somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নোঙরছেড়া

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এতিম খানার জরাজীর্ণ গেটের সামনে এসে জিপ থামালাম। গেটের উপরে একটা সাইনবোর্ড। কোনও এককালে হয়ত সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়া যেত। এখন বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে কসরত করলে পড়া যায় “মুছলেমবাগ আদর্শ এতিমখানা”।
একটু নিচে ছোট করে কিছু লেখা আছে। হাজার কষ্ট করেও এখন আর সেটা পড়া সম্ভব নয়। সম্ভবত “স্থাপিতঃ অমুক সাল” টাইপের কিছু লেখা! গেটে কিছুক্ষন ধাক্কাধাক্কি করার পর একজন এসে খুলে দিল। সালাম দিল আমাকে।

ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল একটা ছেলেকে ধরে কয়েকটা ছেলে বেদম পিটাচ্ছে। আর কয়েকটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে মজা দেখছে। আমাকে দেখে ছেলেগুলো থেমে গেল। এতিমখানার কেয়ার টেকার মতলব মিয়া একটা লাঠি হাতে দৌড়ে এল, “ওরে হারামজাদা, বদমাইশ, বেজন্মা! তোগরে না কইলাম ফাইজলামি শয়তানী করবি না...” ছেলেগুলো সব দৌড়ে পালাল।

মতলব মিয়াঁর চোখ পড়ল আমার উপর। দাত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। “ভাইজান, চইলা আসছেন? স্যার আমাকে বলেছেন আপনি আসতেছেন”।

এই এতিমখানায় আমি মোটামোটি পরিচিত মুখ। আমার বড়খালু হাজী ইকবাল আহমেদ এতিমখানার মালিক। বেশ কয়েকবার আসতে হয়েছে এখানে। ঈদ ও অন্যান্য উপলক্ষে বাবা মা এসে এতিমখানার বাচ্চাদের খাবার আর কাপড় চোপড় দিয়ে যায়। আমি বললাম “হ্যা মতলব মিয়াঁ। কই? সেই চোরের বাচ্চা কই?”

“অফিস ঘরে বাইন্ধা রাখছি ভাইজান। আসেন আমার সাথে...”

অফিস ঘরে ঢুকে দেখলাম একটা ১৪-১৫ বছর বয়সী ছেলে চেয়ারের সাথে বাঁধা। আমি মতলব মিয়াঁ কে বললাম, “ওর বাঁধন খুলে দাও। আমি কথা বলব”।

“কথা বলার তো কিছু নাই ভাইজান! হারামজাদারে হ্যান্ডকাফ পরাইয়া হাজতে নিয়া যান। তারপর ইচ্ছামত ডলা দেন”।

“আহ! যেটা করতে বলেছি কর”।

মতলব মিয়াঁ বাধন খুলে দিল। আমি ভালভাবে ছেলেটাকে দেখলাম, পরনের গেঞ্জি আর কাল রঙের প্যান্ট যায়গায় যায়গায় ছেড়া, মাথার চুল উস্ক খুস্ক, ঠোঁটের কোনে রক্তের দাগ। বুঝা যাচ্ছে ভালই মার খেয়েছে।

“ওকে মেরেছে কে?”

“পাবলিকে মারছে স্যার!” মতলব মিয়াঁ বলল। “দোকান থেইকা খাবার চুরি করতে গিয়া ধরা পরছে। পাবলিকে ধইরা পিটানি দিছে। তারপর এতিমখানায় দিয়া গেছে”।

ছেলেটি যেভাবে মতলব মিয়াঁর দিকে তাকাল তাতে বুঝতে পারলাম এতিমখানায় আসার পর মতলব মিয়াঁও তাকে যথেষ্ট মেরেছে। “ও এতিমখানার ফান্ড থেকে কত টাকা চুরি করে পালিয়েছিল?”

“ ৫০০০ টাকা”!

এবার আমি ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম। “এই বদমাইশ! দোকান থেকে চুরি করলি কেন? ৫০০০ টাকা দুদিনেই খরচ করে ফেলেছিস? জুয়া খেলেছিস নাকি?”

ছেলেটি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনও কথা বলল না। আমি বেশিরভাগ সময় দেখেছি চুরি করে ধরা পড়ার পর চোরদের চেহারায় একটা করুন ভাব চলে আসে। অন্যের সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তারা এটা করে। যাতে মার-ধর একটু কম খেতে হয়। গালি গালাজ এদের কাছে কোনও বিষয় না। দুই একটা মার খেলেই এরা বাবাগো মাগো বলে কাঁদতে শুরু করে। অপরদিকে, কিছু অপরাধী দেখা যায় যারা ধরা পরার পর চোখের দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে ভস্ম করে দিতে চায়। মার-ধর এদের কাবু করতে পারেনা। কিন্তু বাজে গালাগালি করলে তাদের গায়ে ভালই লাগে! এই ছেলেটি ২য় প্রজাতির অপরাধী। তবে অপরাধী যেমনই হোকনা কেন তাকে বশে আনার পদ্ধতি আমার জানা আছে।

“এই শুয়োরের বাচ্চা কথা বলছিস না কেন?”

ছেলেটা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। মতলব মিয়াঁ বলল, “দেখছেন ভাইজান? কেমনে তাকায় আছে?”

আমি আবার বললাম, “বেজন্মার বাচ্চা, কথা বলিস না কেন? ৫০০০ টাকা কি করেছিস?”

ছেলেটি এইবার কথা বলল, “বেজন্মা আমার নাম না। আমার একটা নাম আছে – কাদের”।

“ওহ! বেজন্মা বলেছি দেখে তোমার গায়ে লাগছে?” এগিয়ে গিয়ে মুখের উপর সপাটে হাত চালালাম। কাদের চেয়ার থেকে দু হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ল। কোনও চিৎকার না, কোনও কান্না না, আবার সেই অগ্নিদৃষ্টি। মেজাজ ঠিক রাখতে পারলাম না। এবার একটা লাথি বসালাম। “শুয়োরের বাচ্চা! পাতে খেয়ে পাতে মুতিস! টাকা চুরি করছিস কেন বল!”

কাদের এখনো নিরুত্তর। মতলব মিয়াঁকে বললাম, “এইভাবে হবেনা, তোমার লাঠিটা দাও তো”।

মতলব মিয়াঁ যেন ঠিক এটাই চাচ্ছিল। লাঠি হাতে নিয়ে আমি বললাম, “এখনও সময় আছে! যা জিজ্ঞেস করি তার ঠিক ঠাক জবাব দে। একবার পিটানো শুরু করলে বাপ ডাকলেও আর থামাথামি নাই”।

কাদের একগাদা থুতু ছুড়ল মাটিতে। রাগে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। দমাদম পিটানো শুরু করলাম। আমি জানি কিভাবে এবং কোথায় কোথায় পেটাতে হয়। হাড় ভাঙবে না, রক্ত বেরোবে না, কিন্তু যতটা ব্যাথা দিতে চাই ঠিক ততটাই পাবে। অবশ্য মাঝেমধ্যে দু একটা বাড়ি খারাপভাবে লেগ যেতে পারে! জন্ম-পরিচয়হীন একটা জারজ ছেলেকে মায়া দেখানর কোনও মানে হয় না।

ঠিক কতক্ষন পিটিয়েছি বলতে পারব না। পেছন থেকে খালুজানের কণ্ঠ শুনে থামলাম। “কি করছ কায়সার? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”

খালুজান প্রায় দৌড়ে এসে কাদেরকে ধরল। ব্যাটা এখনও সেই দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে! আমি বললাম, “এইসব মারে ওদের কিছু হয়না খালু। ওকে আমার কাছে দেন। থানায় নিয়া কথা আদায় করতেছি”।

তোমাকে আর কিছু করতে হবেনা। যা করার আমিই করব। খালুজান কাদেরের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। “কিরে বোকা? চুরি করলি কেন? টাকা দিয়ে কি কিনেছিস? আমার কাছে চাইলি না কেন?”

আমার শত মারেও যা হয়নি, এইবার তা হল। হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল কাদের। আমি বললাম, “খালু এদের আদর দেবেন না। এরা আদর পাওয়ার যোগ্য না”।

“কে বলেছে এরা আদর পাওয়ার যোগ্য না?” খালুজান রাগত স্মরে বললেন।

“ঠিক আছে আপনি ওকে আদর করতে থাকেন। আমি গেলাম। কিন্তু বলে যাচ্ছি এই ব্যাটা আবার চুরি করে পালাবে। পালানোর সময় খুন খারাবিও করে যেতে পারে। যতই করেন না কেন, এরা চোর-ছ্যাঁচোর আর সন্ত্রাসী ছাড়া অন্য কিছু হবেনা”।

আমি চলে আসছি। পিছন থেকে খালুজান বলছেন, “ভুল বললে কায়সার। সঠিক দিক নির্দেশনা দিলে এরা হয়ত একদিন তোমার মত পুলিশ ইন্সপেকটারও হতে পারে”।

কথাটা শুনে আমার হাসি পেল। আমার বিশ্বাস আমি ভুল বলিনি।

***

সকাল বেলা ডিউটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। ইউনিফর্ম পরা শেষ, কোমরে বেল্ট লাগাচ্ছি। সুরভী প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে বেডরুমে ঢুকল। বলল, “এই তুমি নাকি গতকাল খালুজানের এতিমখানায় গিয়ে এক এতিম ছেলেকে অনেক মেরেছ?”

“হ্যাঁ মেরেছি। খালুজানইতো আমাকে ফোন করে বলেছিল ব্যাপারটা দেখতে! ব্যাটা ৫০০০ টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। আবার বাইরে গিয়ে চুরি করে ধরা পড়েছে”।

“খালুজান তোমাকে বলেছিল ছেলেটাকে একটু ভয় দেখাতে। নিষ্ঠুরের মত মারতে বলেনি নিশ্চয়ই?”

“এরা সহজে ভয় পাওয়ার না। মাইর হল এদের জন্য উত্তম ঔষধ”!

“তোমার মুণ্ডু! ছেলেটাকে এমন মার মেরেছ যে হাসপাতালে নিতে হয়েছে”।

“ওইসব খালুজানের বাড়াবাড়ি। আমি জানি কিভাবে মারতে হয়। হাসপাতালে নেয়ার মত কিছু হয়নি”।

“তুমি ছাই জান! এক্ষুনি ছেলেটাকে দেখতে যাও”

" কক্ষনো না"

"প্লিজ, একবার গিয়ে দেখে আসনা কেমন আছে......" বলে ফিচ ফিচ করে কাঁদতে শুরু করল সুরভী! এই ছিঁচকাঁদুনে মেয়েকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা! পুলিশের বৌ হয়েছে কিন্তু কোনও ভায়লেন্স সহ্য করতে পারেনা! সামান্য অ্যাকশন মুভির মারামারি দেখলেই ভড়কে যায়।

“কান্নাকাটি করে কোনও লাভ নেই। আমি যাচ্ছিনা...”

সুরভী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি জানি কোথায় যাবে। মায়ের কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে পুরো ঘটনা বলবে। তারপর মাকে দিয়ে আমাকে বলাবে কাদেরকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার জন্য। জানে মায়ের কথা আমি ফেলতে পারব না। আমার মায়ের স্বভাবও ঠিক সুরভীর মত। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমাকে নিয়ে তার যত ভয়! যেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম পুলিশের চাকরীতে জয়েন করব সেদিন মা সারাদিন খায়নি। তার একটাই চিন্তা। আমি তার একমাত্র সন্তান। যদি কোনোদিন সন্ত্রাসীদের সাথে লাগতে গিয়ে আমার কিছু হয়ে যায় তবে তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন..ইত্যাদি ইত্যাদি...।

শেষে বাবা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে মানাল। আমি একমাত্র সন্তান বলে এমনটি ভাবার দরকার নেই যে আমার বাবা মা “ছেলে হোক মেয়ে হোক, একটি সন্তানই যথেষ্ট” মতবাদে বিশ্বাসী! আমার জন্মের কয়েক বছর পর আম্মার একটা কার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তলপেটে আঘাত পেয়েছিলেন। অপারেশনে ভাল হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিলেন মা হবার ক্ষমতা। তাইত আমাকে নিয়ে মায়ের এত ভয়।

যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। পায়ে বুট লাগাচ্ছিলাম এমন সময় সুরভী আম্মাকে নিয়ে হাজির। আমি বললাম “আম্মা যতই বল, কোনও লাভ নেই। আমি হাসপাতালে যাচ্ছিনা”।

“যা না বাবা! ছেলেটার অবস্থা বেশি ভালনা। এতিমের অভিশাপ আল্লাহ শোনেন। তোর অমঙ্গল হবে”।

“এতিম যদি চোর-বাটপার হয় তারপরও আল্লাহ তার অভিশাপ শোনেন?”

“এভাবে বলিস না বাবা। অল্পবয়সী ছেলে, না বুঝে একটা কাজ করে ফেলেছে! ওকে শুধরানোর একটা সুযোগ তো দেয়া যায়”।
“কোন হাসপাতালে আছে?”

“তুই চিনিস তো! লামইয়া আদর্শ হাসপাতাল। তোর খালুজানের বড় ভাইয়ের হাসপাতাল”।

আমি হাসলাম। এনারা দুই ভাই “আদর্শ” শব্দটা খুব পছন্দ করেন। যাই বানান সেখানে “আদর্শ” শব্দটা জুড়ে দেন। সেটা আদর্শ হোক বা না হোক।

***

আমার বড়খালুর ছোট ভাই ডাক্তার ইউসুফ আহমেদ তৈরি করেছেন এই হাসপাতাল। তার বড়মেয়ে লামইয়ার নামে নামকরন করেছেন। অবশ্য খালুজানের এতিমখানার মত দৈন্যদশা নয়। বেশ সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন আধুনিক ব্যাবস্থা রয়েছে হাসপাতালে। আমি রিসেপশনে গিয়ে কাদের কই আছে সেই খোঁজ বের করলাম। কেবিন দেয়া হয়েছে! ছোটভাইয়ের হাসপাতাল বলে কথা!

কেবিনে ঢুকে যা দেখব ভেবেছিলাম তাই দেখলাম। কাদের একটা বালিশে ভর দিয়ে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। আজ অবশ্য চোখে সেই দৃষ্টি নেই। আমাকে দেখে একটু হাসল যেন! কেবিনে ঢুকে আর একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম। খালুজানের ছোটভাই ডাক্তার ইউসুফ আহমেদ বসে আছেন।

“আরে! আঙ্কেল আপনি এখানে কেন? এত ডাক্তার থাকতে আপনাকেই আসতে হল?”

ডাক্তার আঙ্কেল হাসলেন একটু। “কি করব বল? বড় ভাইজানের হুকুম! ওনার রোগীকে আমার নিজ দায়িত্বে দেখতে হবে”!

“কি অবস্থা ওর?”

“মারাত্মক কিছুনা। মাথার আঘাতটা একটু খারাপভাবে লেগেছে। মাথায় না মারলেও পারতে। ওষুধ দিয়েছি। আশা করি দুই একদিনের মধ্যেই সেরে উঠবে”।

আমি একটু হাসলাম। “মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আঙ্কেল.....”

“সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বস আমি একটু আসছি...” আঙ্কেল উঠে গেলেন।

আমি কাদেরের বেডের পাশে বসলাম। বললাম, “চুরি করেছিলি কেন?”

“মোবাইল কিনার জন্য”।

“মোবাইল?” আমি হাসলাম। “তোর আবার মোবাইলের শখও হয়?”

“কেন? শখ হওয়া কি নিষেধ নাকি? পৃথিবীর যত শখ সব কি আপনাদের জন্য? এতিমদের শখ হতে নেই?”

“না, আমি সেইটা মিন করি নাই”।

“আপনাদের মা- বাপ আছে, শখ হলে চাইলেই টাকা পাবেন শখ মেটানোর জন্য। কিন্তু আমার বাবা মা নেই। শখ হলে পুরন করব কেমন করে? তাই তো চুরি করতে হয়”।

“হুম বুঝলাম। তো..মোবাইল কিনেছিলি?”

“হ্যা”

“কোথায়?”

“ছিনতাই হয়েছে”।

আমি উচ্চশব্দে হেসে উঠলাম। হাসতে হাসতেই বললাম, “খুঁজে দেখ গিয়ে ওই ছিনতাইকারীও হয়ত এতিম। তোর শখ হয়েছে তুই চুরি করেছিস আর ওদের শখ হয়েছে ওরা ছিনতাই করছে”।

“এতিম বলে ঠাট্টা করছেন? আমি এতিম এটা কি আমার দোষ?”

আমি হাসি থামালাম। আমি জানি এটা ওদের দোষ নয়। এটা ওদের বাবা মায়ের দোষ। এইসব এতিম ছেলেদের বেশিরভাগই জন্ম পরিচয়হীন। প্রনয়ঘটিত অবৈধ সম্পর্কের ফল। নিজেদের কুকীর্তি আড়াল করতে এরা সন্তানকে এতিমখানায় দিয়ে দেয়। সেখানে অনাহারে অর্ধাহারে এরা বড় হয়। এক সময় এতিম খানা থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু সমাজ তাদের সহজভাবে গ্রহন করে না। তাদের গায়ে “জারজ সন্তান” এর তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়। বেশিরভাগই জীবিকা সংগ্রহের জন্য সন্ত্রাসকে বেছে নেয়। এদের একটা অংশ অবশ্য দেশের জঙ্গি সংগঠন আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের কাছে আশ্রয় পায়। এদেরকে দিয়ে বোমা তৈরি, বোমা হামলা, গাড়ি-ভাংচুর, অগ্নি-সংযোগসহ নানান কার্যকলাপ চালায়। আর একটু অল্প বয়সে ধরতে পারলে তাদের ব্রেন ওয়াশ করে আত্মঘাতী হামলা করায়। না, এটা ওদের দোষ নয়।

“আপনার বাড়িতে কেকে আছেন?”

কাদেরের প্রশ্নে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। “আমার? আছে সবাই। বাবা-মা, স্ত্রী আছে- নতুন বিয়ে করেছি”।

“ভাই-বোন?”

“নেই”।

“নেই নাকি মারা গেছে?”

“নেই। আমার জন্মের পর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল আমার মায়ের। অপারেশনের পর তার সন্তানধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়....”

“আর সেই অপারেশন হয়েছিল আমার এই হাসপাতালে....” কথাটা বললেন ডাক্তার আঙ্কেল। আবার কেবিনে ফিরে এসেছেন সেটা খেয়ালই করি নি। আমি তাকালাম ডাক্তার আঙ্কেলের দিকে। তিনি বলে চলেছেন, “সেদিনটি আমি কখনও ভুলতে পারব না। তোমার মা ছিলেন আমার হাসপাতালের প্রথম রোগী। উদ্বোধন সেরে আমি কেবল বাড়ি ফিরেছি, এমন সময় শুনলাম তোমার মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে আনা হয়েছে, অবস্থা খারাপ। নিজ হাতে অপারেশন করেছিলাম”।

“আমি জানতাম আম্মার অপারেশন এখানে হয়েছিল। কিন্তু আম্মা প্রথম প্রেসেন্ট ছিলেন তা জানতাম না”।

ডাক্তার আঙ্কেল হাসলেন। “তুমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে? আমাকে যেতে হবে অন্য রোগী দেখার জন্য”।

“না আমিও যাব”।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কাদেরের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোকে আমি একটা মোবাইল কিনে দেব। আর কক্ষনো চুরি করবি না!”

ডাক্তার আঙ্কেলের পিছু পিছু যেতে উদ্যত হয়েছি তখন পিছন থেকে কাদের ডাক দিল। “ইন্সপ্যাক্টর সাহেব, একটু শুনুন.....”

আমি দাঁড়ালাম, “আবার কি বলবি?”

“আপনার বয়স কত জানতে পারি?”

“কেন?”

কাদের একটু আমতা আমতা করে বলল, “না...আ...আমিও একদিন পুলিশ ইন্সপেক্টর হতে চাই। আর....আপনার মত বয়স হওয়ার আগেই হব”।

আমার ঠোঁটে হাসি ফুটল। “আমার আগে হওয়া কঠিন হবে! আমার বয়স আটাশ। ইন্সপেক্টর হয়েছি মাস ছয়েক হল”।

কাদেরের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা গেল! সে হাসিতে অপার্থিব কিছু ছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। “আর কিছু জানতে চাস?”

কাদের সেই হাসি ধরে রেখেই বলল, “নাহ! আমার আর কিছু জানার নেই”।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হাসপাতালের গেটের দিকে তাকালাম। খালুজানের এতিমখানার গেটের মত জরাজীর্ণ নয়। মনে হচ্ছে যেন গতকাল রং করা হয়েছে! সাইনবোর্ডের লেখাটাও সুন্দর করে বড় বড় করে লেখা। অনেকদুর থেকেও পড়া যাবে। “লামইয়া আদর্শ হাসপাতাল”।
নিচে একটু ছোট করে লেখা “স্থাপিতঃ ১৯৮০”।

মিনিট খানেক গাড়ি চালাতেই আমার মনে একটা খটকা লাগল! আবার ফিরে এলাম হাসপাতালের সামনে। গাড়ি থেকে নামলাম। সাইনবোর্ডের লেখাটা লক্ষ করলাম, হ্যা তাইত! “স্থাপিতঃ ১৯৮০” লেখা!

এটা কি দেখছি আমি? আমার জন্ম ১৯৮৫ সালে! এই হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে ১৯৮০ সালে! আমার মা ছিলেন এই হাসপাতালের প্রথম রোগী! তারমানে আমার জন্ম হয়েছে মায়ের অপারেশনের পর! তবে আমি কোথথেকে এলাম? আমি কে?

এখন বুঝতে পারছি কাদের কেন আমার বয়স জানতে চাইছিল! আমার চোখের সামনে কাদেরের সেই অপার্থিব হাসির দৃশ্য ভেসে উঠল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে.....
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৪৫
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×