অনেকেই আশা করেছিলেন, দেশব্যাপী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা বিবেচনায় রেখে অন্তত পরীক্ষার দিনগুলোতে অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু রাজনীতিকদের নির্লজ্জ ক্ষমতালিপ্সা সব বিবেক-বিবেচনা ও কাণ্ডজ্ঞানকে পদদলিত করে তাদের কর্মসূচিতে নতুন করে তিন দিনের হরতাল যুক্ত করেছে। সাধারণভাবে হরতাল বলতে যে চিত্রকল্প আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সেই যানবাহনশূন্য রাজপথ এবং বন্ধ দোকানপাটের দৃশ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অধিকাংশ শহর-নগর থেকে উধাও হয়ে গেছে। লাগাতার হরতাল-অবরোধে ত্যক্তবিরক্ত মানুষ এরই মধ্যে পথে নেমে এসেছে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। সাধারণ মানুষের সমর্থর্নহীন এই হরতাল-অবরোধ 'সফল' করতে কর্মসূচি আহ্বানকারীদের তাই জনমনে ভীতি সঞ্চারের মতো হীন কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
রাজনীতির এই চাতুর্যপূর্ণ খেলায় এখন প্রধান প্রতিপক্ষ সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, প্রান্তিক চাষি ও ফুটপাতের হকারসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকার ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আবার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পথে বের হলে পুড়ে মরছে। তৈরি পোশাক পরিবহনে অচলাবস্থা, বন্দরে খালাসকৃত পণ্যের স্তূপ এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে সংকট দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে ফেলেছে। অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ও বছরের শুরুতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনকে বাধাগ্রস্ত করেও 'আন্দোলনে' সাফল্য অর্জন করতে না পারায় এবার মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার্থীদেরও প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাদেরই অভিভাবকদের একটি অংশ।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্নার ঠিক পাশাপাশি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। কিন্তু দুর্বৃত্তরাই সব রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান নিয়েছে অথবা রাজনীতির পুরো চালিকাশক্তির আসনে দুর্বৃত্তরাই আসীন হয়েছে- এমনটি আগে আর কখনোই ঘটেনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কায়দায় বিপথে পরিচালিত করে পরিস্থিতিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি দুঃসহ জনদুর্ভোগে পরিণত করার দায়ভার প্রকৃতপক্ষে কার ওপর বর্তায়?
২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা দৃশ্যত সংবাদপত্রে ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অবরোধ বা হরতালে সাফল্যের দাবিদার নেতা-নেত্রীরা সরকারের পুলিশি তৎপরতা এবং জনরোষ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চান। ফলে দলটির অল্পসংখ্যক ছাত্র-যুবকর্মী এবং ভাড়াটিয়া দুর্বৃত্ত বাদ দিলে দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির দায়িত্ব জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী ক্যাডাররা নিজেদের প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই কাঁধে তুলে নিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর- যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছে, যারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত মনেপ্রাণে স্বীকার করে নিতে পারেনি, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপর্যয়ে তাদের কিছুই আসে যায় না। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিবেকহীন নির্মমতার মধ্য দিয়ে যারা দেশের মেধা ও মননের বিকাশ এবং প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে বাধাগ্রস্ত করার বিষয়টি আয়ত্ত করেছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি তাদের নিয়মিত কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে- এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উচ্চশিক্ষার স্বাভাবিক উত্তরণের পথকে ভীষণভাবে বিপদগ্রস্ত করেছে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এবং সব শেষে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পথে হরতাল-অবরোধের কাঁটা বিছিয়ে ২০ দল ও তাদের কর্মসূচি পালনের প্রধান সহায়ক শক্তি সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবির এবার দেশের পুরো শিক্ষা কার্যক্রমের বিরুদ্ধেই তাদের জিহাদ ঘোষণা করেছে।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে আধুনিক লেখাপড়া ও নারীশিক্ষার ঘোর বিরোধী সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নাইজেরিয়ার তথাকথিত জিহাদি সংস্থা জামাতু আহলিস্সুন্নাহ গত ছয় বছরে হত্যা করেছে পাঁচ হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ। বোকো হারাম নামে পরিচিত এই সন্ত্রাসীরা স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল-হোস্টেল থেকে অপহরণ করে হত্যা করেছে কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী এলটিটিই স্কুলবাসে বোমা ছুড়ে হত্যা করেছে অসংখ্য শিশু শিক্ষার্থী। পাকিস্তানে শুধু প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে স্কুলে ঢুকে নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে শতাধিক শিশু-কিশোরসহ ১৩৭ জন নিরপরাধ মানুষকে।
কখনো জিহাদের নামে আবার কখনো স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার নামে শিশু-কিশোরদের জীবন বিপন্ন করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কখনোই মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত করা হয়েছে, তা যদি দুর্বৃত্তদের কাজ হয়ে থাকে তাহলে শুধু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নয়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও যারা তাদের এই নৈরাজ্য সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের আরো কঠোর ভূমিকা গ্রহণ এবং জনগণের দৃঢ় অবস্থান জরুরি হয়ে পড়েছে।
১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে যারা বর্তমানকে অস্বীকার করে চলেছে, তাদের জন্য ভবিষ্যতের বাংলাদেশও কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আমরা যেমন অতীতের কোনো রাজনৈতিক অপরাধ ও অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কথা ভুলে যাইনি, তেমনি আজকের পরীক্ষার্থীদের কণ্ঠেও নিশ্চয়ই হরতাল-অবরোধের মতো উৎকণ্ঠা ও দুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের কথা ভবিষ্যতে উচ্চারিত হবে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের সঙ্গে। তারা কখনোই এসব দুর্বৃত্তকে ক্ষমা করবে না।