somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাওলানা মওদুদীকে একটি প্রশ্ন ও তার অসাধারণ জবাব।

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাওলানা মওদুদীর কাছে প্রশ্ন
আপনি তাফহীমুল কুরআনে “আল্লাহু আকবার’ বলে গুলি করার মাধ্যমে শিকারকৃত মৃত প্রাণীকে হালাল আখ্যা দিয়ে এক অভিনব কথা আবিষ্কার করলেন। আপনার এ বক্তব্যের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উদয় হয়, মেহেরবানী করে এগুলোর জবাব দিয়ে সন্তুষ্ট করবেনঃ

১. চারজন ইমামই এ ব্যাপারে একমত যে, গুলির দ্বারা মৃত শিকার ‘চোট’ লেগে মারা গেলে না জায়েজ ও হারাম। কাজেই কোন দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে আপনি এটাকে জায়েজ লিখেছেন।

২. বন্দুকের গুলিতে ধারল কিছুই থাকে না, বরঞ্চ কেবল একটা তীব্র আঘাতের দ্বারাই প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। সাধারণত কার্টিজের উপর লেখা থাকে, এটার শক্তি এতো পাউন্ড। কিন্তু এটাতো লেখা থাকে না যে, এটার ধার এতোটা তীক্ষ্ম! আঘাত দ্বারা মৃত শিকার অবৈধ এবং এটা সর্বস্মত।

৩. তাফসীরে হক্কানীতে লেখা হয়েছে, কাজী শওকানী বন্দুকের গুলিতে মৃত শিকার হারাম হবার ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন। কিন্তু কাজী সাহেবের মতবিরোধ মানদন্ড হতে পারেনা। কারণ তিনি মাজরূহ (ত্রুটিপূর্ণ) হাদীস বর্ণনাকারী হওয়া ছাড়াও শিয়া মতবাদের প্রতি আসক্ত।

৪. এ বিষয়টাকে ক্ষুদ্র বা খুঁটিনাটি বিষয় আখ্যায়িত করা জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া কিছু নয়। হারামকে হালাল করাটাও কি প্রাসাংগিক ব্যাপার?

এ প্রসঙ্গে মাওলানার জবাবঃ
সর্ব প্রথম আমি আপনার চতুর্থ প্রশ্নে উল্লেখিত ভুল ধারণার আপনোদন করতে চাই। আপনি প্রশ্ন করেছেনঃ হারামকে হালাল করাটাও কি প্রাসাংগিক ব্যাপার?

এ ব্যাপারে আপনার জানা থাকা দরকার যে, এক প্রকার হালাল হারাম হলো তা, যা সরাসরি (কুরআন ও হাদীসের) অকাট্য দলীল প্রমাণের মাধ্যমে হালাল বা হারাম বলে নিরুপিত হয়েছে। আর সেগুলো হলো মৌলিক ও মূলনীতিগত বিষয়। এগুলোতে কোন প্রকার রদবদল করা কুফরী। দ্বিতীয় প্রকার হালাল হারাম হলো তা, যা সরাসরি কুরআন হাদীসের অকাট্য দলীল প্রমাণ দ্বারা নয়, বরঞ্চ তার ইশারা ইঙ্গিতের আলোকে চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে গবেষণা ও ইজতিহাদ করে বের করা হয়। আর এগুলোই হলো প্রাসংগিক বিষয়। এসব বিষয়ে সব সময়ই মুসলিম উম্মাহর আলিম ও ফকীহগণের মধ্যে এমনকি সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম এবং তাবেয়ীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মধ্যেও মতভেদ চলে আসছে। একই জিনিসকে কেউ হালাল বলেছেন, আবার কেউ হারাম বলেছেন। কিন্তু এমন কখনো হয়নি যে, ইজতিহাদী হালাল ও হারামের বিষয়ে তাঁরা তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়ে একে উপরের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেছেন যে, তোমার দ্বীন পরিবর্তন হয়ে গেছে, কিংবা তুমি আল্লাহর হারাম করা জিনিসকে হালাল করে ফেলেছো। বড়ই পরিতাপের বিষয়, এটা কেবল আমাদেরই দেশে নয় বরঞ্চ গোটা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ শরয়ী মাসায়েলের ক্ষেত্রে স্বাধীন গবেষণা ইজতিহাদ বন্ধ হয়ে আছে এবং সব লোকেরাই কোন না কোন ফিকহী মাযাহাবের অনুকরণ ও অনুবর্তনে এতোটা অটল হয়ে আছে যে, প্রত্যেকেই নিজের অনুসৃত সেই বিশেষ মযহাবকেই মূল শরীয়ত মনে করতে শুরু করেছে। এ কারণেই লোকদের সামনে তাদের অনুসৃত সেই বিশেষ মযহাবের বিপরীত কোন গবেষণা ইজতিহাদ পেশ করা হলে তারা তাতে এমন নাট সিটকাতে আরম্ভ করেন যেনো মূল দ্বীনের মধ্যেই কোন রদবদল করে ফেলা হয়েছে। অথচ অতীত বুযুর্গদের মধ্যে যখন স্বাধীন গবেষণা ইজতিহাদের দরজা খোলা ছিলো, তখন উলামায়ে কিরামের মধ্যে হালাল হারাম এবং ফরজ ও গায়েরে ফরজের মধ্যে পর্যন্ত মত পার্থক্য হয়ে যেতো এবং এগুলো তারা কেবল বরদাশতই করতেন না, বরঞ্চ তারা প্রত্যেকেই নিজেরা যেটাকে শরয়ী বিধান বলে মনে করতেন সেটার উপর আমল করতেন এবং অন্যেরা যেটাকে শরয়ী বিধান বলে মনে করতো তাদেরকে সেটার উপর আমল করার অধিকার দিতেন।

এই পানাহারের বিষয়ে অতীতের উলামায়ে কিরামের মধ্যে যেসব মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল তার কয়েকটি উদাহরণ আমি এখানে উদ্ধৃত করছি এবং এইসব মতভেদের ব্যাপারে আপনার নিকট আমার জিজ্ঞাসা এই যে, আপনি এই বুযুর্গদের কার প্রতি হারাম হালাল করার এবং হালালকে হারাম করার অভিযোগ আরোপ করতে পারবেন ?

হযরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিতঃ তিনি হিংস্র জন্তুর গোশত এবং তাদের শিরার উপরে যে রক্ত থেকে যায় তার ব্যবহারকে দোষণীয় মনে করতেন না। তাঁর এ মতের দলিল ছিল নিম্নোক্ত আয়াতঃ

হে নবী বলে দাওঃ আমার নিকট প্রেরিত ওহীর মধ্যে কোনো আহার গ্রহণকারীর আহারে হারাম কিছু পাই না ----- আর এই আয়াতেরই ভিত্তিতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসও কুরআনে ঘোষিত চারটি জিনিস (শূকর, মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত এবং যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে বধ করা হয়েছে তা ব্যতীত আর কোন জিনিসকেই হারাম মনে করতেন না। দ্রষ্টব্যঃ আহকামুল কুরআনঃ জাসসাসঃ তয় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২০

গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়ার ব্যাপারে একদলের মত হলঃ নবী করিম সাঃ খায়বার যুদ্ধের সময় বিশেষ কারণে তা খেতে নিষেধ করেছিলেন। তাঁর এ সাময়িক নিষেধাজ্ঞা একথা প্রমাণ করেনা যে গাধার গোশত মুলতই হারাম। (দেখুন ঐ বই এর পৃষ্ঠা ২১ )

ইমাম আবু হানীফা ও তার সাথীদের মতে হিংস্র পশু এবং শিকারী পাখি পুরোপুরি হারাম। ইমাম মালিক হিংস্র পশুকে হারাম মনে করেন বটে কিন্তু শকুন ঈগল প্রভৃতি শিকারি পাখীকে হালাল বলে মত প্রকাশ করেছেন, এগুলো মৃত জীব ভক্ষক হোক কিংবা নাহোক। ইমাম আওযায়ী কেবলমাত্র শকুনকে মাকরূহ মনে করতেন । তাঁর মতে অন্য সকল প্রকার পাখি হালাল। ইমাম লাইস বিড়ালকে হালাল মনে করতেন, তবে শবখোর বনবিড়ালকে মাকরূহ মনে করতেন। ইমাম শাফেয়ীর নিকট কেবলমাত্র মানুষের উপর হামলাকারী বন্যপশু এবং মানুষের পালিত জন্তুর উপর হামলাকারী শিকারী পাখি হারাম। বন বিড়াল ও খেকশিয়াল এ সংজ্ঞার আওতামুক্ত থাকে।ইকরামার নিকট কাক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এটাতো মাংসল মোরগ আর বনবিড়াল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেনঃ এটা মোটা দুম্বা । (দেখুন ঐ বই এর পৃষ্ঠা ২১ )

এভাবে ভূ গর্ভে বসবাসকারী প্রাণীর গোশত খাওয়া সম্পর্কেও মতভেদ আছে। হানাফীগণ ভূ-গর্ভে বসবাসকারী সকল প্রাণী মকরূহ মনে করেন। ইবনে আবী লাইলারমতে সাপ খাওয়াতে তেমন কোন দোষ নেই। তবে তিনি যবেহ করে খাবার শর্ত আরোপ করেছেন। ইমাম মালেকের মতেও সাপ খাওয়া জায়েজ। কিন্তু ইমাম আওযায়ী যবেহ করার শর্তকেও উড়িয়ে দিয়েছেন। ইমাম লাইসের মতে জংলী ইদুর (সজারু) খাওয়া যায়েজ। ইমাম মালেকের মতের ব্যাঙ খাওয়া জায়েজ। ইমাম শাফেয়ী বলেন, আরববাসী যেসব জিনিস খেতে ঘৃনা করতো সেগুলোই নোংরা নাপাক। আর তারা যেহেতু বন বিড়াল এবং খেকশিয়ালের গোশত খেতো সুতরাং এ উভয় প্রাণীই হালাল। (দেখুন ঐ বই এর পৃষ্ঠা ২১ )

এ উদাহরণ ক’টি থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যেসব ক্ষেত্রে সরাসরি কুরআন হাদীসের বিধান মওজুদ নেই সেসব ক্ষেত্রে গবেষণা ইজতিহাদের ভিত্তিতে হালাল হারামের যে পার্থক্য দেখা দেয়, তা শরীয়তের কোন মৌলিক বিষয় নয়, বরং তুচ্ছ ও খুটি নাটি ব্যাপার। কোনো ফিকহী মযহাবে ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোন জিনিস হারাম হবার অর্থ কখনো এ নয় যে, মূল খোদায়ী শরয়ীতেই তা হারাম। কেউ যদি এ ধরণের কোন জিনিসকে তার গবেষণা ইজতিহাদের ভিত্তিতে হালাল বলে মত প্রকাশ করে, তবে এ ব্যাপারে বিতর্ক অবশ্যই চলতে পারে। কিন্তু এটা এমন কোনো ব্যাপারই নয় যে, এজন্য ক্ষিপ্ত হতে হবে এবং এটাকে দ্বীনের মধ্যে রদবদল ও আল্লাহর হারামকৃত জিনিসকে হালাল করার অভিযোগ করা যেতে পারে।

এবার আমি মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি, যার প্রেক্ষিতে আপনি এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
আমার কাছে অবাক লাগছে, একথা আপনি কোথা থেকে জানতে পারলেন যে, বন্দুকের গুলিতে মৃত জন্তু হারাম হবার ব্যাপারে চারজন ইমামই এক মত ! চারজন ইমামের কোনো একজনের যুগেও কি বন্দুক আবিষ্কার হয়েছিল? চারজন ইমামের অনুবর্তনকারী আলিমগণের কয়েকজন কিংবা তাদের সকলের ইমাম চতুষ্টয়ের গবেষনালদ্ধ কোনো মাসয়ালা আলোকে কোনো হুকুম বা ফায়সালা বের করা একটা ভিন্ন জিনিস আর স্বয়ং ইমামগণের কোনো হুকুম ফায়সালা বিবৃত করা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বন্দুক তো পরবর্তী ফকীহদের যুগে আবিষ্কার হয় এবং তার গঠন প্রণালীতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ফকীহগণ এ সম্পর্কে কোনো বিধান যদি বর্ণনা করেও থাকেন, তবে তা করেছেন অতীত ইমামগণের ইজতিহাদী বিধানের ভিত্তিতে গবেষণার উপর গবেষণা চালিয়ে। এ ভিত্তিতে কি করে এ দাবী করা যেতে পারে যে ইমাম চতুষ্টয় এ জিনিস হারাম হবার ব্যাপারে একমত ছিলেন?

বন্দুক দ্বারা শিকার করা প্রাণী হালাল হবার ব্যাপারে আমি যে মাসআলা বর্ণনা করেছি, তা কাযী শওকানী থেকে গ্রহণ করিনি। বরঞ্চ আমি সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ থেক বিষয়টি চয়ন করেছি। ইসলামী শরীয়তে প্রাণীকে শরীয়ত সম্মত পন্থায় যবেহ করার যেসব বিধান রয়েছে, মৌলিকভাবে সেগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়ঃ

১. এক প্রকার প্রাণী আছে আমাদের আয়ত্বাধীন। এগুলোকে আমরা সুনির্দিষ্ট পন্থায় যবেহ করতে পারি। এগুলোর যবেহ শুদ্ধ হবার শর্ত সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ যবেহকে প্রচলিত অর্থে আমরা ইচ্ছে মাফিক যবেহ বলতে পারি।

২. দ্বিতীয় প্রকার প্রাণী হলো সেগুলো, যেগুলো আমাদের আয়ত্বের বাইরে। যেমন বন্য পশু, কিংবা এমন গৃহপালিত পশু যা বন্ধন ছুটে বেরিয়ে গেছে এবং বন্য পশু সম্পর্কিত বিধানের আওতাভুক্ত হয়ে গেছে। অথবা এমন পশু যা কোন গর্তে নিপতিত হবার কারণে শরয়ী বিধিসম্মত ভাবে যবেহ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিংবা এমন পশু যা কোনো কারণে মুমূর্ষ অবস্থায় পৌছে গেছে এবং তাকে যবেহ করার ছুরি খুজতে খুজতে তার মৃত্যু হবার আশংকা রয়েছে। এরূপ সকল পশুর জবেহ করার শর্ত ভিন্ন রকম, এ রকম যবেহকে প্রচলিত অর্থে আমরা অনিবার্য যবেহ বলতে পারি।

প্রথম প্রকার পশুর যবেহর স্থান হলো কন্ঠনালী। এরূপ পশু যবেহ করার জন্যে তাদের গলা এমনভাবে কেটে ফেলা জরুরী শর্ত, যাতে করে তাদের খাদ্যনালী ও শিরাসমূহ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বাকী থাকলো দ্বিতীয় প্রকার পশুর কথা। এ ধরণের পশুর যবেহর স্থান সেগুলোর গোটা দেহ। যে কোন জিনিস দিয়ে, তা যাই হোক না কেন, শরীরের যে কোন স্থানে এমন পরিমাণ ছিদ্র করে দেয়াই যথেষ্ট, যাতে রক্ত প্রবাহিত হয়। এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যেসব প্রমাণ পাওয়া যায়, তা ধারাবাকহিকভাবে নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

يَسۡـَٔلُوۡنَكَ مَاذَاۤ اُحِلَّ لَهُمۡ‌ؕ قُلۡ اُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبٰتُ‌ۙ وَمَا عَلَّمۡتُمۡ مِّنَ الۡجَوَارِحِ مُكَلِّبِيۡنَ تُعَلِّمُوۡنَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ اللّٰهُ‌ فَكُلُوۡا مِمَّاۤ اَمۡسَكۡنَ عَلَيۡكُمۡ وَاذۡكُرُوۡا اسۡمَ اللّٰهِ عَلَيۡهِ‌ وَاتَّقُوۡا اللّٰهَ‌ؕ اِنَّ اللّٰهَ سَرِيۡعُ الۡحِسَابِ

সূরা আল মায়েদা – ৪ নং আয়াত
১. তোমাদের জন্য সমস্ত পবিত্র জিনিস হালাল করে দেয়া হয়েছে। এবং যেসব শিকারী জন্তুকে তোমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়েছো যাদেরকে আল্লাহর দেওয়া ইলমের ভিত্তিতে তোমরা শিকার করার নিয়ম শিক্ষা দিয়ে থাকো সেগুলো তোমাদের জন্য যেসব জন্তু ধরে রাখবে তাও তোমরা খেতে পার। অবশ্য তার উপর আল্লাহর নাম নেবে।

এ থেকে জানা গেল যে, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিকারী পশুকে আল্লাহর নামে ছাড়া হলে নখ ও দাঁত দ্বারা বন্য পশুর শরীরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে যে রক্ত প্রবাহিত হয়ে পড়ে তাতেই অনিবার্য যবেহর শর্ত পূর্ণ হয়ে যায়। এরূপ শিকারকৃত জন্তু যদি জীবিত পাওয়া না যায় এবং তা যদি নিয়মমাফিক যবেহ করার সুযোগও না থেকে তবু তা হালাল।

২. হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী করীম সাঃ নিকট আরয করলেনঃ আমরা কি মে’রাদ নিক্ষেপ করে শিকার করতে পারি? তিনি তাকে জবাব দেনঃ
তা যদি জন্তুর দেহ ছিদ্র করে দেয় তবে খাও। কিন্তু তা যদি চওড়া দিক দিয়ে লেগে জন্তু মারা যায়, তবে তা চোট লেগে মরা জন্তু। তা খেয়োনা।
মে’রাদ হচ্ছে এক প্রকার ভারী কাষ্ঠ বা লাঠি যার অগ্রভাগে হয়তো লোহার শলাকা লাগানো হয়েছে নয়তো ঐ কাঠকেই শুঁচালো করে নেওয়া হয়েছে। এটার আঘাত লেগে যদি জন্তুর শরীরে কোনো অংশ এতটা পরিমাণ কেটে যায় বা ছিদ্র হয়ে যায়, যার ফলে রক্ত প্রবাহিত হয় তবে যবেহর শর্ত পূর্ণ করার জন্য এটাই যথেষ্ট।

৩. রাফে’ ইবনে খাদীজ বলেন, আমি আরয করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল! কাল শত্রুদের সাথে আমাদের মোকাবেলা হবে কিন্তু পশু যবেহ করার মত ছুরি আমাদের সংগে নেই। এমতাবস্থায় কি আমরা ফাটা বাঁশের চটি দিয়ে যবেহ করতে পারবো? জবাবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
“আল্লাহর নাম নিয়ে যে জিনিস দিয়েই রক্ত প্রবাহিত করা হোকনা কেন তা খেয়ে নাও। অবশ্য দাঁত এবং নখ দিয়ে একাজ করবেনা”।
এ থেকে জানা গেলো যে, আসল জিনিস সেই অস্ত্র নয় যা দিয়ে যবেহর কাজ সম্পন্ন করা হয়। বরঞ্চ যবেহর শর্ত পূর্ণ করার জন্য রক্ত প্রবাহিত করাটাই মুখ্য কথা। নিম্নোক্ত হাদীসটি এ কথাই সমর্থন করেঃ
হযরত আদী ইবেন হাতেম জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আমাদের কেউ যদি কোনো শিকার পেয়ে যায় আর তার কাছে কোনো ছুরি না থাকে, তবে সে পাথরের ধার কিংবা চেরা কাঠ দ্বারা যবেহ করতে পারবে কি? তিনি বললেনঃ

“ যে জিনিস দিয়ে ইচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করে দাও এবং আল্লাহর নাম নাও”।

৪. আবুল উশরা তার পিতা থেকে শুনে বর্ণনা করেন। তিনি রাসূল সাঃ এর নিকট আরয করেনঃ হে আল্লাহর রাসূল সাঃ যবেহর স্থান শুধু হলক এবং শিরাসমূহের সমন্বয় স্থল নয় কি? তিনি বলেনঃ তুমি যদি তার উরুতেও ছিদ্র করে দাও, তাই যথেষ্ট ।

এতে প্রমাণ হলো, আমাদের আওতা বহির্ভূত যে কোন জন্তুর যবেহর স্থান তার দেহের প্রতিটি অংশ। এর দ্বারা এটাও প্রমাণ হলো যে, কোন অস্ত্র দিয়ে যবেহ করা হলো তা আসল বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রকৃত বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, প্রাণীর দেহে এমন পরিমাণ ছিদ্র করে দেয়া যাতে রক্ত প্রবাহিত হয়।

৫. কাআব ইবনে মালিক বলেনঃ সিলা নামক স্থানে আমাদের বকরীগুলো চরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ আমাদের দাসী দেখতে পেলো একটা বকরীর মৃতপ্রায় অবস্থা। সংগে সংগে সে একটা পাথর ভেঙ্গে তা দ্বারা বকরীটা যবেহ করে দিলো। নবী করীম সাঃ সে বকরি খাবার অনুমতি দান করেন। (বুখারী)
আতা ইবনে ইয়াসার বলেনঃ বনি হারেসার জনৈক ব্যক্তি অহুদের নিকটবর্তী ঘাটিতে একটি উট চরাচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেলো উটটি মরে যাচ্ছে। কিন্তু যবেহ করার মত কোনো অস্ত্র তার কাছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে তাবু পোতার একটি খুটি নিয়ে উটের গলায় ছিদ্র করে দিলো এবং এতে রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেলো। অতঃপর বিষয়টা নবী করীম সাঃকে জানানো হলে তিনি তা খাওয়ার অনুমতি দান করেন।

ভাংগা পাথেরর ধার তো মুটামুটি ধারের সংজ্ঞায় পড়ে কিন্তু কাঠের সূচালো খুঁটিকে ধারালো অস্ত্রের সংজ্ঞায় কতটা আনা যায় তাতো পরিষ্কার ।

উপরোক্ত অকাট্য দলীল সমূহ সম্মুখে রেখে বন্দুকের মাসআলাটি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। বন্দুকের গুলিকে গুলতির ঠান্ডা গোল্লার মত মনে করা ঠিক নয় এবং এর ভিত্তিতে বন্দুক দ্বারা শিকারকৃত মৃত জন্তুকে পাথর বা কাষ্ঠ খন্ডের পার্শ্বদেশের আঘাতে মৃত জন্তুর মতো মনে করাও ঠিক হবে না। বন্দুক থেকে গুলি যে শক্তিতে বের হয় এবং যতটা তীব্র গতিতে লক্ষ্যস্থলের দিকে ধাবিত হয়, তাতে করে সেটা আর ঠান্ডা পাথুরে হয়ে থাকে না, বরঞ্চ অনেকটা নরম ও প্রায় শাণিত হয়ে দেহ ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করে আর এতে করে রক্ত প্রবাহিত হয়ে জন্তুর মৃত্যু ঘটে। এটা শিকারী জন্তুর নখ, দাঁত কিংবা মে’রাদ ও কাঠের খুঁঠি অগ্রভাগের ধার থেকে বেশী কিছু ভিন্নতর নয়। বরঞ্চ রক্ত প্রবাহিত করার ব্যাপারে সেগুলো থেকেও অধিকতর কার্যকর হওয়া মোটেই অস্বাভিক নয়।

এসব কারনে আমার মতে, আল্লাহর নাম নিয়ে বন্দুক চালানোর পর তার গুলি বা ছররা দ্বারা কোনো প্রাণীর মৃত্যু ঘটলে তা হালাল না হওয়ার কোনো কারন নেই। কিন্তু এ মতের উপর যদি কেউ নিশ্চিন্ত হতে না পারেন এবং এরূপ জন্তুকে হারামই মনে করেন, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নাই। এমনটি আমি কখনো বলবনা যে, অবশ্যি তাকে হালাল বলে স্বীকার করতে হবে এবং অবশ্যি খেতে হবে। আমার ইজতিহাদ অনুযায়ী আমি আমল করবো। অন্যদের ইজতিহাদ অনুযায়ী তা আমল করবেন, কিংবা যে কেউ যে কোন মুজতাহিদের অনুবর্তন করতে চাইলে তা করতে পারেন। এ ইজতিহাদী মত পার্থক্য দ্বারা যদিও আমার এবং তাদের মধ্যে হালাল হারামের পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তা সত্বেও উভয় পক্ষই একই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে কেউ পৃথক পৃথক দ্বীনের অনুসারী হয়ে যায় না।

(প্রথম প্রকাশঃ তরজমানুল কুরআনঃ রবীউল আউয়াল ১৩৬৫, ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬। রাসায়েলও মাসায়েল প্রথম খন্ড-৭৯ )

মতভেদযুক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত কিভাবে নেবেন তা মাওলানা মওদুদী সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। ছোটখাটো মতভেদের মাধ্যমে কেউ দ্বীন হতে খারিজ হয়ে যায়না। মতভেদ সহই আমরা এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ইসলামী আন্দোলনের জন্য কাজ করতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×