somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বন্ধু ক্রিস সমাচার!!!

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার বন্ধু ক্রিস। একে আপনারা অনেকেই চিনেন। আমার বেশ কয়েকটা লেখায় ওর প্রসঙ্গ আছে। আর যারা চিনেন না তাদের বলছি, ক্রিস একজন আইরিশম্যান। আমার খুবই ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু এবং সহকর্মী। আমার মনে হয় আপাততঃ এ'টুকুতেই কাজ চলবে।

গত শনিবার হাত-পা ছড়িয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছি। এমন সময় বিকট শব্দে ফোন বেজে উঠলো। অসময়ের ফোন আগে ধরতাম না, অবশ্য ধরার কায়দাও থাকতো না; কারন ঘুমানোর আগে ফোন সাইলেন্ট মোডে দিয়ে দিতাম। করোনার কারনে গত এক বছর ধরে এই প্র্যাকটিসটা বাদ। ফোনকে সব সময়ে সরব রাখি। কারন আর কিছুই না। দেশ থেকে কে কখন ফোন করবে, আর আমাকে পাবে না……..এমনটা যেন না হয়।

বেডসাইড ল্যাম্পটা অন করে ঘড়ি দেখলাম। ভোর পৌনে আটটা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার! সূর্য না উঠলেও উঠার সময় হয়ে এসেছে। এমন সময় কিছুটা আলো থাকার কথা, তবে আকাশ মেঘলা থাকার কারনেই সম্ভবতঃ অন্ধকার। এই দেশে পাতিকাক নাই। কদাচিৎ দু'একটা দাড়কাক দেখা যায়, তবে তারা যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং গম্ভীর প্রকৃতির; অযথা ডাকাডাকি করে নিজেদের ওজন নষ্ট করে না। তারপরেও এই তথাকথিত কাকডাকা ভোরে কে ফোন করলো দেখার জন্য স্ক্রিনে তাকিয়ে মেজাজ চড়ে গেল। ক্রিস ফোন করেছে।

কলটা নিলাম।

হ্যালো…...গলায় যতোটা সম্ভব বিরক্তি ঢালা যায়, ঢেলে দিয়ে বললাম।

ক্রিসের উৎফুল্ল কন্ঠস্বর ভেসে এলো, গুড মর্নিং মফিজ। ঘুমাইতাছো নাকি!

রাগের চোটে বললাম, না, ফুটবল খেলতাছি। ছোটবেলার অভ্যাস। সূর্য ওঠার আগে আমি নিয়মিত ফুটবল খেলি!

আহা, চেতো ক্যান। শোন, সিদ্ধান্ত নিলাম…….এই বালের চাকরী আর করুম না!

আমি বললাম, কনগ্রাচ্যুলেশানস। তোর আর কিছু বলার আছে?

আছে। কাইল রাইতে আমারে কি খাওয়াইছো! রাত তিনটা থিকা টয়লেটের দরজায় বইসা আছি। একটু পর পরই প্যাট গুড়গুড় করে, তাই বেশী দুরে যাইতে পারি না। অবশ্য অবস্থা এখন ইকটু ভালো, তারপরেও দরজাতেই আছি। বলা তো যায় না……..কখন কি ঘইটা যায়!!!

আমি বললাম, তোর আপডেটের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। এখন রাখি। আমার আরও কিছুক্ষণ ফুটবল খেলতে হইবো।

এই হলো ক্রিস। এমনিতে ওর সময়জ্ঞান খুবই টনটনে। কিন্তু আমাকে বিরক্ত করার সময় কোন ব্যাকরণ মানে না। বরং কোন সময়টাতে আমি বেশী বিরক্ত হবো, সেটা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা সাজায়। চাকুরী ছাড়ার কথা গত ছয়মাসে কম করে হলেও ষাটবার বলেছে। এই কথা বলার কারন আছে। ঘটনা হলো, মাস ছয়েক আগে ওর ডিপার্টমেন্টে একজন নতুন বস এসেছে। চোখ ট্যারা হওয়ার মতো সুন্দরী একটা মেয়ে, জেনিফার। অত্যন্ত দক্ষ, সিরিয়াস আর ক্যারিয়ারিস্ট এই ইংলিশ মেয়ের চেহারা দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারন নাই। নিজের কাজ সে খুবই ভালো জানে। তো, বেশী কথা বলা ক্রিস তার ডিপার্টমেন্টের ভারতীয় কলীগ রাজেশকে বলেছে, জেনিফার কি জানে? অল্প বয়সে বস হয়েছে শ্রেফ চেহারা দেখিয়ে। ওকে আমি দুইবার বেচে তিনবার কিনতে পারি!! রাজেশ সেই কথা আরো ঘি-বাটার লাগিয়ে আকর্ষনীয়ভাবে জেনিফারের কাছে উপস্থাপন করেছে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। জেনিফার এখন দিবারাত্রি ক্রিসকে দৌড়ের উপর রাখে। আমি অবশ্য ক্রিসকে বহুবার বলেছি, এই রাজেশের কাছে কোন বেফাস কথা না বলতে……..ব্যাটা চুকলিবাজিতে ওস্তাদ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। জিহ্বাকে লাগাম পড়ানো ওর ধাতে নাই।

ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের ধরন সবার এক রকমের না। এমনিতেই ক্রিস একটা ভয়াবহ দুঃসময় অতিবাহিত করছে। দীর্ঘদিনের পার্টনারের ওকে ডিচ করে চলে যাওয়া, রোমানিয়ান সুন্দরী সুজানার কাছ থেকে ছ্যাকা খাওয়া, নতুন করে কোন যুৎসই সঙ্গী না পাওয়া, লক ডাউন, আইসোলেশান, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, হোম অফিস ইত্যাদি সবমিলিয়ে মানসিক যাতনার সময়টাতে ওর মেন্টর হিসাবে আমাকেই বেছে নিয়েছে সে। আমাকে প্রায়শঃই বলতো, মফিজ…...আমি মনে হয় পাগল হয়া যাইতাছি। মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমার প্রয়োজন ফুরাইছে। এখন চইলা যাওয়ার অপেক্ষা!! আমার হিংসা হয় তোমারে দেইখা। তুমি এতোকিছুর মধ্যেও এতো স্বাভাবিক আর ফুর্তিতে থাকো কেমনে? আর এর সাথে যোগ হয়েছে, নতুন বসের বিষয়টা!!

আমি বলতাম, দ্যাখ্…..পাগল হওয়া এতো সোজা না। আমাদের দেশে পাগল মানে আধা-নাঙ্গা হয়ে রাস্তায় দাড়ায়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা। এর কম হইলে তাকে পাগল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। দেশ তো দেশ, উন্নত দেশগুলোতে যেসকল বাংলাদেশীরা দীর্ঘদিন ধরে থাকে, তাদেরও অনেকে বিষয়টা বোঝে না। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, সাইকোথেরাপী, কাউন্সেলিং ইত্যাদি বিষয়গুলি এই গাধাদের কাছে হাস্যকর ব্যাপার! কাজেই তোর টেনশান করার কিছু নাই। তুই এখনও এই দুনিয়ায় অনেকের কাছেই পাগল না। তবে আমার মত হইলো, কাউন্সিলের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যা। কয়েকটা সেশান কর। আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে।

এখন ওর ডিপ্রেশান অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তারপরেও দুই দিন পর পরই ওর বসের সাথে কাইজ্জা করে, আর আমার কাছে এসে হা-হুতাশ করে। আমি বলি, এই দুর্দিনে মাথা গরম করে হুট করে এই ভালো চাকুরীটা ছাড়িস না খবরদার!! বসের সাথে মানায়া চল। কম্প্রোমাইজ ইজ দ্য কী!! দেখস না, আমি তোর ভাবীর লগে কিভাবে মানায়ে চলি……...দ্যাখ আর শিখার চেষ্টা কর!! আমাকে বলে, দেশী মাইয়াগো পিছে আর ঘুরুম না। তুমি আমারে ভাবীর মতোন একটা বাংলাদেশী মাইয়া যোগাড় কইরা দেও। আমি বলি, বাংলাদেশী মাইয়া আমি পামু কই? তাছাড়া মানায়া চলতে না পারলে বৃটিশ আর বাংলাদেশী মাইয়ার মধ্যে কোন তফাৎ নাইরে পাগলা। একটা জ্বলন্ত কয়লা, তো আরেকটা ফুটন্ত কড়াই!!! ব্যাটা আমার কথা বিশ্বাস করে না। ঘোরতর অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ক্ষণে ক্ষণে দেশের রাস্তার কুত্তাগুলার মতোন ফোস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে! ওর অবস্থা দেখে খারাপ লাগলেও আমার আসলে করার কিছুই নাই। ব্যক্তি-স্বাধীনতা যে কতোটা মুল্যবান, সেটা যার আছে সে বোঝে না!!

এবার ক্রিসের পেট খারাপের প্রসঙ্গে আসি।

দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রায়ই সন্ধ্যার পর আমার বাসায় এসে বসে থাকে। আমরা একসাথে আড্ডা দেই। বসে বসে রাজা-উজির মারি। বাসায় যেদিন আসে, একেবারে ডিনার পর্ব সেরে তবেই যায়। আমাকে বলে, তোমার বাসায় খাইতে খাইতে আমার টেস্ট এখন বাংলাদেশীদের মতোই হয়া গেছে। আমি এখন তোমাদের মতো ''হট এন্ড স্পাইসি'' খাবার খাইতে পারি। আমি যতোই বলি, তুই যেদিন আসিস, সেদিন আমাদের বাসায় রান্না অনেক মাইল্ড করা হয়। আসল দেশী খাবার তোর পেট সইতে পারবো না। আমার কথা সে কানেই তোলে না। গত শুক্রবার আমি ওর জন্য যখন 'কুইক বিরিয়ানী' রান্না করছিলাম, ও বলে বসলো, তোমার পছন্দমতো রান্না করো! আমার কোন সমস্যা নাই, খাইতে পারুম!!

আমার জন্য কুইক বিরিয়ানী রান্না করলে আমি সাধারনতঃ অতিরিক্ত ফ্লেভার আর ঝালের জন্য বোম্বাই মরিচ দেই। আমাদের এইখানে যেটা পাওয়া যায়, সেটা আফ্রিকান। দেখতে আমাদের বোম্বাই মরিচের মতো হলেও ভয়াবহ ঝাল, আর ঝালটা সঙ্গে সঙ্গে অতোটা টের পাওয়া যায় না। ওর কথায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওটাই একটা দিয়ে দিয়েছিলাম। মজা হইছে…...বলে ঠিকঠাক মতোই খেলো। এর পরেই আস্তে আস্তে দেখি ওর চেহারা টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম!! আমার ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে কিছু বলবে না জানতাম, তাই মিষ্টি লাচ্ছি আর আইসক্রীম রেডি রেখেছিলাম। সব খেয়েদেয়ে দ্রুত বিদায় নিয়েছিল সেদিন! তারপরের ঘটনা তো আপনারা প্রথমেই জেনেছেন!!

শনিবার সকালে নাস্তা করতে করতে ওকে ফোন দিলাম। বললাম, কিরে ব্যাটা! আমার ওরিজিনাল বিরিয়ানী বানামু আইজকা? রাইতে খাবি??

ও বললো, আমার কষ্ট কইরা নিজে নিজে আত্মহত্যা করনের দরকারটা কি? তোমার ওই বিরিয়ানী আর কয়েকবার খাইলেই কাম হইবো। তয়, তুমি যদি আমার লাইগা একটা কাম করতে পারো, আমি বাকী জীবন তোমার কেনা গোলাম হয়া থাকুম!!

আমি বললাম, ক দেখি! তোর জন্য কি করতে পারি!!

ক্রিস শয়তানের মতো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে বললো, জেনিফাররে দাওয়াত দিয়া তোমার ওই ইস্পেশাল বিরিয়ানীটা রাইন্ধা খাওয়াও। যদি খাওয়াইতে পারো, তুমি যা কইবা…….আমি করতে রাজি আছি। কও রাজি???


ছবি গুগলের!!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:১৬
২৩টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×