somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রশ্ন

১৯ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি সম্পূর্ণ একা একজন মানুষ।

প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখি জানালা দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে আমার বিছানায় নকশা আঁকছে। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বুঝি কোনও গুপ্তধন সন্ধানের ম্যাপ, গভীর রহস্য লুকিয়ে রেখে মিটি মিটি হাসছে। এ এক অপার্থিব অনুভূতি। কিন্তু সেই নকশা গায়ে মেখে যে দুই মিনিট বিছানায় গড়াগড়ি খাব সেই উপায় নেই। কারন ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে আমার জীবন্ত অ্যালার্মক্লক টমির শ্রুতিকটু ঘেউ ঘেউ রব। প্রতিদিন ঠিক ৭টা বাজে সে প্রচণ্ড চিৎকারে বাড়ি মাথায় তোলে। এক্ষুনি তাকে নিয়ে বাইরে হাটতে যেতেই হবে। তা নাহলে চিৎকার থামবে না কিছুতেই। আমি একটা শার্ট গায়ে দিয়ে রেডি হয়ে নেই। আমার একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। মাঝে মাঝে মনটা চায় কুকুরটার দুচোখের মাঝ বরাবর একটা তপ্ত বুলেট ঢুকিয়ে দেই! এই অভিশপ্ত কুকুরটা কি বিশ্রাম কি জিনিস তা বোঝেনা?

ঘড়ি ধরে ৫ মিনিট যখন হাঁটাহাঁটি করি তখন মনে পড়ে যায় ঠিক ৫৫ মিনিট পর আমার বসের সাথে দেখা করতেই হবে। বাসায় ফিরে আমি ২ মিনিট বিশ্রাম নেই। বিশ্রামটা ঠিক ২ মিনিটই হতে হবে। ১ সেকেন্ডও কম বেশি হলে চলবে না। তারপর ঠিক ৫ মিনিটের মধ্যে গোসল, ৩ মিনিটের মধ্যে সেভ ও ২ মিনিটের মধ্যে দাঁত মাজা শেষ করি। এর পর ৫ মিনিটের জন্য ভাবি আমি আজ কোন শার্টটা পড়ব, কোন প্যান্ট পড়ব, টাইটা শার্টের সাথে মানাচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ৫ মিনিট দৈনিক পত্রিকা ঘাটা ঘাটি করি। খুন, ধর্ষণ আর এক্সিডেন্টের খবরগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে খিদে মরে যায়। তারপরও ফ্রিজ থেকে কিছু একটা বের করে খেয়ে নেই। খাওয়ার জন্য ১০ মিনিটের চেয়ে এক সেকেন্ডের বেশি খরচ করা যায় না। খাদ্য গ্রহনের পাশা পাশি একটু টেলিভিশন দর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু ৫ মিনিটের বেশি দেখা হয় না। কত চ্যানেলে কত পোগ্রাম! কিন্তু কোনও পোগ্রামে আগ্রহ ধরে রাখতে পারিনা। একটা সময় ছিল যখন শিউলির সাথে টিভি দেখা নিয়ে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে যেত। আমি হয়ত খেলা বা নিউজ দেখব কিন্তু শিউলি দেখবে সিরিয়াল। অনেক আনন্দের ছিল সেই দিন গুলি! আমিকি কখনও ভেবেছিলাম কোনও একদিন এভাবে একলা একা রিমোট হাতে বসে থাকতে হবে? কেউ ছো মেরে সেটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে না? যাক! এই সব ভেবে নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে একদমই নেই। চাকরি বাঁচাতে হলে ৮টার মধ্যে অফিসে পৌছাতেই হবে। গড়ে ২৫ মিনিট লাগে বাসা থেকে অফিস পৌছাতে। অফিস থেকে আমাকে সুন্দর একটা গাড়ি দেয়া হয়েছে। নিজেই ড্রাইভ করি।

***

৮টা বাজার ৫ মিনিট আগেই অফিসে পৌছাই। ডেস্কে বসার পর কলিগ হাবিবুল্লাহ আসেন হাসতে হাসতে। ৫ মিনিট ধরে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন গতরাতে কি করেছেন, কি দেখেছেন, কি খেয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি শুনছি কি শুনছিনা তাতে তার কোনও মাথা বাথা নেই। ঠিক ৫ মিনিট পর থামেন তিনি। থামেন বললে ভুল হবে, থেমে যেতে হয়। কারন বসের কামড়ায় আমার ডাক পড়ে।

আমার বস জনাব রহমত আলি দেশের সব চেয়ে বড় কনসালটেন্সি ফার্মের মালিক। নাম রহমত হওয়ার গুনেই হয়ত ওপরওয়ালা তার সব কিছুতেই রহমত করেছেন। টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ির অভাব নেই লোকটার। কিন্তু ওপরওয়ালা হয়ত লোকটার দিলে রহম দিতে ভুলে গেছেন। “খারাপ ব্যাবহার কাকে বলে? কত প্রকার ও কিকি?” এই ধরনের কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি যদি কেউ হন তাহলে একবার কষ্ট করে এই মানুষটার সাথে দেখা করে যাবেন। ওনার এই খানে যারা কাজ করে তারা একটা সুবিধাই শুধু পায়, মাস শেষে সবার পকেটটা বেশ গরম হয়ে যায়। ব্যাস, এতটুকুই।
ডাক পড়ার পর আমি রুমে ঢুকে দাড়িয়ে থাকি । বস কাটায় কাটায় ঠিক ২ মিনিট ধরে একটা ফাইলে চোখ বুলান। যেন এখানে অন্য কারও উপস্থিতি সম্পর্কে ভুলেই গেছেন। তার পর তার সেই চিরচেনা কমপ্লেইন, “আপনি কোনও একটা কাজ ঠিক মত করতে পারেন না। কি করেছেন এই সব? এই জন্যই কি মাসে মাসে আপনাকে এতগুলো টাকা........” এর পর বস তুই তোকারি করে মিনিট খানেক কিছু খিস্তি খেউর আউরাবেন। প্রতিদিন দাঁতে দাঁত চেপে তা এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীদের তুলনায় আমি কাজ অনেক ভাল পারি। কিন্তু অন্যদের তুলনায় আমি গালাগাল বেশি খাই। এর একটা কারন অবশ্য আছে- মোসাহেবি। অন্যদের মত বসের যেকোনো কথায়, “জী স্যার আপনিই ঠিক বলেছেন”, “একদম খাটি কথা বলেছেন” এই ধরনের বাক্য আমি উচ্চারন করিনা। এই জিনিসটা আমি কেন যেন পারিনা। সবাই শুক্রবার বন্ধের দিনে, ঈদের দিনে বা অন্য যেকোনো উপলক্ষে বসকে বাড়িতে নিমন্ত্রন জানায়। ভাল মন্দ খাওয়ায়। ভাবছি সামনে কোনও ভাল উপলক্ষ এলে বসকে বাড়িতে ডাকব। ভাল ব্র্যান্ডের শ্যাম্পেন অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে, ঐ জিনিসটা বসের খুব পছন্দ।

আমার অবশ্য হারাবার কিছুই নেই। এই চাকরি করা আমার জন্য মোটেও জরুরী না। চাকরি চলে গেলে খুব একটা ক্ষতি হবেনা। একলা মানুষ, কোনও স্বপ্ন নেই, কোনও আশা নেই, নতুন করে ঘর বাধার ইচ্ছা নেই। তারপরও সব অপমান সহ্য করে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছি। এর পিছনে একটা কারন আছে। কারণটা হলেন আমার বাবা। বাবা সারাজীবন আক্ষেপ করেছেন আমাকে নিয়ে। বাবা চাইতেন আমি সকাল করে ঘুম থেকে উঠব, নিয়ম করে খাবার খাব, দায়িত্ব যা আছে ঠিক মত পালন করব, বড়দের কথা মানব অর্থাৎ সব মিলিয়ে একজন নির্ভেজাল ভাল মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি আমাকে ঠিক তেমনটি দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় কখনও আমি নিয়ম মেনে চলিনি। সব কাজেই আলসেমি করা ছিল আমার একটা বড় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি নিজেকে একজন নির্ভেজাল ভাল মানুষ হিসেবে পরিনত করার চেষ্টা করে চলেছি। একটা উদ্দেশ্যহীন অথচ সমৃদ্ধ জীবন যাপন করে চলেছি। তবে মাঝে মাঝে ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়, প্রচণ্ড আক্রোশে সব ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু আমার ডিফেন্স মেকানিজম খুব স্ট্রং, রাগের লাগাম টেনে ধরে সময়মত।

ঠিক রাত ৯ টায় অফিস থেকে ছাড়ে আমাকে। যাওয়ার সময় যেখানে ২৫ মিনিটের রাস্তা, আসার সময় তা হয়ে যায় ৫০ মিনিটের। কারণটা অভিশপ্ত ট্র্যাফিক জ্যাম ছাড়া কিছুই নয়। প্রতিবার ট্র্যাফিক জ্যামে পড়লেই বাবার কথা মনে পড়ে যায়। আমার বাবা ছিলেন একজন ট্র্যাফিক পুলিশ। এবং একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার হল তিনি ছিলেন সৎ মানুষ। জীবনে একটা টাকাও ঘুষ খাননি। যদিও এই জন্য তিনি কখনও কোনও পুরস্কার বা স্বীকৃতি পান নি। বাবা ঘুষ খান না এই বিষয় নিয়ে আমার মায়ের ভীষণ আক্ষেপ ছিল। অভাবে অনটনে দিন কেটেছে কিন্তু বাবা নীতিতে ছিলেন অনড়। কিন্তু একটা সময় তার এই সৎ থাকার ব্রত ভাঙতে হল। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল। সবার দুয়ারে দুয়ারে মায়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হলেন বাবা। শেষে প্রচণ্ড দুঃখভারাক্রান্ত মনে সিদ্ধান্ত নিলেন অসৎ হবেন। প্রথম দানেই বড় দাও মারতে চেয়েছিলেন। চোরাচালানের মাল আর অবৈধ অস্ত্রের চালান ছেড়ে দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা বখশিশ পেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কীভাবে যেন ধরা খেয়ে গেলেন। ৬ বছরের জেল হয়ে গেল। বাবা অবশ্য ৬ বছর পর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন নি। ৬ দিনের মাথায়ই আত্মহত্যা করলেন।

আবোল তাবোল চিন্তা করতে করতে একসময় বাড়িতে পৌঁছে যাই। আমার বাসার কাছে একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে ঠিক ২০ মিনিটের মধ্যে ডিনার সাড়ি। এদের আবার লালপানি রাখার লাইলেন্স আছে। ওয়েটারকে বলতেই ২ মিনিটের মধ্যেই একটা পাসপোর্টের বোতল এসে হাজির হয়। আরও প্রায় আধাঘণ্টা ধরে উচ্চশব্দের জ্বালাময়ী হিন্দিগান শুনি আর মদ্যপান করি।

বাসায় যখন ফিরি ঘড়িতে তখন ঠিক ১০টা বাজে। আমি তখন একটা বদ্ধ মাতাল। সারাদিন সময়ের হিসাব রাখলেও এই সময়টাতে আর সময়ের কোনও হিসাব থাকেনা আমার। শুধু সময়ের হিসাব নয়, কোনও হিসাবই আর ঠিক থাকেনা। ডিফেন্স মেকানিজম দুর্বল হয়ে পড়ে। আগেই বলেছি আমি সম্পূর্ণ একলা মানুষ। বাড়িতে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকেনা। বসার ঘরে সোফার উপর হাত পা মেলে দিয়ে অনির্দিষ্টকাল পড়ে থাকি। লাইট জালানোর কোনও প্রয়োজন দেখছিনা। কিছুক্ষনের মধ্যেই অন্ধকার চোখে সয়ে আসে। কোথথেকে যেন হালকা একটু আলো আসে। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে সাজিয়ে রাখা সো-পিস গুলোকে মড়ার খুলি বলে মনে হয়। আমার দিকে তাকিয়ে সেগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসতে থাকে। জানিনা এভাবে অন্ধকার গায়ে মেখে বসে থেকে কতটা সময় কেটে যায়।

তবে দিন গুলো সব সময় এমন একাকী ছিল না আমার। একটা সময় কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করে না খেয়ে বসে থাকত। যদি কোনওদিন আমি বাইরে থেকে খেয়ে বাসায় ফিরতাম তাহলে সে রাগ করে না খেয়েই শুয়ে পড়ত। একবার রাগ করে বসলে শিউলির রাগ ভাঙাবে সেই সাধ্য আছে কার? কখনও কখনও ২-৩ দিন লেগে যেত ওকে মানাতে। কিন্তু একটা সময় শিউলি এই অপেক্ষা করে বসে থাকাটা বন্ধ করে দিল। কেমন যেন বদলে গেল সে। আমি ছিলাম কাজের নেশায় পাগল। শিউলির এই বদলে যাওয়াটা একদমই চোখে পড়েনি আমার। যখন পড়ল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

সেই রাতের আকাশে আজকের মত ঝলমলে রুপালী চাঁদ ছিল না, ছিল ঘোর অমাবস্যা। অফিসের একটা কাজে সেদিন আমার চিটাগং যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাজটা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায় বাসায় চলে এলাম। রাত কত হবে? ১০টা-১১টা! এসময় সাধারণত শিউলি টিভি দেখে। আমি চিন্তা করলাম শিউলি যেহেতু জানে আমি চিটাগং যাচ্ছি, হঠাৎ কোনও ভাবে শিউলিকে সারপ্রাইজড করে দেয়া যায় কিনা! আমাদের বাড়িটা ছিল মিরপুর ১২ নম্বরে। নির্জন এলাকা, খুব বেশি বসতবাড়ি ছিলনা আসে পাশে। একতলা ছিলছাম আর সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে ভেতরে ঢোকার একটা গোপন পথ আছে। পথটা আমি আর শিউলি মজা করার জন্য বানিয়ে ছিলাম। আমি সে পথ দিয়ে বাসায় ঢুকলাম। বসার রুম দেখলাম খালি, আলো জলছে কিন্তু টিভি অফ। শোয়ার ঘর থেকে হালকা গান বাজার আওয়াজ পাচ্ছি। বোধহয় শিউলি শুয়ে শুয়ে গান শুনছে। এটা ওর অনেক দিনের অভ্যাস। আমি পা টিপে টিপে রুমের কাছে গিয়ে ভেতরে উকি দিলাম। কিন্তু সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হলাম। রুমে শিউলি একা ছিলনা। পাশের বাসার রনি নামের বেকার ছেলেটা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অন্য স্বামীরা কি করত জানিনা। হয়ত রাগে ফেটে পড়ত। আমি কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম। চুপচাপ ওখান থেকে সরে আসলাম। বসার রুমে এসে স্থির হয়ে বসে থাকলাম, ঠিক আজ যেমনটি আছি। একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল এর পরের ঘটনাগুলো কীভাবে যেন দিন দিন আমার সৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে। আবছাভাবে শুধু এতটুকু মনে আছে যে সেদিন দুটোর বেশি গুলি খরচ করার প্রয়োজন পড়েনি।

***

কেমন হয় যদি একদিন আমার কুকুরটা আমায় ডেকে না তুলে? যদি ঘুম ভেঙে দেখি অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ প্রায় ৪০ মিনিট বেশি ঘুমিয়েছি? কুকুরটা কি আজ ডাকতে ভুলে গেল? আজ কি আর বাইরে হাটতে যাবেনা? আমি প্রমাদ গুনলাম। এখন যদি নাওয়া-খাওয়া সব ফেলেও অফিসে রওনা দেই তাতেও প্রায় আধাঘণ্টা লেট হয়ে যাবে। আর আধাঘণ্টা লেট মানে মহা বিপদ সংকেত! কি করা যায় তা ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যায় আরও ৫ মিনিট। অফিসে একটা ফোন দিয়ে বরং বলে দেই আমি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছি, আজ আর আসা পসিবল না।

কাপা কাপা হাতে বসের সেক্রেটারির নম্বরে ফোন দিলাম। বসের সেক্রেটারি মেয়েটার নাম রিনা। রিং হয়ে চলেছে, আমি টেলিফোন কানে লাগিয়ে মেয়েটার মিষ্টি কণ্ঠের হ্যালো শুনার অপেক্ষায় রয়েছি। রিসিভ করল রিনা, হ্যালোও বলল। কিন্তু মিষ্টি কণ্ঠটা কেমন যেন ম্লান শুনাল। আমি নিজের পরিচয় দিতেই সে বলল, “জাভেদ ভাই, আজ আর অফিসে আসতে হবেনা আপনাকে। কি যেন একটা সমস্যা হয়েছে এখানে! গতকাল থেকে বসের কোনও খবর নেই।”
ওখানে আবার কি সমস্যা হল? যাক এটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এমনভাবে একটা দিন ছুটি পেয়ে যাওয়াতে দারুন খুশি লাগছে আমার। এভাবে কোনও পূর্ব নোটিশ ছাড়াই একদিনের কর্ম থেকে অব্যাহতি পাওয়া আমার জন্য সোনার হরিন হাতে পাওয়ার সমান। সেই খুশিতে বিছানায় আরও কিছুক্ষন গড়াগড়ি করা চলুক! টমির কি হল, আজ সে ডাকলনা কেন সেটা দেখা দরকার। ওকি বুঝতে পেরেছিল যে আজ আর আমার অফিস যাওয়া লাগবে না? মরুকগে! তাতে কে আসে যায়? হঠাৎ কোত্থেকে যেন রাজ্যের আলসেমি এসে ভর করেছে আমার উপর! এই মুহূর্তে আর বাইরে যেতে মন চাইছে না। আজকের দিনটা মনের মত করে কাটানো যাক।

আস্তে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। কোনও মতে একটু দাঁত ব্রাশ করলাম। তাতেই ৫ মিনিট সময় ব্যয় হল। আজ আর সেভ করে কাজ নেই। ফ্রিজ থেকে কেক বের করলাম। টিভি ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসলাম। B4U চ্যানেলে রগরগে হিন্দি আইটেম সং দেখাচ্ছে একটা, কারিনার হালকাত জাওয়ানি। আমি একটু নড়ে চড়ে আরাম করে বসলাম। কেকে একটা কামড় বসালাম। কিছুটা কেক আমার থুতনিতে লেগে গেল। বা হাত দিয়ে থুতনি মুছতে গিয়ে খেয়াল হল গলার কাছে কিসের যেন প্রলেপ লেগে আছে! কি লাগল আবার? আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম দেখার জন্য। কালচে একটা ছাপ পড়েছে। কিসের দাগ? রক্ত নয়ত? রক্ত এলো কোত্থেকে? সেভ তো করিনি আজকে! যাক, যা হয় হবে, কি আসে যায়? আবার টিভির পর্দায় মনোযোগ দিলাম। লাইফ কি নটি কাহানী...এ হালকাত জাওয়ানি... কেকে আবার কামড় বসাতে গিয়ে ঘাড়ের পেছনের দিকটায় ব্যথা অনুভুত হল। হাত দিলাম ঘাড়ে। এখানেও কিসের যেন দাগ লেগে আছে মনে হল। ঘটনা কি? কোথাও কেটে গিয়েছিল নাকি? মনে পড়ছে না তো! শরীরের আর কোথায় কোথায় রক্ত লেগেছে কে জানে? শাওয়ার সেরে ফেলা দরকার।

বাথরুমে এসে দিগম্বর হলাম। শরীরের যায়গায় যায়গায় রক্তের ছাপ মনে হচ্ছে! শাওয়ার ছেড়ে দিলাম। সাবান দিয়ে ঘষে পুরো শরীর পরিস্কার করতে হবে। হঠাৎ চোখ পড়ল বাথরুমের দেয়ালের উপর। ওহ, মাই গুডনেস! সারা বাথরুমের দেয়ালে আর মেঝেতে যেন রক্তের নকশা আঁকা হয়েছে। রক্ত রক্ত রক্ত! এত রক্ত এলো কীভাবে? শত চেষ্টা করেও গত রাতে কি ঘটেছিল মনে করতে পারছি না। শুধু অবচেতন মন বলছে খারাপ কিছু ঘটেছে। কি ঘটেছে সেটা বের করার আগে রক্তের দাগ মুছে ফেলা দরকার। আমি দ্রুত বালতি তে পানি নিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে শুরু করলাম। এই কাজ আমার কাছে নতুন না। যেদিন দুটো বুলেট খরচ করেছিলাম সেদিনও অনেকক্ষণ ধরে এই কাজ করতে হয়েছিল আমাকে। কেউ কিচ্ছু টের পায়নি।

হঠাৎ কলিং বেল বাজার শব্দ হল। এই সময় কে এলো? যেই আসুক এখন যাওয়া যাবেনা। আগে দাগগুলো মুছে ফেলা দরকার। ৫ সেকেন্ড পরেই আবার কলিং বেল বাজল। একবার কলিং বাজনর পর অন্তত ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়। যে বা যারা এসেছে এই ভদ্রতা জ্ঞানটুকু বোধহয় তাদের নেই। অথবা যে বা যারা এসেছে সে বা তারা কেউ ভদ্রলোক নয়। আমি নিজের কাজে মন দিলাম। ৫ সেকেন্ড পর আবার কলিং বেলের শব্দ। এবার পর পর দুবার বাজল। মনে হচ্ছে আগন্তুক বা আগন্তুকরা খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে। আমি দ্রুত হাত চালানোর চেষ্টা করছি। পারছি না। ঘামছি ভীষণ। হাত-পা কাঁপছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারছি না। আরও ৫ সেকেন্ড পর কলিং বেল বাজল, এবার পর পর তিন বার। ঘটনা কি? অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় উকি দিচ্ছে।

১. গতরাতে ঠিক কি ঘটেছিল?
২. কে বা কারা কলিং বেল বাজাচ্ছে?
৩. আজ অফিসের সব কাজ বন্ধ কেন?
৪. আমার বসের হঠাৎ করে কি সমস্যা হল?
৫. আমার কুকুর টমির সাড়া শব্দ পাচ্ছিনা কেন?

প্রশ্ন অনেক গুলো, কিন্তু উত্তর জানা নেই আমার। আচ্ছা! আমি কোনও স্বপ্ন দেখছি না তো? এমনকি হতে পারে, যা দেখছি সবই আমার ভয়ংকর কোনও একটা দুঃস্বপ্নের অংশ? আমি প্রানপনে চাইছি যেন স্বপ্নটা ভেঙে যায়। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার কোনও লক্ষন দেখছি না। দ্রুত হাতে রক্ত সাফ করছি। এদিকে কলিং বেল বেজেই চলেছে............
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:১৭
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×