somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৪ নভেম্বর: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

২০ শে নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৪ নভেম্বর, ২০১০। কোরবানির ঈদের ছুটিতে মানুষ যখন গ্রামেরফিরতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় হরতাল ডাকল বিএনপি। যতদূরমনে পড়ে, বেগম খালেদা জিয়াকে তারক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছেড়ে দিতে সরকার বাধ্য করার প্রতিবাদে ডাকা হয়েছিল ওই হরতাল।আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা (৭ম সেমিস্টার) চলছে। ওই দিনই ছিল শেষ পরীক্ষা। হরতালেপরীক্ষা হবে কিনা, এ নিয়ে সবাই ছিল উৎকণ্ঠায়।পরীক্ষার টেনশন মাথায় নিয়ে কেউ ঈদে বাড়ি যেতে চাচ্ছিল না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়কর্তৃপক্ষও পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে অনড়। তবে শর্ত হলো, একজনও যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে পরীক্ষা হবে না। এসব জানতে পারলাম আগেররাতেই। মনে পড়ে, ওই দিন পরীক্ষা হয়েছিল। আমাদের কোনো একবন্ধু (সম্ভবত শাহাদাত) একটু দেরি করে আসায় পরীক্ষাও শুরু হয়েছিল প্রায় আধঘণ্টাদেরিতে।

সেমিস্টারফাইনাল পরীক্ষা শেষ। স্বভাবতই সবার মনে আনন্দ। রানা, গালিব, ফিরোজ, মেহনাজ, শেলীদের (আর কে কে ছিল ঠিক মনে নেই) সঙ্গে আমিওযোগ দিলাম আড্ডায়। মলচত্বরে। ফিরোজ তখন সাইকেল নিয়ে আসত ক্যাম্পাসে। ফিরোজকে আমিআগে পিছে নামের কোনো অংশ ছাড়াই শুধু ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করি। বললাম, সাহেব সাইকেলটা দেন। একটু চালায়া দেখি। মনে পড়ে, অনেক বছর পর সাইকেল চালিয়েছিলাম সেদিন। ভিসিচত্বর, টিএসসি, কেন্দ্রীয়মসজিদ হয়ে কলাভবনের পেছন দিয়ে ফিরে এসেছিলাম আগের জায়গায়।

আড্ডা দিতে গিয়েকখন যে বাসার এবং ট্রাংকের চাবি হারিয়ে ফেলেছি, টেরপাইনি। ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি গেলেও আমি থাকতাম। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছিল। বাসায়এসে কাউকে না পেলে ৩টি তালা ভেঙ্গে আমাকে রুমে ঢুকতে হবে। সৌভাগ্যবশত ফারুককে পেয়েগেলাম। সে-ই শেষ ব্যক্তি। ২টি তালা ভাঙ্গা থেকে রেহাই পেলাম। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েএসেছে। বাসার অদূরেই তালার মিস্ত্রীর দোকান। ভাবলাম, তাকেডেকে আনি। গিয়ে দেখি দোকান বন্ধ। ঈদ করার জন্য চলে গেছে গ্রামে। রুমে ঢোকার জন্যতালা ভাঙা বা কাটা ছাড়া আর উপায় রইল না। দেখি, মিস্ত্রীরদোকানের পাশের হার্ডওয়ারের দোকানটাও খোলা নেই। পড়ে গেলাম মহা দুশ্চিন্তায়।

দুশ্চিন্তায়পড়ার আরো কিছু কারণ আছে। আমার পকেটে তখন সাকুল্যে ২টি একশ টাকার নোট। ঈদের আগেকয়েকদিনের কাঁচা বাজার করে না রাখলে পড়ে ঝামেলায় পড়তে হবে। ভাবলাম, এটিএম কার্ড তো আছেই। টাকার কোনো সমস্যা হবেনা। কিন্তু বিধি বাম! মানি ব্যাগ ব্যবহার করার অভ্যাস আমি এখনো গড়ে তুলতে পারিনি।নোটপ্যাডের মধ্যে অন্যান্য কাগজসহ ওটাকে রেখে দিই প্যান্টের পেছনের পকেটে।যাত্রাবাড়ীর বুথে টাকা তোলার জন্য গিয়ে পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখি সেটা ভেঙ্গেগেছে। এমনভাবে ভেঙ্গে গেছে যে, সুপার গ্লু দিয়েজোড়া লাগিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব। সাইকেল চালানোর জন্য সিটে বসতে গিয়েই কি সেটিভেঙ্গে গিয়েছিল? জানিনা। ট্রাংকে সম্ভবত ১৫শ টাকা ছিল।ওই টাকাই তখন হয়ে উঠল আমার ভরসা।

এরই মধ্যে কখনযেন এশার ওয়াক্ত হয়ে গেছে। বাড়িওয়ালার কাছে হ্যাচকো ব্লেড নেই। এক প্রতিবেশীকে ফোনদিলাম। বলল, মসজিদে। সে নিশ্চিত করল, বাসায় হ্যাচকো ব্লেড আছে। তবে আসতে আধঘণ্টারমতো দেরি হবে। ততক্ষণে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।

রুমের দরজায় যেতালাটা লাগানো, সেটা ছিল মাঝারি সাইজের চাইনিজ তালা।কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না। ঝামেলা বাধল ট্রাংকের তালা কাটতে গিয়ে। অপেক্ষাকৃত বড়সাইজের তালাটি কাটতে গিয়ে অনেক সময় তো লাগলই; হাতেফোসকাও পড়ল। সে অবস্থা নিয়েই কাঁচা বাজার করার জন্য যেতে হলো যাত্রাবাড়িচৌরাস্তায়।

সেবার কোরবানিরঈদ হয়েছিল সম্ভবত ১৭ নভেম্বরে। আমার মনে আছে, এদুঃখে টানা ৭দিন কোথাও বের হইনি; এমনকি ফ্লাটেরদরজার বাইরেও না। ঘরে বসে ৭দিনে দেখেছিলাম ৯২টি নাটক ও কয়েকটি সিনেমা। সম্ভবতঅর্থকরী কিছু কাজও করেছিলাম। বিগত ১০টি ঈদের অধিকাংশই আমি পার করেছি এভাবে। তবে এঘটনার কারণে ওই ঈদকে মনে রেখেছি বিশেষভাবে।

চাবি হারানোরতিন বছর পেরিয়ে গেলো। আমি এতটাই অলস যে, আজঅবধি তা আর বানানো হয়নি। এর আরও একটা কারণ আছে। আসলে আমি কখনো প্রয়োজনই বোধ করিনি।কখনো মনেই হয়নি, ট্রাংকের জিনিসগুলোর নিরাপত্তার জন্যতাতে তালা লাগানো দরকার; রুমে তালা না লাগালে মূল্যবান কিছুহারিয়ে যাবে। অনেক পরে রুমের জন্য একটা তালা কেনা হয়েছে বটে। কিন্তু আমার কোনোচাবি নেই। রুমমেট এবং মেসের অন্য সদস্যরা যেন সবাই মিলে আমাকে মুক্তি দিয়েছে চাবিবহন করার দায় থেকে।

এখন আমার অফিসকারওয়ান বাজারে। যাত্রাবাড়ী থেকে কারওয়ান বাজার যেতে ভালো সময় লাগে। যানজট একটুবেশি হলে তো কথাই নেই। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, যাত্রাবাড়ী ছাড়তে সমস্যা কী?আমি সুস্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারি না। যারা জিজ্ঞাসা করেন, তাদেরকে আমার নির্ভারও নিশ্চিন্তার কথা এক-দুই বাক্যে বোঝাব কী করে! এখানে আসার ছয় বছর হলো। কতজন এলোগেলো। মেহেদী ও রায়হানই শুধু যেতে পারল না। থেকে গেল। আর আমার রুমমেট কামিনূরেরকথা কীইবা বলব। গত চার বছরে একটি বারের জন্যও তাকে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা মুখেনিতে শুনলাম না। সত্যি কথা হলো, এখান থেকে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই আমার মনে শঙ্কাজাগে। প্রশ্ন জাগে, এমন হৃদ্যতা কী হবে আর কারো সঙ্গে? কেউ কি আমাকে দেবে এতটানির্ভারতা ও দায়মুক্তি?


বিশ্ববিদ্যালয়েপড়ার সময় বন্ধুরাও আমাকে দায়মুক্তি দিয়েছিল অনেক কিছু থেকে। লেকচার শিটের ফটোকপিকিংবা নোট পাওয়ার জন্য আমাকে কখনোই উদ্বিগ্ন থাকতে হয়নি। শিমুল ও সোহান নোটবানালেই ফোন দিয়া বলত, দাদা ফটোকপিও করে রেখেছি। হলে এসে নিয়া যান। লেকচার শিটেরফটোকপির জন্য শেলীকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে রাখতাম। নতুন শিট পেলেই ফোন দিয়া বলত, ভাইসময় করে রানার কাছ থেকে নিয়েন। পরীক্ষার আগের রাত জেগে খুব একটা পড়তে হয়নি। কোথাওবুঝতে সমস্যা হলে ফিরোজকে ফোন দিলেই তার সমাধান পেয়ে যেতাম। বাসা থেকে ক্যাম্পাসেযাওয়ার পথে সম্ভাব্য প্রশ্নের ব্রিফ পেতাম গালিবের কাছে। আর ক্যাম্পাসে গিয়েলেকচার শিটে কী আছে, তার বিস্তারিত বিবরণ পেয়ে যেতাম রানার কাছে। মাস্টার্সে পড়ারসময় দুপুরে পরীক্ষা থাকলে আমরা সকালেই গিয়ে হাজির হতাম সোস্যাল সায়েন্স বিল্ডিংয়েরদ্বিতীয় তলার বারান্দায়। সেখানেই চলত আমাদের পড়ালেখা। সেখানে পড়তে গিয়ে শেলীর লাঞ্চেরজন্য নিয়ে আসা খাবারে যে কতদিন ভাগ বসিয়েছি, সে কী আর মনে আছে! রোকেয়া হলে থাকতবলে জিনাত ও ফারহানাকেও আমার জন্য কম খাটতে হয়নি। ওরা সেটা মেনেও নিয়েছিল, হাসিমুখেই।আর শাহাদাতের হৃদ্যতার কারণে বেঁচে গিয়েছিলাম বই ফটোকপি করার জন্য নীলক্ষেতে যাওয়াথেকে। ভালো কোনো বই পেলে সে-ই ফোন দিয়া বলত, আপনার জন্যও এক কপি করব নাকি? জয়নুল,মুকুল কিংবা সালেহীন— নাম ধরে বলতে গেলে কাউকেই বাদ দিতে পারব না।

মেসের প্রসঙ্গেআর কয়েকটা কথা না বললেই নয়। সমকালে কাজ করার সময় বাসায় ফিরতে আমার রাত সাড়ে ১১টাবা ১২টা বেজে যেত। অত রাতে এসে মাঝে মধ্যেই খাবার নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হতো। মাঝেমধ্যেই দেখতাম ভাত অথবা তরকারি নাই। এক সময় খেয়াল করলাম, তরকারি ভাগ করার পর শাফিকস্যার আমার বাটিটা নিয়ে এসে রেখে দিতেন তার পড়ার টেবিলে। ঢোকার পরেই বলতেন, জাহির,তোমার তরকারির বাটি এখানে। ভাত শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে বাসায় প্রবেশ করার পরপরই মেহেদীজিজ্ঞাসা করত, ভাই কি ভাত খাবেন? হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেই সে ভাত উঠিয়ে দেয়। রুমেঢুকে দেখি, সকালে ধুয়ে বেলকুনিতে রৌদ্রে দিয়ে যাওয়া কাপড়গুলো কামিনূর নিজদায়িত্বেই ঘরে নিয়ে এসে রেখেছে। নিজের কাপড় লন্ড্রী করার সময় আমারও এক-দুইটাপাঞ্জাবী লন্ড্রী করে রেখেছে রেজাউল অথবা অন্য কেউ। সত্যিই, এ যে অন্য ভালোবাসা!


বিধাতা আমার চারপাশে এত মানুষের স্নেহের আয়োজন কেন করে রেখেছেন, জানিনা। মনেরঅজান্তেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখি, কেমনে শোধিব এ ঋণ?

http://goo.gl/NZpb2R
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৬


আমি যখন কানাডায় বসে পাশ্চাত্যের সংবাদগুলো দেখি, আর তার পরপরই বাংলাদেশের খবর পড়ি, তখন মনে হয় - পশ্চিমা রাজনীতির চলমান দৃশ্যগুলো বহু পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আলো-ছায়ায় প্রতীয়মান... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×