somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন শাহরিয়ার কবির: মানব মুক্তির পথে আজীবন সংগ্রামী এক যোদ্ধা

২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জন্ম ২০ নভেম্বর ১৯৫০, ফেনি জেলায়, লেখক, সাংবাদিক এবং প্রমাণ্যচিত্র হিসেবে সমধিক পরিচিত, এক সময় তিনিই ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিশু সাহিত্যিক, কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করার নেশায় বিসর্জন দিয়েছেন লেখক সত্তার অনেকখানি। নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, আবুদের অ্যাডভেঞ্চার, পাথারিয়ার খনি রহস্য, আলোর পাখিরা, হাত বাড়ালেই বন্ধু, কার্পথিয়ানের কালো গোলাপ, চীনা ভূতের গল্প, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, একাত্তরের যীশু, সীমান্তে সংঘাত, নিশির ডাক, বার্চবনে ঝড়, বহুরূপী, ব্যাভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, মরু শয়তান, একাত্তরের পথের ধারে —তার অন্যতম জনপ্রিয় শিশু কিশোর সাহিত্য রচনা। এছাড়া তিনি তার স্কুল জীবনের (সেইন্ট গ্রেগরি স্কুল) স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন সাধু গ্রেগরীর দিনগুলি। ষাটোর্ধ বই লিখেছেন তিনি, এবং প্রতিটি বই-ই সুপাঠ্য। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, যদিও কোনো ধরনের পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ব্যক্তি শাহরিয়ার কবিরের কোনো মাথাব্যথা নেই, উজান স্রোতের যাত্রীরা সে হিসেব কখনো করেও না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (বাংলা সাহিত্যে) পড়াশুনা শেষ করে তিনি ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদক পদে থাকেন। দুই দশক সাংবাদিকতার পর ১৯৯২ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশের মক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করতে শুরু করেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত গঠনের মাধ্যমে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী— যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন সেই গণআদালতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মূলত এই সময় থেকেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। শাহরিয়ার কবির এ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
এরপর যাত্রাপথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, কখনো কখনো ভীষণ কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে —এ যাত্রাপথে অনেকের পাশাপাশি সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি সঙ্গে পেয়েছেন কাজী মুকুল কে— যিনি লম্বা সময় ধরে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারই বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নির্মূল কমিটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ বিনির্মাণে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ভারত, তুরস্ক, মিশর সহ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে, এমনকি পাকিস্তানেও।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন বিএনপি সরকার জাহানারা ইমাম এবং শাহরিয়ার কবির সহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। যদিও পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করে। এরপর থেকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হলেও অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমাম মৃত্যুবরণ করার পর কার্যত নির্মূল কমিটির হাল ধরেন জনাব শাহরিয়ার কবির। এরপর থেকে তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে কীভাবে দেশটাকে শত্রুমুক্ত করা যায়, কীভাবে দেশটাকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া যায়। গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়া সেটি সম্ভব নয় বলেই শুরু থেকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির মূল দাবী ছিল— যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা।
সংগঠিত শত্রুপদের, হত্যাকারীদের, নির্মম বেনিয়াদের কাঁটা বিছানো বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বিচারের সম্মুখিনে করতে হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের —এ সফলতা সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের অবশ্যই, তবে সংগঠন হিসেবে যেমন বিচারের এ পথটি তৈরি করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, তেমনি ব্যক্তি হিসেবে সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। তিনি যে শুধু নির্মূল কমিটির হাল ধরে, সংগঠনের জন্য উদয়অস্ত পরিশ্রম করে সে ভূমিকা পালন করেছেন তা নয়, মেধাবী এ লেখক তার লেখনীর মাধ্যমেও সে কাজটি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের ওপর তিনি কমপক্ষে পনেরোটি বই লিখেছেন— একাত্তরের যিশু, গণআদালতের পটভূমি, জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি, ঘাতকের সন্ধানে, বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদ, মুক্তিযুদ্ধের বৃত্তবন্দি ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াতের অপরাজনীতি, যুদ্ধাপরাধীর বিচার: পক্ষ ও বিপক্ষ, একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, সভ্যতার মানচিত্রে যুদ্ধ যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার —এরকম আরো অনেক বই তিনি লিখেছেন, যার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে।
শুধু লেখালেখি এবং আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে তিনি তার কর্ম সীমাবদ্ধ রাখেননি, পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান একজন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজে অধিকতর সহযোগী হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের ওপর তার নির্মাণ করা প্রামাণ্যচিত্রগুলি। তার বেশিরভাগ প্রামাণ্যচিত্র মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদ এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওপর হলেও সম্প্রতি তিনি এ পর্যন্ত দুটি প্রামাণ্যচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সুফিবাদের ওপর —যা দেশে বিদেশে দর্শক নন্দিত হয়েছে।
তিনি একজন বাচিক যোদ্ধাও, তার মতো এতটা স্পষ্ট করে কেউ মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতার পক্ষে এবং মৌলবাদ তথা উগ্রবাদের বিপক্ষে বলেননি। প্রায়ই তাকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বলতে শোনা যায়— কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছাড়া তিনি সরকার এবং গণমানুষের জন্য দিকনির্দেশনা তৈরি করে থাকেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবতার পক্ষে তার এসব বক্তব্যে।
অন্ধকারের অপশক্তি তাকে থমকে দিতে চেয়েছে বহুবার, তার উপর বোমা হামলা পর্যন্ত হয়েছে, কিন্তু দমে যাননি —মানব মুক্তির জন্য কাজ করতে হলে লড়তে হয় মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে, সে যুদ্ধে জীবনহানী ঘটতে পারে, এটা তিনি জানেন, জানেন বলেই তিনি অকুতোভয় সচেতন এক নির্ভিক কাণ্ডারী —দেশের তথা সমগ্র পৃথিবীর মানব মুক্তি জন্য যে বয়ান তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন, তৈরি করেছেন —বিজ্ঞান মনস্ক, আধুনিক, ধর্মের প্রশ্নে মানবিক আগামীর মানব সম্প্রদায়কে তা পথ দেখাবে সহস্র বছর।
করোনা ভাইরাসের এ দুর্গতিকালে এসেও মানুষের জন্য নিশ্চেষ্ট থাকেননি তিনি— তার আহ্বানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা: উত্তম কুমার বড়ুয়া এবং বিশ্বনন্দিত চিকিৎসক, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: মামুন আল মাহতাব স্বপ্নিলের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ১০৮ জন ডাক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বিশেষ মেডিকেল সেল, যেখান থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বিনামূল্যে পরামর্শ নিতে পারবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:১১
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×