“আপনার বয়স কতো?” মাঝি জানালেন চল্লিশ। বয়স বের করার সহজ অংকে যাই। “মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা মনে আছে?” দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে বিহারীদের নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করে বললেন যে এটা তার স্পষ্ট মনে আছে। আচমকা আমি এক উপলব্ধির সামনে দাড়ালাম। স্কুলের রচনা বইতে নিরক্ষতার অভিশাপের কথা পড়েছিলাম। সেটা যে আসলেই কতোটা ভয়াবহ ব্যাপার তা অনুভব করলাম। সেদিন বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় ঘুরেছিলাম। মাঝির সাথে গল্প করতে গিয়ে দেখলাম এক বালকের স্মৃতিতে ৭১ সালের কিছু ঘটনায় একেবারেই ধূলা পড়েনি। মনে পড়ছিল আমার মাকে। যুদ্ধের ৯ মাস আমার আম্মার দিনগুলো কী তীব্র এক মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই না কেটেছিল।
আব্বার পোস্টিং তখন সিলেটের গোলাপগঞ্জে। আম্মা তার দুই তরুণ ছেলে আর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে নানার বাড়িতে আছেন। শোনা যাচ্ছিল সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনা আর রাজাকারদের তাণ্ডবের কথা। আব্বার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। নানাবাড়িতে পুরুষ নেই, মামারা রাজাকারের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকেন। ছোট মামা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন বলে রাজাকাররা ঘন ঘন আসঅতে থাকে আর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। একদিন আমার ১৭ বছর মেজ ভাইকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়। আম্মা দিশেহারা হয়ে রাজাকারের সামনে কাকুতি মিনতি করেছেন কিন্তু তারা উল্টা দুর্ব্যবহার করে। পরে অবশ্য ভাইকে পাক সেনা ছেড়ে দেয়। আমার নানা মারা যান যে বিকালে সেদিন সকালে খবর এলো রাজাকারের সহায়তায় গ্রামের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মিলিটারি ক্যাম্পে। আম্মারা তিন বোন, আমার চার মামী তখন নানাবাড়িতেই আছেন। সেদিনই বিকেলে নানা মারা যান। যুদ্ধে আমার নানী চোখের দৃষ্টি হারান। যুদ্ধের কারণে যথাসময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে না পারায় ধীরে ধীরে তিনি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আম্মার স্মৃতিতে সেইদিনগুলি দুঃস্বপ্ন হয়েই আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



