somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঠ্য বই নিপাত যাক্

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ডিসেম্বরে ফাইনাল পরীক্ষার পর বেশ কয়েক দিন ছুটি থাকত। ক্লাস টিচাররা এই সময়েও আমাদের পড়ালেখায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতেন। সেজন্য তারা বাড়ির কাজ করতে দিতেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে থাকত ব্যাকরণ পড়া, বাংলা-ইংরেজি হাতের লেখা তৈরি ও নামতা মুখস্ত করা। একেকটা ছুটির দিনের জন্য দুই-তিন পৃষ্ঠা করে হাতের লেখা লিখতে হতো। সে সময় ‘রেখা’ নামে পাঁচ টাকা দামি একটা খাতা পাওয়া যেত। বাংলা ও ইংরেজির জন্য ভিন্ন রকম রেখা টানা। ওসব খাতায় কত পৃষ্ঠা থাকত, তা এখন ঠিক মনে নেই। তবে মনে পড়ে, ছুটির সময়ে লিখে একেকটি খাতা পূর্ণ করতাম। পরে ক্লাস টিচারদের সেগুলো দেখাতে হতো। তারাও চোখ বন্ধ করে স্বাক্ষর করে দিতেন। টানা পনের-বিশ দিন কষ্ট করে লেখা পৃষ্ঠাগুলো ক্লাস টিচার কোনো কিছু না দেখেই যখন স্বাক্ষর দিতেন, তখন মনে খুব কষ্ট লাগত। মনে প্রশ্ন জাগত, তিনি না দেখেই যদি স্বাক্ষর দেবেন, তাহলে আমাদের দিয়ে এই কষ্ট করে নেয়ার মানে কী? শুধু মনে প্রশ্নই জাগত না, রাগও হতো।

বলা বাহুল্য, ছাত্রজীবনে আমার কোনো শিক্ষককে প্রশ্নটা কখনই করতে পারিনি। আর ছুটির সময়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ করতে দেয়ার কী উপকার, তাও আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। আমার মা ছিলেন আরেক কাঠি সরেস। তিনি চাইতেন, ক্লাস শুরুর আগেই নতুন ক্লাসের বইগুলো অন্তত একবার পড়া হয়ে যাক। যাতে পরবর্তী ক্লাসে ভালো ফল করতে কোনো সমস্যা না হয়। সেজন্য ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই পরবর্তী ক্লাসের বই সংগ্রহ করে সেগুলো পড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তিনি। এ কারণে ফাইনাল পরীক্ষা-পরবর্তী দিনগুলো সেই অর্থে আর ছুটির দিন থাকত না। নিত্যদিনের মতো সকাল ও সন্ধ্যায় বসতে হতো বই নিয়ে।

ছেলেবেলার এসব কথা মনে পড়ল এক শিক্ষার্থীকে দেখে। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাতা নিয়ে ছোটাছুটি দেখে তার জন্য খুব মায়া হলো। বললাম, চল পড়তে বসার পরিবর্তে আমরা বরং লুডু খেলি। সে তখন পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আমার হাতের লেখাটা কি তুমি লিখে দেবে?’ তার এ প্রশ্ন আমাকে শুধু আহতই করল না; মনে ক্ষোভও জাগাল। তার অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতি। একটি শিশুর ছুটির আনন্দ কেড়ে নেয়ার এ কী হাস্যকর আয়োজন!!! একে ‘নিষ্ঠুরতা’ হিসেবে অভিহিত করা কি ভুল হবে?

অভিজ্ঞতা বলে, সন্তান ক্লাসের পরীক্ষায় প্রথম হতে না পারলে আমাদের মা-বাবারা যতটা মনে ব্যথা পান, অন্য কোনো কারণে হয়তো ততটা পান না। একইসঙ্গে সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তারা যতটা খুশি হন, অন্য কোনো সাফল্য তাদের এতটা খুশি করতে পারে না। প্রসঙ্গত এ ব্যাপারে আমার এক বন্ধুর গল্প বলি। বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় একটি ইভেন্টে প্রথম হয়েছিল সে। পুরস্কার নিয়ে বিকেলে বাড়িতে ফিরে তার বাবাকে জানাল। তিনি তাকে উৎসাহ জোগানোর পরিবর্তে এ কথা বলে ভর্ৎসনা করলেন, ‘তুই তো ক্লাস পরীক্ষায় ফার্স্ট হইতে পারিস নাই।’ বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের বেশির ভাগ বাবাই এ রকম। সন্তান ক্লাস পরীক্ষায় প্রথম হওয়া তাদের যতটা আনন্দিত করে, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার কোনো ইভেন্টে প্রথম হওয়া কিংবা বিশেষ কোনো কৃতিত্ব প্রদর্শন, তাদের তেমনভাবে আনন্দিত করে না। এ থেকে কিন্তু এটাই প্রমাণ হয়, পড়ালেখার বাইরের অর্জনগুলোকে ‘অর্জন’ কিংবা ‘কৃতিত্ব’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মানসিকতা আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

প্রশ্ন হলো, পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটাই কি একজন মানুষের জীবনের চরম সার্থকতা? পরীক্ষায় যারা ভালো করে, ক্লাসে যারা প্রথম হয় শুধু তারাই যে কর্মজীবনে ভালো করবে, এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? আমাদের চারপাশে এখন ভালো ফল নিয়ে পাস করা শিক্ষার্থীর ছড়াছড়ি। সবাই কি কর্মজীবনে ভালো করছে? শিক্ষাজীবনে ভালো ফল না করেও কর্মজীবনে যে ভালো কিছু করেছে, এমন উদাহরণও কি চারপাশে আমরা দেখছি না? তাহলে ভালো ফল করার এই অসুস্থ প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ কী? হোমওয়ার্ক আর পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছুটির আনন্দ মাটি করারও কি কোনো যুক্তি আছে?

আমাদের মনে রাখা দরকার, অবসর যাপন কিংবা খেলাধুলাও একজন শিক্ষার্থীর জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সারাক্ষণ হাতে বই দিয়ে রাখলে একজন শিক্ষার্থীর এক ঘেঁয়ে লাগাটাই স্বাভাবিক। এতে বই ও পড়ালেখার প্রতি সৃষ্টি হয় বিতৃষ্ণা। জীবনে উন্নতির জন্য পড়ালেখার দরকার আছে অবশ্যই। এটা তো ঠিক, বছরের পুরোটা সময় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকে। বিশ্রাম কথাটির প্রকৃত অর্থ হলো- কাজের প্রস্তুতি। এখন ছুটির সময়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্রাম নিতে না পারলে পরের ক্লাসে ভালো করতে পারবে না।

অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, ডিসেম্বরের ছুটির দিনগুলোয় সন্তানের হাতে বই তুলে দেবেন না। তাকে একটু দম নেয়ার সুযোগ দিন। ভাতঘুম দিয়ে সেও একটু অলস সময় কাটাতে শিখুক। অথবা সামর্থ থাকলে তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। এতে জীবন ও জগত সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হবে তার মধ্যে। দয়া করে এ সময়ে বই নিয়ে বসতে বাধ্য করা থেকে বিরত থাকুন। বছরের কয়েকটা দিন বই হাত দিয়ে না ছুঁলে একজন শিক্ষার্থীর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না।

ডিসেম্বরে ছুটির দিনগুলোয় আমাদের শিশুরা নির্ভয়ে স্লােগান দিক- পাঠ্য বই নিপাত যাক্।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৬


আমি যখন কানাডায় বসে পাশ্চাত্যের সংবাদগুলো দেখি, আর তার পরপরই বাংলাদেশের খবর পড়ি, তখন মনে হয় - পশ্চিমা রাজনীতির চলমান দৃশ্যগুলো বহু পথ পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আলো-ছায়ায় প্রতীয়মান... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×