মানবজাতি সৃষ্টিজগতে পর্দাপনের পর প্রথম যখন এই মহাবিষ্ময়কর এজগতের পানে দুচোখ তুলে তাকিয়েছিল সেদিন থেকে এবিশ্বের যর্থাথ পরপচিতি লাভের জন্য সে অধীর আগ্রহে প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে এবং এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে। মানুষ তার এজগতের যত রসহ্য আবিস্কার করেছে ততই যেন বিশ্ব মহারহস্য হয়ে উঠেছে। এই প্রচেষ্টায় পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বশেষ ফল হল big bang theory । উক্ত তত্ত্বের ভিত্তিতে ধারণা হরা হয়ে থাকে যে বিশ্ব এক সময় কোন কিছুই ছিল না, শুধুমাত্র গ্যাসের কুন্ডলী এবং হঠাত এক মহাবিস্ফোড়নের ফলে কোটি কোটি বছর ধরে অগ্নেয়লাভা শীতল হয়ে পৃথিবীতে আজ জীব বসবাসের উপযোগী হয়েছে।
আসলে মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য বা আত্মপরিচিতি মুলক জ্ঞান প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্তজরুরী বিষয়। কেননা প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের অবস্থান, ক্ষমতা, সূচনা এবং শেষ পরিণতি বা গন্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান না রাখলে সে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারবেন না। তাই আমাদের নিজ সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হল নিজ সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা।
একইভাবে আমরা এই বিশাল সৃষ্টিজগতের একটি সৃষ্টজীব যে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করিনি বরং তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি যদি নিজেকে সৃষ্টি করতাম তাহলে অবশ্যই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি রূপে তৈরী হতাম। অথচ আমি তেমনটি নই। শুধু তাই-ই নয় বরং আমার বর্তমান অস্তিত্বকে যদি আমিই সৃষ্টি করে থাকবো তাহলে আমার এই সৃষ্টির পূর্বে আমার অস্তিত্ব অনিবার্যবশত থাকতে হবে; যা সম্পূর্ণ রূপে একটি অসম্ভব কল্পনা।
এমনকি আমরা যদি মনে করি আমাদের মত কোন সৃষ্টি আমাকে অস্তিত্ব দান করেছে সেক্ষেত্রেও ঐ একই প্রশ্নের সম্মুখীন হব। যে সত্তা আপন অস্তিত্ব লাভে অন্যের মুখাপেক্ষী সে কিভাবে তার মত অন্য একটি অস্তিত্বকে সৃষ্টি করবে ? আর যদি এমনটি ধারণাও করি যে অন্য একটি সৃষ্টি তাকে অস্তিত্ব দান করেছে; এভাবে সৃষ্টি পরম্পরায় অপর সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করে আসছে। তাহলে প্রথম সৃষ্টিকে কে অস্তিত্ব দান করলো ; এপ্রশ্ন থেকেই যাবে। এভাবে এই সৃষ্টিচক্র এক পর্যায়ে যেয়ে অবশ্যই পরিসমাপ্ত হতে হবে নতুবা এটা হবে একটি দুষ্ট চক্র যা দর্শনে বাতিল যুক্তি বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর এছাড়া সৃষ্টি অর্থই হচ্ছে যা এক সময় ছিল না এবং এক সময় আবার থাকবে না। তাই এই অস্তিত্ব প্রদানে এমন এক মহাশক্তির প্রয়োজন যে এই সৃষ্টি সমূহের পূর্বে থাকবে এবং সৃষ্টি সমুহের স্থায়ীত্ব কালব্যাপীও তাকে থাকতে হবে।
এমন কি যদি বস্তুবাদী বা পর্দাথবিজ্ঞানের চুড়ান্ত সুত্র 'বিগ ব্যাং থিউরীর' মত ধারণাও করি যে মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি। তাহলে আমরা যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হব তাহল প্রকৃতিকে কে অস্তিত্ব দান করলো? এ ক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন হচ্ছে সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যগুলো স্রষ্টার মধ্যে অবশ্যই পূর্ণরূপে অবস্থান করতে হবে। অথচ মানুষের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে তার অধিকাংশই প্রকৃতির মধ্যে নেই। প্রকৃতি হল সম্পূর্ণরূপে বস্তুসত্তা আর মানব প্রকৃতিতে বস্তুসত্তা বর্হিভূত অনেক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি বা বস্তু অর্থ আধাঁর/ আড়াল তাই বস্তুর বৈশিষ্ট্য হল সে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। আর এক্ষেত্রে মানুষকে বলা হয় স্বজ্ঞেয় সত্তা যে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত আছে বা জ্ঞান রাখে।
'big bang theory' বিরাট বিস্ফোড়নের সূত্রও আরেকটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কল্পনা বৈ ভিন্ন কিছু নয়। এটা বস্তুবাদী জ্ঞানের চুড়ান্ত ফল হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। এবিষয়টি এমন একটি তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষদের ধরণা যারা নিজেদেরকে বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক বলে মনে করেন। তাদের সূত্রের সংক্ষিপ্ত রূপ হল বিশ্বে কোন কিছুই ছিল না হঠাৎ মহা বিস্ফোড়ন ঘটে এই মহা জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এধরণের যুক্তিশুন্য কথা রাজার নতুন পোষাকের মত জ্ঞানীদেরও বোকা বানিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হল, মহাশুন্য কথার কোন বাস্তব রূপ আছে কি ? বা মহাশুন্যের কোন অস্তিত্ব আছে কি ? বস্তুজগতে [বস্তুবাদী চিন্তায়] কোন মহাশুন্য কল্পনা করা সম্ভব কি ? আদৌ সম্ভব নয়। কেননা তাদের ধারণা অনুযায়ী বস্তুর বাইরের কোন অস্তিত্ব সমান অনাস্তিত্ব । তাই এধারণা অনুযায়ী 'কিছুই ছিল না' থেকে 'সব কিছু হয়েছে' এটা ঘোড়ার ডিমের মত বিষয় যে, ঘোড়া কখনো ডিম পাড়ে না; কিন্তু একবারই একটা ডিম পেড়েছে।
আরো মজার ব্যাপার হলো তাদের কথা অনুযায়ী কোন কারণ ছাড়া কার্য সংঘটিত হয় না। অথচ এক্ষেত্রে তারা বোকার মত গ্রহণ করে নিয়েছেন যে এই একটি ঘটনায় কোন কারণের প্রয়োজন পড়েনি।
অতএব বস্তুবাদীদের বস্তুর সীমানায় সৃষ্টিজগতের সূত্র নিয়ে এর বেশী ব্যাখ্যা প্রদান আদৌ সম্ভব নয়। এমনকি যদি ধরেও নেয়া হয় যে বর্তমান বিশ্ব একটি বিরাট বিস্ফোড়নের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইসলামী ধারণার কোন অসুবিধা নেই। কেননা ইসলামী চিন্তায় যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে তা'হল বিষ্ফোড়ন হোক আর যাই হোক না কেন এর পিছনে স্রষ্টার পরিকল্পিত শক্তি কাজ করেছে।
তাই একটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট যে এই বিস্ফোড়ন সংঘটিত হওয়ার পূর্বে এমন কোন অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে যে অস্তিত্ব তার বিজ্ঞবান পরিকল্পনার ভিত্তিতে এ বিস্ফোড়ন ঘটিয়েছেন।
শেষের এই ধারণাটুকু উপরের ধারণার সাথে সংযুক্ত করলে বিষয়টি সম্পূর্ণ যুক্তির ছকে দাড় করানো সম্ভব। নতুনা বিষ্ফোড়নের সূত্র রাজার নতুন পোষাক গল্পে ছোট শিশুর মতো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মানুষরাও এই সূত্রের তথাকথিত জ্ঞানীদের মুখোশ উন্মোচন করতে সক্ষম। অবশ্য শেষোক্ত ধারণাটুকু তাদের কাছে প্রত্যাশা করা চলে না। কেননা এটা সম্পূর্ণ বস্তুবাদী বিশ্বের বাইরের কথা তাই এই কথায় তাদের আসতে হলে বস্তুর সীমানা পাড়ী দিয়ে আসতে হবে।
একথাগুলো উল্লেখ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মহান স্রষ্টা অতি সুন্দর পরিকল্পনায় এ বিশ্বকে সাজিয়েছেন। আর এই বিশ্বের রাজমুকুট স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। এজন্য আল্লাহ বলেছেন আমি ভূ-পৃষ্ঠে আমার প্রতিনিধি পাঠাতে চাই। অতএব এই মানুষের প্রকৃত অবস্থান হল 'মাকামে খালিফাতুল্লাহ্' অর্থাৎ সে সৃষ্টিজগতে মহান স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করবে।