শৈশবের কমন গল্প
আমার সময়ের সবার ছোটবেলার একটা কমন গল্প আছে। সেটা হলো আমি আসলে আমার মা-বাবার বাচ্চা না, আমাকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে। আমাদের শৈশবটাও ছিল কেমন বোকা বোকা। এক গাদা ভাইবোনের মধ্যে বাবা-মা আরেকটা বাচ্চা কেন কুড়িয়ে আনতে যাবেন এই সহজ জিনিসটা মাথায়ই আসতো না। আমার গল্পটা খুব সুন্দর করে বলতেন পাশের বাসার রুনির মা খালাম্মা। খালার বড়মেয়ের নাম রুনি। পাড়ার মুরুব্বিরা ডাকেন, রুনির মা। আমরা বাচ্চাকাচ্চারা বলি রুনির মা খালাম্মা। কী অদ্ভুত সম্বোধন! অথচ রুনি আপা ছিলেন বয়সে আমাদের সবার চে' অনেক বড়। তো রুনির মা খালাম্মা আমাকে খুব আদর করতেন। উনি আমাকে বলতেন, পাগলামিয়ার মাজারে সেদিন ওরস আছিলো। ম্যালা লোকের ভিড়ে তোর আসল বাপ-মা গেল হারায়ে। ভাইসাবের দিল তো জানস বিরাট বড়, তোরে কানতে দেখে বাসায় নিয়া আসলেন। তখন থেকে তুই তারেই আব্বা ডাকস। পাগলামিয়ার মাজারে ওরস হয় ফাল্গুন মাসের প্রথম শুক্রবার। আমার জন্ম ৬ ফাল্গুন। গল্পের শক্ত গিট্টু এখানেই। সিক্স-সেভেন পর্যন্ত এই গল্প আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে। কিন্তু কথা হলো আমার আব্বা মাজার তো দূরের কথা, ওরসের বিরিয়ানিও বাসায় ঢুকতে দিতেন না। তিনি মাজারে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অথচ কখনো মনেই হয়নি এই গল্প আসলে একটা গল্প।
আব্বার আনারস বাগান
আব্বা চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর কাজ কাজ করে অস্থির হয়ে যেতেন। আমরা খুবই বিরক্ত হতাম। এখন মনে পড়লে অবশ্য কষ্ট লাগে। কিন্তু ওই বয়সে মা-বাবার উপর বিরক্ত হওয়াটাই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। যিনি কোনোদিন সংসারের তেমন কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি চাকরির কারণে, তিনি সারাদিন বাসায় এটা-ওটা করতে চাইতেন। বাতি-পাখা নেভানো ছিল তারমধ্যে অন্যতম (এই কাজটা এখন অামি নিজেই করি)। আমার বড় ভাইয়ের ছোট মেয়েটা ওই বছরই পৃথিবীতে এসেছে। আব্বাও ব্যস্ত থাকার একটা উপায় পেয়ে গেলেন। নাতনি হাঁটতে শিখেছে দাদার আঙ্গুল ধরে। স্কুলে গেছে দাদার হাত ধরে। এরমধ্যে আব্বা বাড়ির সামনের খোলা জায়গার একাংশে একটা আনারস বাগান করে ফেললেন। কিছুদিন পর আনারসের ঘ্রাণে চারদিক ভরে যেতে লাগলো। সেই প্রথম আমি দেখেছি একটা ঘাসে ঢেকে থাকা জায়গা পরিষ্কার করে কী সুন্দর একটা প্রাণময় বাগান হয়ে যায়।
শাবানা-আলমগীরের সিনেমার গল্প বলতো ইলোরা আপু
প্রতিবেশি চাচার তিন মেয়ে। মেজ মেয়ে ইলোরা আপু ভীষণ ঢংগি ছিলেন। ৮৮/৮৯ সালে মফস্বলের মধ্যবিত্ত রক্ষণশীলতার মধ্যে হাঁটুর উপর ফ্রক পরতেন। চুল ছেড়ে সেজেগুজে যখন কোথাও যেতেন সবাই বাঁকা চোখে তাকাতো। আমার অবশ্য ইলোরা আপুর ডেয়ারিং ভাব বেশ লাগতো। ওই বয়স থেকেই আমি মেয়েদের সাহসের ভক্ত। স্বৈরাচারী সরকারের দলের ছেলেদের দাপট তখন শহরজুড়ে। পাড়ার দেওয়ালে দেওয়ালে উঠতি নেতার নামের পাশে যোগ চিহ্ণ দিয়ে ইলোরা আপুর নাম লেখা হচ্ছিল। সবাই তাজ্জব হয়ে গেল যখন শোনা গেল ঢংগি আপুর সাথে সত্যি সত্যি ঠ্যাঙ্গা টাইপ আনস্মার্ট নেতাটির ভাব আছে। বড় হওয়ার পরও দেখেছি সমালোচিত বখাটের সাথে প্রেম করে আলোচিত সুন্দরী মেয়েটি। কেন কে জানে! যাই হোক, ইলোরা আপু ছিলেন বড়দের দলে। শাবানার কোনো সিনেমা (মুভি) এলেই বড়দের সাথে দেখতে যেতো। আমি আর দিলারা (চাচার ছোটমেয়ে, আমার বাল্যসখী) আপুর পিছে পিছে ঘুরতাম সিনেমার গল্প শোনার জন্য। একসময় গল্পটা শুরু হতো। হাত নেড়েনেড়ে চোখ নাচিয়ে ইলোরা আপু বলতেন, তারপর বুঝলি আলমগীর একটা গান গায়। শাবানা তখন নাচে। বলতে বলতে হঠাৎ চুপ। বলেন বলেন ও আপু বলেন। কোনো কথা নাই। আমরা তার গা ধরে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করলে ইশারায় বুঝিয়ে দিতো আসরের আজান হচ্ছে, তাই এখন কথা বলা যাবে না। ভাগ্যিস এখনকার মতো চারদিকে এতো মসজিদ ছিল না...আজান শেষ হতেই আবার গল্প শুরু...।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



