somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

একটি তালগাছের কাহিনি

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক)
আমাদের বাংলা ঘরের কোণায় তিরিশ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে তালগাছটি, সে আমাদের পরিবারের সদস্য। জন্মের পর থেকেই তাকে দেখছি। তার সাথে খেলাধুলা করেছি, আড্ডা দিয়েছি, কারণে-অকারণে মান-অভিমান করেছি, তার সুশীতল ছায়ায় বসে প্রাণ জুড়িয়েছি। মায়ের বকুনি খেয়ে লাফিয়ে তার চূড়ায় গিয়ে উঠেছি। সে তখন সন্তানস্নেহে কোলে তুলে রাখত। সে আমাদের পরিবারের সুখ-দুখ ও নানা ঘটনা-রটনার জীবন্ত সাক্ষী। ঘর থেকে বেরুতে তাল গাছ, ঘরে ফিরতেও তাল গাছ। তার বিশাল দেহ ষ্পর্শ করা ছাড়া আমাদের যাওয়া-আসা হয় না।

দুই)
মা-বাবা প্রায়ই বলেন, তালগাছটি আমাদের সন্তানের মত। পরিবারের সবার মায়া-মমতায়, আদর-স্নেহে সে বড় হয়েছে। আমরাও তার কাছ থেকে কম পাইনি, কম শিখিনি। আমাদের সে উদারভাবে দিয়েছে ফল, ছায়া, মায়া, আদর-স্নেহ, ভালবাসা আর সব কিছু সয়ে যাওয়ার কঠিন শিক্ষা। আমরা কোনো দুখে, যন্ত্রণায় তালগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে, তাকে ধরে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে-কেটে চোখের জল ফেলি। তার কাছে কত যে মান অভিমান করি। সে তার অদৃশ্য হাতের কোমলষ্পর্শে আমাদের শান্ত্বনা দেয়। অসীম কষ্টে সীমাহীন ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। আমাদের বিপদে-আপদে, শত কষ্টের মাঝেও তালগাছটি যেন সব সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাদের কোনো আনন্দ সংবাদে সে যেন ফুর্তিতে নেচে উঠে। আমাদের সব কাজে, আনন্দ বেদনায় তার নীরব উপস্থিতি অনুভব করি। সে আমাদের সাথে বসে খায় না, শোয় না, পরে না অথচ মনে হয় সবসময় সে আমাদের পাশেই আছে। তার উন্নত মাথা আমাদের হৃদয়ে অফুরন্ত সাহস যোগায়।

তিন)
তালগাছটির সাথে আমাদের পরিবারের শিশুদেরও বেজায় ভাব। তারাও এর সাথে খেলে, মান-অভিমান করে, আদর-আপ্যায়ন করে, কারণে-অকারণে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে আবার শাসনও করে।
প্রায়ই দেখি, আমার নয় বছরের ছেলে শামস রাগী স্যার হয়ে গর্ধভ ছাত্র তালগাছটাকে বেদম পেটায়। হাতে বেত নিয়ে ছোট্ট শিক্ষকটি বিশাল ছাত্রটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সে বেত নাচিয়ে দাঁত খিচিয়ে ছাত্রটিকে বলে- "আজকের ইংরেজি পড়াটা সবাই পারল, তুই পারলি না কেন? সারাদিন তুই করিসটা কি শুনি? খালি টিকেট আর ডাঙ্গুলি খেলা, নাহ্? আর কী শুনছি এসব, তুই নাকি দোকানের চিপায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানিস? কি, কথা বলছিস না যে? বল, এসব বদ অভ্যাস হলো কি করে, বল, বল বেটা গর্ধভ"-বলেই ডানে বামে অন্ধভাবে পেটায় ছাত্রটিকে। সে কি পিটানি রে বাবা! তখন নানা দোষে দুষ্টু ও অপরাধী ছাত্রটি রাগী স্যারের বেতের ভয়ানক নর্তন-কুর্দন আর চটাচট আঘাতে একেবারে চুপসে যায়। মাথা নত করে অসহায়ভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেটে সবিনয়ে বলে, "আর ভুল হবে না স্যার, এখন থেকে পড়ার সময় পড়ব, অনুমতি দিলে খেলার সময় খালি একটু খেলব। স্যার, এই আমি কানে ধরে শপথ করে বলছি, জীবনে বিড়ি টানব তো দূরের কথা, এর ধারে কাছেও ঘেষব না আমি। আজ মাফ করে দেন স্যার।" তার এসব কথা, কান্না আর আবদার-নিবেদনে রাগী স্যারের মন গলে না সহজে।

"এ বয়সে লেখাপড়া আর খেলাধুলা ছাড়া তোর কোনো কাজ-কম্ম আছে? না, নেই। ইস্কুলের পড়া যদি না শিখে আসিস, তবে তোর দফা রফা করে ছাড়ব বলে দিলাম, বুজেছিস, ফাজিল কোথাকার? যা বেটা, সিটে গিয়ে ব।" ভারী গলায় এসব আদেশ-উপদেশ আর ঝাল উদগীরণ করে হাতের অবশিষ্ট ভাঙ্গা বেতটা আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে পরেই না ক্ষান্ত হন নয় বছরের রাগী শিক্ষক মশাই।

চার)
তালগাছটার সাথে আমার বোন লাবনীর নিবিড় সম্পর্ক। সে কতবার যে তালগাছটাকে কনে সাঝিয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছে, আর কতবার যে বর সাঝিয়ে বিয়ে করিয়ে লাল টুকটুকে বউ এনে ঘরে তুলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ঘরে নতুন বউ আনার আনন্দে ও কনেকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার কষ্টে অসংখ্যবার তার চোখ অশ্রুসজল হয়েছে। এ ক্ষুদ্র নারীটির সাথে তালগাছটার হৃদয়ের নীরব সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। তার সেই পুতুল খেলার বয়স আর নেই। এখন বিয়ের প্রস্তাব এলেই সে সবার অগোচরে তালগাছটি ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে নালিশ করে। তালগাছটি তার সব কথা শুনে শান্ত্বনা দেয়; অতঃপর কষ্টগুলো নিংড়ে নিয়ে আদর করে অবুঝ শিশুর মত ঘরে পাঠায়।

পাঁচ)
ইদানীং তালগাছটার আরেকটি কর্তার আবির্ভাব ঘটেছে-সে আমার সাত বছরের মেয়ে বিন্তি। ছোট কর্তাটি তার ফুফু লাবনীর অনুকরণে তালগাছটাকে অতি আপন করে নিয়েছে। কখনো দু জনে এক হয়ে কখনো বা প্রতিযোগিতা করে আদর-সোহাগ করে, আবার মান-অভিমান ও শাসন-বারণ করে। তাদের আদর-শাসন রাগী স্যারের মত নয়; মার্তৃস্নেহে পরিপূর্ণ।

ছয়)
হঠাৎ করেই পাশের গ্রামের বিদেশগামী ছেলের সাথে লাবনীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তিন দিনের মাথায় বিয়ে এবং এক শ লোক খাওয়াতে হবে। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবার মুখ রক্ষা করে এত বড় আয়োজন করার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি আমাদের নেই। অনেকগুলো টাকা যোগাড়-যন্তের ব্যাপার।

একে তো সর্বকণিষ্ঠা কন্যা তার উপর পাত্রটিও ভাল। বাবা কাধে পাঞ্জাবীটা ফেলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ঘন্টা দুই পরে বাড়ি এসে বল্লেন, "বিয়ের আয়োজন শুরু করে দে। টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।"
আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বোনটিকে চোখের জলে বিদায় দিলাম। বোনটিও একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। সবশেষে নব বধূটি সবার মধ্য থেকে ছুটে গিয়ে তালগাছটার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে প্রলাপে-বিলাপে কান্না জুড়ে দিল। বাড়ির ছোট বড় কেউ আর অশ্রু সম্বরণ করতে পারল না; মমতাময়ী নির্বাক তালগাছের পক্ষে সবাই চিঁ চিঁ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। "তালগাছটাকে দেখ, নিয়মিত পানি দিও, ওর গায়ে যেন কেউ পেরেক না ঠুকে" এসব বলতে বলতে সে চোখের জলে বিদায় হয়ে গেল।

সাত)
দুদিন পর ব্যাপারীরা এসে ফিতা টেনে তালগাছের বেড় মেপে এর কি পরিমাণ সার-পাগাল ও টানা- ধরনা হবে এসব হিসেব-নিকেস করল। গাছটার মোড় কোনদিকে এবং কাটার পর কোন দিকে ফেলা হলে পরে ঘর বাড়ি ও অন্যান্য গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ঘুরে ফিরে এসব পরখ করে ব্যাপারীরা কাছির টানা দিয়ে চলে গেল। মা এসব দেখে বিচলিত হয়ে বাবাকে অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন। বাবা কোনো জবাব দিলেন না; মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

আমার ছেলে-মেয়ে শামস ও বিন্তি স্কুল থেকে এসে দেখে, তালগাছটার গলায় কাছি বেধে অদূরে একটা খোলা জায়গায় খুঁটি গেড়ে টানা দেয়া হয়েছে। তারা যাকে সামনে পেল তাকেই এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগল। কেউই এর সদুত্তর না দিয়ে বিরক্তির সুরে জবাব দিল, ”জানিনা”।

শিশু দুটি কাছির শক্ত টানা খুঁটি ঢিলা করার ব্যর্থ কসরত করে ঘরে এসে চিৎকার করে দাদাকে বলছে, আমাদের তালগাছের গলায় ফাঁশি লাগাল কে। গাছের শ্বাস তো বন্ধ হয়ে যাচেছ। ওর খুব কষ্ট হচেছ। তাড়াতাড়ি বান খুলে দাও দাদা, এক্ষুনি। কথা বলছ না কেন?
-গাছ বিক্রি করে দিয়েছি। ব্যাপারিরা আগামীকাল গাছ কেটে নিয়ে যাবে। ফাঁশ লাগিয়েছে, ভাল করেছে। এত প্যারপ্যারি করিস না, যা এখান থেকে-বলেই তিনি ধপধপ করে দ্রুত বাইরে চলে গেলেন।
রাখ, এক্ষুনি লাবনী ফুফুকে গিয়ে বলছি-বলেই শিশু দুটি হন হন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

আট)
পরের দিন সকালে লাবনী ঝড়ের গতি নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। এ অবস্থায় তাকে দেখে সবাই অবাক। ব্যাপারিরা বাইরের উঠোনে বসে রেত দিয়ে করাতের দাঁতে শান দিচেছ। শান দেয়ার কর্কশ শব্দে লাবনীর অন্তরাত্না মোচড় দিয়ে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে তালগাছটা বুকে আগলে ধরে আদর করে কেঁদে কেঁদে বলল, আমি বেঁচে থাকতে তোর গায়ে একটা আঁচড় কাটতে পারবে না কেউ।

উপায়হীন বাবা তার কুড়ি বছরের আদরের কন্যাকে সুপাত্রস্থ করার আনন্দে তিরিশ বছরের সন্তানতুল্য তালগাছটাকে নীরবে বিসর্জন করেছেন। এখন নীরব তালগাছটার জন্য কন্যার সরব উত্তেজনা আর লড়াইয়ের ঠিক মাঝখানটায় অপরাধী পিতা সংকোচে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সবার চোখে পানি।

লাবনী তার আঁচল থেকে এক তোড়া টাকা বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলল, যাও- এক্ষুনি ব্যাপারীকে টাকাটা ফেরত দিয়ে আস।

বাবা টাকাটা ফেরত দিয়ে এসে সবার সাথে আনন্দে যোগ দিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:০৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×