওঠেন। তার নীরবতা ও সংযম আন্দোলনকে সহিংসতা থেকে দূরে রেখে গণতান্ত্রিক বৈধতা দেয়। দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকার এক নাগরিক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পান। তাই এই অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ নেত্রী নন, বরং ইতিহাসের ভার বহনকারী এক নীরব, কিন্তু গভীর প্রভাবশালী উপস্থিতি। ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের মুক্ত আকাশে শ্বাস নিনে বেগম খালেদা জিয়া। আজ তার সেই মুক্তি ইহজগৎ থেকে পরকালের অসীম যাত্রার সূচনা করেছে। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু কেবল একটি রাজনৈতিক নেত্রীর মৃত্যু নয় এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক শক্ত স্তম্ভের পতন। তাকে ভালোবাসা বা সমালোচনা যাই করা হোক না কেন, তার অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে একজন সাধারণ নারী ইতিহাসের নির্মম চাপের মুখে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি ছিলেন আপোসহীন, তিনি ছিলেন দৃঢ়, তিনি ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক। কারাগারের অন্ধকারে থেকেও তিনি রাজপথের মানুষের বিশ্বাস হারাননি। ক্ষমতার মোহে নয়, বরং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় তিনি রাজনীতি করেছেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার জীবন, তার সংগ্রাম, তার আপোসহীনতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নন বরং তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক জীবন্ত অধ্যায় যার সমাপ্তি ঘটল, কিন্তু এর প্রভাব রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায় চিরদিন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




