somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা পেইন্টার (শেষ অংশ)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের লিংকঃ
দা পেইন্টার

ছয়

ইকবাল খান জানত না এই কেস কেবল শুরু হয়েছে। ক্লোজড হওয়ার পথ এখনও অনেক দূর। এটেম্পট টু মার্ডার কেসে মারুফ দোষী সাব্যস্ত হল কিন্তু পূর্বের ঘটনা যা যা ঘটেছে তার সাথে মারুফকে সম্পৃক্ত করার মত যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেলনা। শেফালীর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বলে মাত্র দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হল মারুফকে।

মারুফের কারাদণ্ড শুরু হওয়ার কয়েক দিন পরের কথা...

এক মাঝি সকাল বেলা নৌকা নিয়ে বের হয়েছে। সে নদীর জলে একটা মেয়ে ক্ষত বিক্ষত লাশ ভাসতে দেখল। ঠিক যেমনটি এঁকেছিল মারুফ তার ছবিতে। পুলিশ এসে লাশটা উদ্ধার করল। অটোপসি রিপোর্টে দেখা গেল প্রচণ্ড পাশবিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে শেফালীর। মৃত্যুর পর লাশটা ফেলে দেওয়া হয়েছে পানিতে।

পরবর্তী একমাস ঘুম ছুটে গেল ডিটেকটিভ ইকবাল খানের। কিছুতেই রহস্যের কূল কিনারা মিলছে না। আশরাফ রবিন ও ইকবাল খানের ধারনা ছিল কাজগুলো মারুফ নিজেই করে কিন্তু মারুফ জেলে থাকা অবস্থায় এই ঘটনা প্রমাণ করে দিল যে তাদের ধারনা অমূলক। তবে কি আসলেই মারফের কোন অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে?

যথারীতি দু মাস কাটতেই মারুফ ছাড়া পেয়ে গেল।

এদিকে আশরাফ রবিনের চোখেও ঘুম নেই। দিন রাত শুধু একটাই চিন্তা- কিছু একটা বোঝার ভুল হয়েছে তার! কিছু একটা চোখ এড়িয়ে গেছে! কিন্তু ভুলটা আসলে কোথায় হল? এসময় সে মারুফ ও হাসান দুজনের সাথেই কথা বলল। মারুফের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে অনেক স্টাডি করল, ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করল, একসময় সমাধানটা চোখে পড়ল।

পোষ্ট মর্টেমকারী একজন ডাক্তার শেফালীর ডান হাতের নখের নিচে অন্য কারো খানিকটা চামড়ার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন। সম্ভবত নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় টর্চারকারী ব্যক্তিকে সে খামচি দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আশরাফ রবিনের পরামর্শে তদন্তকারী গোয়েন্দারা নখের নিচের পাওয়া এই চামড়ার সাথে শেফালীর হবু বর হাসানের ডিএনএ মেলে কিনা সেটা টেস্ট করে দেখল। ফলাফলটা হল চমকে যাওয়ার মত! ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ! অর্থাৎ হবু বর হাসানের হাতেই শেফালীর নৃশংস মৃত্যু হয়েছে!


"সাত"

“তুই কি ডিএনএ ম্যাচ করার আগেই বুঝতে পেরেছিলি যে কাজটার পেছনে হাসানের হাত আছে?”

“নিশ্চিত ছিলাম না। একটা ঝাপসা মত ধারনা করতে পেরেছিলাম”। বলল রবিন। “কিন্তু এই ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার মত কোন প্রমান ছিলনা”।

“কীভাবে এটা সম্ভব হল বল তো?” এখনও ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট দেখার চমক কাটেনি ইকবাল খানের! “ হাসান নিজেই আমাদের কাছে শেফালীর নিরাপত্তার জন্য এসেছিল! তাছাড়া সে শেফালীকে ভালবাসত। কেন সে শেফালীকে মারতে চাইবে?”

“সে কথায় পরে আসছি। আগে ব্যাপারটা প্রথম থেকে খুলে বলি। যদিও এখনও অনেক প্রশ্নের জবাব আমি পাইনি, কিন্তু কিছু বিষয় চোখের সামনে পরিষ্কার...”

দুই বন্ধু বসে আছে বাংলাদেশ পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হেডকোয়ার্টারে। হাসানকে খুনের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার আগে একবার রবিনের সাথে পরামর্শ করে নিচ্ছে ইকবাল খান।

রবিন বলে চলেছে, “... মারুফ আর হাসান ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে, দুজনে খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু হাসান সবসময় মারুফকে অনুকরণ করার চেষ্টা করত। মারুফের ছবি আঁকার প্রতিভাকে সে হিংসা করত। তাই সে চাইত না মারুফ ছবি এঁকে মানুষের প্রশংসা কুড়াক।
...সম্ভবত প্রথম যে ঘটনাটি ঘটেছিল তাদের গ্রামে, জালাল নামের একটি ছেলেকে হাত পা ভাঙা অবস্থায় আম গাছের নিছে পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল একটা কাকতালীয় ঘটনা। জালালকে অন্য কেউ এসে মেরে রেখে গিয়েছিল যা মারুফের আঁকা ছবির সাথে মিলে যায়! কিন্তু ঘটনাটা হাসানের মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
... মারুফের মনে এক ধরনের ফ্যান্টাসি কাজ করত। সে কারো ওপর রেগে গেলে তার অনিষ্ট কামনা করে ছবি আঁকত। ব্যাপারটা হাসানের জানা ছিল। ছবিতে কখনও দেখা যেত কারো হাত পা ভেঙে গেছে, কেউ মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়েছে, এমনকি মৃতদেহের ছবিও সে আঁকত। মারুফ যদিও বলছে সে অবচেতন মনে ছবিগুলো আঁকে কিন্তু আমার মনে হয় কিছু কিছু ছবি সে ইচ্ছে করে এঁকেছে। কারণ তার নিজের ধারনা তার আঁকা ছবিগুলো ভবিষ্যতে বাস্তব হবেই। এখানেই সুযোগটা খুঁজে পেয়েছে হাসান।
... আগেই বলেছি হাসান চাইত না মারুফের ছবি আঁকার অসাধারণ প্রতিভার কথা মানুষ জানুক। তাই সে গোপনে গোপনে মারুফের আঁকা ছবিগুলো সত্যি প্রমাণিত করার চেষ্টা করত। এর ফলে মারুফের মনে ধারনা জন্মাল তার এই ছবি আঁকার ক্ষমতা এক ধরনের অভিশাপ। তাই মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। হাসানের কুটিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এদেশের এক অসাধারণ প্রতিভা সব সময় লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেল!
... আরও একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য জানাই তোকে, হাসান আমাদেরকে মারুফের ছবি আঁকার ক্ষমতার কথা বলেছে কিন্তু যে বিষয়টি গোপন করে গেছে তা হল সে নিজেও চমৎকার ছবি আঁকতে পারে। বললাম না সে সব কাজে মারুফকে অনুসরণ করত? তাই গোপনে গোপনে একজন বিখ্যাত চিত্র শিল্পীর কাছে সে ছবি আঁকা শিখেছে। হতে পারে মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ব্ল্যাক আউট হয়ে ছবি আঁকার ব্যাপারটা আসলে ভুয়া। হাসান তার অজান্তে ছবি এঁকে রাখত, আর মারুফ ভাবত সে নিজে ব্ল্যাক আউটের সময় ছবিটা এঁকেছে! এভাবে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মারুফ নিজের ছবি আঁকার ক্ষমতাকে দায় করেছে কিন্তু ফায়দা লুটেছে হাসান।
... আমি ধারনা করছি মারুফ আর শেফালীর মধ্যে এক সময় প্রেমের সম্পর্ক ছিল যা হাসান জানত না। কিন্তু শেফালীর বাড়ি থেকে হাসানের সাথে তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ব্যাপারটা হাসান জানতে পারে। যেহেতু সব কাজে মারুফকে সে হিংসা করত তাই মারুফের প্রতি শেফালীর টান হাসান মেনে নিতে পারেনি। একদিন মারুফের অজান্তে হাসান শেফালীর মৃতদেহের ছবি আঁকে। মারুফ ধারনা করে ছবিটা তার নিজের আঁকা। আরও একবার মারুফের ছবি আঁকার ক্ষমতাকে অভিশাপ হিসেবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে গেল হাসান।
... এসবই আসলে আমার ধারনা! জোর দিয়ে বলার মত নিরেট কোন প্রমাণ হাতে পাইনি”।

“কিন্তু একটা জিনিস এখনও পরিষ্কার হচ্ছেনা”। রবিন একটু থামতেই ইকবাল খান বলল। “হাসান কেন পুলিশের সাহায্য চাইল শেফালীকে বাঁচানোর জন্য?”

“এই প্রশ্নের সরাসরি কোন কোন উত্তর দেয়া সম্ভব নয়”। মাথা নাড়ল রবিন। “সম্ভবত হাসানের মনের একটা অংশ চাইছিল শেফালীকে বাঁচাতে। হতে পারে তার মধ্যে একটা দ্বৈত স্বত্বার বাস! তাই পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিল”।

“তাহলে বল হাসান কেন এমন একটা সময় শেফালীকে খুন করল যখন মারুফ জেলখানায় বন্দী?” আবার রবিন কে লক্ষ করে প্রশ্ন ছুঁড়ল ইকবাল খান। “সে যদি মারুফের জেলমুক্তির পর শেফালীকে খুন করত তাহলে আমাদের সব সন্দেহ মারুফের ওপর গিয়ে পড়ত। মারুফকে ফাঁসিয়ে দেয়ার এমন চমৎকার সুযোগ হাসান কেন হাতছাড়া করল?”

“বললাম তো অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি আমি”। বলল রবিন। “তবে ধারনা করতে পারি যে এখানেই মানসিক অসুস্থতার প্রসঙ্গটি চলে আসছে! হাসান মারুফকে যতই হিংসা করুক। তারা আসলে খুব কাছের বন্ধু! তারা দুজনে ছিল দুই দেহে এক আত্মার মত। আমাদের সন্দেহের হাত থেকে মারুফকে বাঁচানোর জন্য সে খুনটা ঐ সময় করেছে। যেন আমরাও ধারনা করে বসি মারুফের অলৌকিক কোন ক্ষমতা রয়েছে! মারুফ ও হাসান এঁকে অপরের প্রতি অবসেসড। তাদের বন্ধুত্ব বন্ধুতা ছাড়িয়ে মানসিক অসুস্থতার পর্যায়ে চলে গেছে। তারা দুজন এক সাথে থাকে, এক সাথে চলে, একসাথে খায়, এক ভাবে চিন্তা করে, একে অপরকে ছাড়া চলতে পারেনা”।

“কিন্তু তুই যা যা বলছিস এগুলো সবই নিছক ধারনা! কোন নিরেট প্রমাণ ছাড়া পুলিশ এক পাও এগোতে পারবে না। আমরা হাসানকে শুধু শেফালীর খুন ছাড়া আর কোন অপরাধের সাথে জড়াতে পারছি না। অবশ্য তার ফাঁসি হয়ে যাওয়ার জন্য ঐ একটা অপরাধই যথেষ্ট”! এক মুহূর্ত থেমে থেকে আবার ইকবাল প্রশ্ন করল রবিনকে। “আমার রিপোর্টের ব্যাপারে তোর কি কোন সাজেশন আছে?”

“আমার মনে হয় রিপোর্টে তোর উচিৎ হাসানকে মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো”! বলল রবিন। “কেন যেন মনে হচ্ছে এর ভেতরে আরও কিছু ব্যাপার রয়ে গেছে যা আমাদের নজরে পড়ছে না। সে যে কাজ গুলো করেছে তা কোন স্বাভাবিক চিন্তা-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকের পক্ষে করা সম্ভব নয়! তার মত একজন সাইকোলজিকাল ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষের চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন”!

"আট"

বাগান বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে একে বেঁকে এগিয়ে চলা যে পথের দেখা পাওয়া যায় মারুফ তার নাম দিয়েছে আপনহারা পথ। তার ধারনা এ পথে হাঁটলে আপন মানুষেরা হারিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের বুক চিড়ে এগিয়ে চলা এক মেঠো-পথ এগিয়ে গেছে বহুদূর!

শহরের বাইরে এই বিশাল রাজ প্রাসাদের মত দেখতে বাগানবাড়িতে মারুফ সম্পূর্ণ একা। মারুফের এক চাচা এই বাড়ির মালিক। ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকেন বলে বাড়িটা প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থাতে পড়ে আছে। মারুফ আর হাসান প্রায়ই এসে কিছুদিন থেকে যায় এখানে। কিন্তু আজ মারুফের পাশে হাসান নেই, সে পুলিশের হাতে বন্দী।

প্রিয় বন্ধুকে ছাড়া খুব একা লাগছে মারুফের। এতটা নিঃসঙ্গতা তাকে আগে কখনও গ্রাস করতে পারেনি। ছোট বেলা থেকে এক সাথে বেড়ে উঠেছে দুজন! কত অসংখ্য ঘটনা জমে আছে স্মৃতির পাতায়!
২০ বছর আগে...

স্কুল ছুটির পর হাসানকে ডেকে একপাশে নিয়ে গেল মারুফ। “হাসান, আমাকে বাঁচা। একটা সমস্যা হয়ে গেছে”!

“কি সমস্যা?”

“সেদিন জালালের হাত পা ভাঙা অবস্থার যে ছবি এঁকেছিলাম, সেই খবর জালাল জেনে গেছে”।

“কি বলিস?” হাসানের চোখে ভয় ফুটে উঠল।

“জালাল আমাকে বলেছে আজ বিকেলে ঐ বড় আমগাছের নিচে দেখা করতে। একটা জরুরী বিষয়ে নাকি কথা বলবে”!

“কথা বলবে না মারুফ! ও তোকে পিটাবে। তুই ছবিতে জালালকে যেভাবে পড়ে থাকা দেখিয়েছিস। জালাল তোকে পিটিয়ে ঠিক সেভাবেই ফেলে রাখবে”।

“আমি জানি। এজন্যই তো সে আমাকে আমগাছের নিচে ডেকেছে! কিন্তু এখন উপায় কি?”

“দরজা আঁটকে বাসায় বসে থাকবি। ভুলেও ওদিকে যাবিনা”!

“কিন্তু তুই তো জালালকে চিনিস! আজ যদি আমি না যাই তাহলে পরে আমাকে একলা পেলে আরও বেশি মারবে”।

“পরেরটা পরে দেখিস। এখন থেকে একলা বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দে। সব সময় বড়দের সাথে চলা ফেরা করবি। কদিন বাদেই দেখবি ঘটনাটা জালাল ভুলে গেছে”!

হাসানের পরামর্শটা মারুফের পছন্দ হলনা। জালাল সহজে বিষয়টা ভুলবে না, আজ না হোক কাল, এক সময় শোধ তুলবেই। কতদিন সাবধানে বড়দের সাথে চলাফেরা করবে সে? মারুফ সিদ্ধান্ত নিলো জালালের সাথে দেখা করবে। জালাল কিছু বলার আগেই তার পা চেপে ধরে মাফ চাইবে। এছাড়া বাঁচার আর কোন উপায় নেই।

বিকেল বেলা মারুফ সাহস করে বাসা থেকে বের হল। গাঁয়ের মসজিদের সামনের রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলে শেষ মাথায় বড় আমগাছটা পড়ে। মসজিদ পার হয়ে এসে বড় রাস্তায় উঠতেই সামনে হাসানকে দেখতে পেল মারুফ। হাসানের হাতে একটা মোটা লাঠি! ঘটনা কি?

আমগাছের কাছ পর্যন্ত গিয়ে রাস্তা ছেড়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল হাসান। মারুফও তার দেখাদেখি লুকিয়ে পড়ল। বিষয়টা তার বোধগম্য হচ্ছেনা। হাসান ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। জালাল এদিকে পেছন ফিরে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মারুফ দেখল হাসান নিঃশব্দে একেবারে পেছনে গিয়ে হাতের লাঠিটা জালালের মাথায় সজোরে নামিয়ে আনল! প্রায় সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেল জালাল। আর নড়া চড়া করছে না সে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে! নাকি মরেই গেল। জালালের নিস্তেজ দেহটাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল হাসান। মারুফ দৌড়ে এসে থামাল হাসানকে। হাসানের চোখে মুখে এখন অন্যরকম এক অভিব্যক্তি। এই দৃষ্টির অর্থ মারুফের জানা নেই। সে ধাক্কা দিয়ে মারুফকে সরিয়ে দিল। তারপর লাঠিটা মাটিতে ফেলে বড় রাস্তা ধরে দৌড় লাগাল। পালাচ্ছে সে। মারুফ বুঝল তারও পালান দরকার। কিন্তু বন্ধুর ওপর সে খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছে। মারুফের বিপদ দেখে হাসান কত্ত বড় ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছে!

পরদিন হাসান স্কুলে যেতেই দেখল সব বাচ্চারা তাকে ভয় পাচ্ছে! কেউ সাহস করে কাছে আসছে না! তার আঁকা ছবি সত্য হয়েছে, এই ঘটনার কথা সবার কানে পৌঁছে গেছে! হাসান হঠাৎ প্রায় দৌড়ে এসে বলল, “মারুফ তুই আর ছবি আঁকবি না! তোর ছবি আঁকার হাত অভিশপ্ত!”
“কি বলছিস?”

“হ্যা, তুই ছবি এঁকেছিস বলেই তো জালালের এই অবস্থা হয়েছে”!
“আমার জন্য এই অবস্থা হয়েছে? গতকাল বিকেলের কথা কি ভুলে গেছিস? কোথায় ছিলি তুই?”

“কেন ভুলব? বাসাতেই ছিলাম”!

মারুফ ভাবল হাসান হয়ত দায় এড়ানোর জন্যই মিথ্যা বলছে। তবুও বন্ধুর প্রতি সে কৃতজ্ঞ বোধ করছে! বড় একটা বিপদ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে হাসান।

কয়েকদিন পার হয়ে গেল। গ্রামের ছেলে মেয়েরা এখন আর মারুফের সাথে মেশেনা। সবাই তাকে ভয় পায়। এমনকি জালালও তাকে ভয় পেয়ে এড়িয়ে চলে। এখন তার একমাত্র বন্ধু হাসান! অবশ্য সেদিন বিকেলের কাণ্ড নিয়ে হাসান আর মারুফের মাঝে আর কোন কথা হয়নি।

একদিন চুরি করে নরহরি কাকার দোকান থেকে মিষ্টি খেতে গিয়ে ঘটল আরেক বিপত্তি। সারা গ্রামে দুজনে চোর অপবাদ পেয়ে গেল। এবার নরহরি কাকার একটা ছবি আকল মারুফ। এক চোখে গেঁথে আছে একটা কাটা চামচ। ছবিটা শুধু হাসানকে দেখাল মারুফ। আর কাউকে না।

পরদিন দুপুরে হাসানের সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে গিয়েছিল মারুফ। বাড়ির গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতেই সে দেখল হাসান বাসা থেকে বেরিয়ে দ্রুত গতিতে কোথাও যাচ্ছে। নীরবে তার পিছু নিলো মারুফ। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাজারে চলে এলো। নরহরি কাকা তখন অন্যান্য দিনের মত মিষ্টির দোকানে বসে ঝিমোচ্ছে। দুপুরবেলা আশে পাশে মানুষজন কম। দোকানে কাস্টমারও নেই।

হাসান নিঃশব্দে দোকানে ঢুকে পড়ে একটা কাটা চামচ হাতে তুলে নিলো। নরহরি কিচ্ছু টের পেলনা। মারুফ আড়ালে লুকিয়ে সবকিছু দেখছিল। আচমকা ক্ষিপ্র গতিতে কাঁটা চামচটা নরহরির এক চোখে বসিয়ে দিল হাসান। চোখের মধ্যে চামচের কাঁটা গুলো ঢুকে যাওয়ার এক বিচ্ছিরি শব্দ হল। নরহরি কাকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে হাসান। কোনদিকে না দেখে সোজা দৌড় লাগালো পালিয়ে যাওয়ার জন্য।

পরদিন হাসানের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল মারুফ। কিন্তু হাসান ভান করল যেন কিছুই জানেনা। এর পর এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটার পর একটা সময় মারুফ বুঝতে পারল হাসান আসলে কাজগুলো করার পর ভুলে যায়! হাসান মনে প্রাণে বিশ্বাস করে মারুফের কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু অবচেতন মন সে ধারনা সত্য প্রমাণের জন্য কাজ করে চলেছে।

আর একটু বড় হওয়ার পর হাসানের এই সমস্যার একটা নাম খুঁজে পেল মারুফ। ডুয়েল পারসোনালিটি! হাসানের মধ্যে দ্বৈত স্বত্বার বাস! ব্যাপারটা ধরতে পেরে ঘাবড়ে গিয়েছিল মারুফ। ছবি আঁকা ছেড়ে দিল। কিন্তু হাসানের এই মানসিক অসুস্থতার সুযোগ নিতে সে কখনও ছারেনি। হাসানের এই দ্বিতীয় সত্ত্বাটি প্রচণ্ড পরিমাণে বুদ্ধিমান ও অত্যন্ত কৌশলী। মারুফ যে ছবি আঁকে তা বাস্তব করা অসম্ভব হলেও সে ঠিকই একটা পথ খুঁজে নেয়! ফলে মারুফের জীবনে যারাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, ছবি এঁকে তাদেরকে সরিয়ে দেয়ার কাজটা সে খুব সচেতন ভাবেই করে চলেছে। ওদিকে হাসান জানেনা তার ভেতরের দ্বিতীয় সত্ত্বাটির রূপ যে কতটা ভয়ংকর!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মারুফের ঠোঁটের কোনে একটু হাসি খেলে গেল! আরও একজন বুদ্ধিমানের দেখা পেয়েছে সে। লোকটা হচ্ছে ড. আশরাফ রবিন! ঘটনার প্যাঁচে ফেলে লোকটাকে ঘোল খাওয়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে মারুফ। কিন্তু লোকটা সাইকোলজির শিক্ষক, ঠিকই গন্ধ শুকে শুকে সমাধানের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে! এবার চূড়ান্ত একটা ব্যবস্থা না নিলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে!

"নয়"

মারুফের বিরুদ্ধে এটেম্ট টু মার্ডারের কেস করার পর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব পুলিশ কাস্টডিতে আনা হয়েছিল প্রমাণ সংগ্রহের জন্য। তার মধ্যে একটা পুরনো ডায়েরী ছিল। ডায়েরীটা রবিন নিয়ে এসেছে পড়বে বলে। তারপর মনের ভুলে ফেলে রেখেছিল ডেক্সের ওপর। মাঝখানে ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন অবসর হতে ডায়েরীটা চোখে পড়েছে।

হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখল রবিন। ডায়েরীর বেশির ভাগ পৃষ্ঠাই খালি। কয়েক যায়গায় কলম দিয়ে স্কেচ এঁকে ফুটিয়ে তুলেছে দুর্দান্ত কিছু ছবি। তবে মাঝে মধ্যে মুক্তগদ্যের মত কিছু লেখা চোখে পড়ছে। ছেলেটার মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল! মুক্তগদ্য বিষয়টাকে কেমন যেন হেঁয়ালি মনে হয় রবিনের কাছে, খুব একটা বুঝতে পারেনা সে।

পুরো ডায়েরী উল্টে পালটে দরকারি কিছু না পেয়ে ফেরত দিবে বলে ভাবছিল রবিন, ঠিক তখনই একটা মুক্তগদ্যে চোখ পড়ল। গদ্যের ভেতর একটা যায়গায় “শেফালী” নামটা নজরে এসেছে তার। পুরোটা পড়তে শুরু করল সে...

আমার চোখের সামনে প্রায়ই ভেসে ওঠে এক চিরচেনা পথের ছবি। ভোরের প্রথম প্রহরে এই পথকে মনে হবে স্বর্গের সোপান! পথের শুরুতেই একপাশে চোখে পড়ে যুগল তালগাছ। সগর্বে ডানা মেলে তারা আকাশের বুকে মেঘেদের সঙ্গী হতে চায়। কিন্তু মাটি তো তাদের কিছুতেই ছাড়বে না, ভালোবাসার টানে বুকে বিঁধিয়ে রাখে তালগাছের সমস্ত শেকড়বাকড়। সবুজ মাঠের বুক চিরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলা এই পথের একটা নাম দিয়েছি আমি- আপনহারা পথ। যে পথে আপন মানুষ হারিয়ে যায়! এই পথে এসে কতো প্রেমিক, কবি আর চিত্রকর যে শূন্য হয়ে গেলো তার খবর কেউ রাখেনি।

এই পথ আমাকে চিনিয়েছিলো এক গ্রাম্য কিশোরী, তার নাম শেফালী। শেফালী ছিল আমার মনের ক্যানভাসে আঁকা ছবির তুলি। এই তুলিতে এঁকেছিলাম জীবনের প্রথম শ্রাবণ। শেফালী তার সন্ধেবেলার পড়া ফেলে দুটি নগ্ন পায়ে কাদার আলতা মেখে এগিয়ে আসত এই পথ ধরে। আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে তার গায়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তাম। দুজনে আলতো পায়ে হেঁটে জীবনের গল্পগুলো মাখিয়ে দিতাম সবুজ ঘাসের বুকে।

তবে একদিন শেফালী তার রূপ বদলে নিলো। আপনহারা ঐ পথ ধরে হেঁটে আসার সময় মেলে ধরল ছাতা, আমি সেদিন আর বৃষ্টি হয়ে তার গায়ে ঝরে পড়তে পারিনি। ছাতার গায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম পথের মাঝে। শেষ হয়ে গেল শ্রাবণ মেঘের সন্ধ্যা। এলো ঘরভাঙা রোদের দুপুর।

তবে শেফালী যে রোদের হাত ধরে বর্ষার দিনে কথা ভুলে গেল, সে জানেনা ঐ রোদ আসলে আমার আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিন। আমি হুকুম করতেই সে জ্বিন সমস্ত পৃথিবীকে ওলট পালট করে দেয়! শেফালীকে রোদের সাথে মিলে এক হতে দেবনা আমি। একদিন তুলির আঁচরে লিখে দেব তার নৃশংস মৃত্যু! আমার জ্বিন তার মুণ্ডুটা টেনে ছিঁড়ে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে!

তারপর আমি কোনো এক নিঃসঙ্গ দুপুরবেলা একাই চলে যাব এ পথের শেষ মাথায়, যেখানে আমার এক রাজ প্রাসাদ আছে! যাওয়ার সময় বুক পকেট খালি রাখতে হবে, নইলে আপনহারা পথে মিশে থাকা শেফালীর শোকের ছায়া আমি কোথায় রাখব? আমাকে কেউ দেখতে পাবেনা। আমি আর আমার জ্বিন মিলে নতুন করে লিখব ঐ আপনহারা পথের ইতিহাস।

এর পর দ্রুত পাতা উল্টে অন্যান্য মুক্ত গদ্য গুলো পড়া শুরু করল রবিন। সবগুলো গদ্যতে আলাদীনের এক আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিনের কথা বলেছে মারুফ। যে তার হয়ে সব ধরনের কাজ করে দেয়! রবিনের আর বুঝতে বাকি নেই যে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জ্বিন বলতে সে আসলে হাসানের কথাই বুঝিয়েছে। এই মুক্তগদ্যগুলো আসলে এক একটা ছবি আঁকার আগের প্ল্যান! খুব চমৎকার ভাবে প্ল্যান করে নিজের জীবনের যত অপছন্দের মানুষ আছে তাদের অনিষ্ট করে বেড়াচ্ছে মারুফ।

ডায়েরী ফেলে ঝট করে উঠে দাঁড়াল রবিন! তার ধারনাই ঠিক! হাসানের মাঝে আসলেই দ্বৈত-সত্ত্বার বসবাস। অবচেতন মনে সে মারুফের আঁকা ছবি গুলো সত্য প্রমাণিত করছে ঠিকই কিন্তু সচেতন মন সে খবর পাচ্ছেনা। কিন্তু রবিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে সব কিছুর আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছে মারুফ। হাসানের এই অসুস্থতার কথা জানে সে। এটাকে ব্যবহার করছে নিজের সুবিধার জন্য। সর্বশেষ শেফালীকেও সরিয়ে দিয়েছে তার ভালবাসা ফিরিয়ে দেয়ার অপরাধে!

এখন সব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই মিলে যাচ্ছে! প্রথম থেকেই রবিনকে প্যাঁচে ফেলার জন্য অদ্ভুত সব চাল চেলেছে মারুফ! কিন্তু এইবার ধরা পড়ে গেছে!

দ্রুত মোবাইল বের করে ইকবাল খানের নম্বরে ডায়াল করল রবিন। কিন্তু কি বলবে সে? এই মুক্তগদ্য গুলো তো তার কথার প্রমাণ হিসেবে টিকবে না! নিরেট প্রমাণ সে দেবে কি করে?

"দশ"

জেলখানায় হাসানকে একা একটা সেলে রাখা হয়েছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে বিলাসিতাও বটে! সেলের ভেতরকার অবস্থাও খুব একটা খারাপ না। একটা লোহার খাটিয়া, শক্ত তোষক সাদা চাদর, বালিশ শাহী আয়োজন। সেলের সাথেই একটা টয়লেট আছে ফলে যখন তখন প্রকৃতি ডাকলেও সাড়া দিতে সমস্যা হবে না। ঠিক ভিআইপি না হলেও সেমি ভিআইপি কারাগার বলা চলে।

হাসান ভেবে পায়না তাকে এমন একটা সেলে রাখা হয়েছে কেন? খুব ভায়োলেন্ট টাইপের কয়েদীদের সাধারণত এভাবে অন্যান্য কয়েদীদের থেকে একটু আলাদা রাখা হয়। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় যেন উলটা পালটা কিছু করার চিন্তা মাথায় আসার অবকাশ না পায়। তবে কি তাকে ভয়ংকর ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে?

আপন মনে একটু হাসল হাসান। শুনেছে খুব দ্রুত তাকে একটা আধা সরকারি মানসিক ইন্সটিটিউশনে ট্রান্সফার করা হবে। সে নাকি কঠিন একটা সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে! মানুষের খোলসের আড়ালে মাঝে লুকিয়ে আছে এক অমানুষ! যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে এসে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। পাগলে বিশ্বাস কি?

“মাহমুদুল হাসান”!

নাম ধরে ডাক শুনে চমকে উঠল হাসান। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকায় কারো হেঁটে আসার শব্দ শুনতে পায়নি সে। উত্তর দিল। “জী?”

“তোমার জন্য একটা চিঠি এসেছে”! বলল সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ডিউটি অফিসার।

“ধন্যবাদ স্যার”। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা ধরল হাসান। খামের ওপর প্রেরকের নামটা পড়ল- মারুফ মুক্তাদির। খামটা খোলাই আছে। তার কাছে দেওয়ার আগে চিঠিটা খুলে পড়ে দেখেছে জেল কর্তৃপক্ষ। চিঠিটা বের করল হাসান। খুব সংক্ষিপ্ত চিঠি...

হাসান,

আমি জেলখানায় তোর সাথে একবারও দেখা করতে আসিনি দেখে তুই হয়ত খুব অবাক হচ্ছিস। কেন আসিনি সেই কারনটা শোন- আমি তোকে ঘৃণা করি মারুফ। কেমন করে পারলি শেফালীর মত নিষ্পাপ একটা মেয়েকে এভাবে খুন করতে? সারাটা জীবন তুই আমাকে ধোঁকা দিয়ে এসেছিস! আমার ছবি আঁকার প্রতিভা সবার কাছ লুকিয়ে রেখে তোর কি লাভ হল?

তোর মানসিক অসুস্থতা আমি মানিনা। আমি প্রার্থনা করি যেন তোর খুব কঠিন শাস্তি হয়।

ইতি
মারুফ মুক্তাদির


কাগজের খালি যায়গাতে হাত বুলাতেই চিকন করে কাঁটা মোম ঘষে ঘষে কিছু একটা লেখার অস্তিত্ব টের পেল হাসান। ছোট বেলা থেকে গোপন মেসেজ আদান প্রদানের এই খেলাটা খেলে আসছে তারা দুজন! বোকা জেলার সেটা ধরতেই পারেনি। হো হো করে হেসে উঠল হাসান। চিঠিটা সেলের ভিতরে জ্বলতে থাকা বাল্বের দিকে উঁচু করে ধরল। আলোর বিপরীতে ধরতেই এবার চিঠির ভেতরে আরেক চিঠির সন্ধান পাওয়া গেল...

প্রিয় হাসান,

জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে তুই আমার পাশে দাঁড়িয়েছিস। আজ আমারও উচিত তোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু আমি মনোবল হারিয়ে ফেলেছি। তার মানে কখনও ভেবে নিস না যে তুই আর আমি আলাদা কিছু।

আর কেউ না জানুক, আমি জানি তুই একজন জিনিয়াস। তোর পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। জেলখানার চার দেয়াল তোকে আঁটকে রেখেছে- এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস? আমি জানি তুই ঠিকই নিজেকে মুক্ত করে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে নিতে পারবি।
আমি এখন কোথায় আছি জানিস? আমাদের সেই বাগানবাড়িতে! খুব একা লাগছে রে! তাড়াতাড়ি চলে আয় না! তোকে ছাড়া এভাবে একা কখনও থেকেছি বল? আর ভাল লাগছে না। জলদি চলে আয় বন্ধু! আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি!

আর একটা কথা! গতকাল রাতে একবার ব্ল্যাক আউট হয়েছিল আমার। তখন নতুন একটা ছবি এঁকেছি। দেখিস!

ইতি
তোর প্রাণের বন্ধু
মারুফ মুক্তাদির

চিঠি ফেলে খামটা হাতে নিলো হাসান। কোথায় ছবি? ভেতরে তো আর কোন কাগজ নেই! কিছুক্ষণ খামটা উল্টে পালটে দেখেই ব্যাপারটা ধরতে পারল সে। আসলে চিঠির খামটাই বানানো হয়েছে ছবি দিয়ে। আস্তে আস্তে আঠা ছাড়িয়ে খামটা পুরোপুরি মেলে ধরল হাসান। খামের ভেতর দিকে ছবিটা আঁকা ছিল বলে জেলারের চোখে পড়েনি! একজন মানুষ গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় সিলিং থেকে ঝুলছে। আধ হাত জিভ বেরিয়ে এসেছে! চেহারারা চেনা চেনা লাগছে হাসানের। আরও ভাল করে লক্ষ করতে বুঝল মৃত লোকটা আসলে আশরাফ রবিন!

চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল হাসানের। সেলের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল করিডোরের শেষ মাথায় দুই জন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে! রাতের বেলা জেলে খুব একটা কড়া পাহারা থাকেনা। এই দুজনকে কাবু করতে পারলে জেল থেকে বেড়িয়ে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হবেনা!

হঠাৎ পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়ল হাসান। “আহ... উহ... মাগো... মরে গেলাম গো... পেটে কি ব্যথা...”

গার্ড দুজন হাসানের সেলের দিকে দৌড়ে আসার দুপ দাপ শব্দ শোনা যাচ্ছে!

(সমাপ্ত)

উৎসর্গঃ
আমার খুব কাছের দুজন মানুষ,
যারা এই গল্পের মতই বাস্তবেও খুব ভাল বন্ধু-
ইরেজার হাসান ও মারুফ মুক্তাদির খান
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×