somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি হত্যাকাণ্ড ও পুলিশের তৎপরতা

০৫ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একুশের বইমেলায় যাবার পথে রাজু ভাস্কর্যের উত্তর পাশে গাড়ি থামিয়ে নামার চেষ্টা করার সাথে সাথেই পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন। সন্ধ্যার ঠিক পরপরই আধো অন্ধকারে এই কর্মকর্তার পদ-পদবী অথবা তার নাম ফলক দেখার সুযোগ হয়নি তবে তার উদ্ধত আচরণ আমার মনে আছে। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এখানে আমরা মোটেও পার্কিং-এর কথা ভাবছি না, বরং মেলা থেকে ফিরে আসার পরে গাড়িটা কোথায় খুঁজে পাবো সে ব্যাপারে চালককে নির্দেশনা দেবার জন্যেই একটু দাঁড়াতে হয়েছে মাত্র। আমাদের ড্রাইভার পুলিশের এই কর্মকর্তার চেয়ে নিঃসন্দেহে বিচক্ষণ ও প্রত্যুতপন্নমতি সম্পন্ন। কাজেই কালবিলম্ব না করে সে দ্রুত ইউটার্ন নিয়ে রাজু ভাস্কর্য ঘুরে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির দিকে চলে যাবার ফলে ঘটনাটির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে।

মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎ রায় ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের হাতে নিহত হবার পরে হিসাব করে দেখেছি, কয়েকদিন আগে আমি যেখানে গাড়ি থামিয়েছিলাম সেই স্থানটির আট দশ হাতের মধ্যে অভিজিৎকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ যেখানে এবং যে সময়ে হত্যাকারীরা এই ঘটনাটি ঘটায় সে সময় এই স্থানটিকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ছিল এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। অতএব পুলিশ সামান্য তৎপর হলে হত্যাকারীদের নির্বিঘেœ পালিয়ে যাবার সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে ফেলতে পারতো। আর পুলিশ যদি বেশি রকম তৎপর হতো তাহলে এই হত্যাকাণ্ডটি কখনোই ঘটানো সম্ভব ছিল না। একজন বিজ্ঞান মনস্ক যুক্তিবাদী লেখককে অকালে কূপম-ুকদের জঘন্য জিঘাংসার শিকার হতে হতো না।
আমাদের ‘দক্ষ ও প্রশিক্ষিত’ পুলিশ বাহিনি যে মাঝে মধ্যেই তাদের ‘তৎপরতা’ দেখায় না তা মোটেও বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিমনকে গুলি করে ডাকাত হিসাবে উপস্থাপন করা এবং তাকে চির জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয়ার মতো পুলিশি তৎপরতার ক্লাসিক উদাহরণ না টেনে আমি শুধু এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। মাসের প্রথম দিনে পুলিশের ছবি তোলার ‘অপরাধে’ রমনা থানার পুলিশ ইংরেজি নিউ এজ পত্রিকার বিশ্বদ্যিালয় রিপোর্টার নাজমুল হুদা সুমন ও তার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খায়রুজ্জামান শুভকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এই ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ আমার জানা নেই তবে পরদিন দেশের সকল জাতীয় দৈনিকে ছবিসহ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

এর দুদিন পরে ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের পাঁচ ছয়জন ছাত্র ছুটির পরে টেকনিক্যাল বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। মিরপুর থানার কয়েকজন পুলিশ তাদের সেখানে দাঁড়াতে নিষেধ করে। কয়েকজন ছাত্র যেহেতু প্রতিদিন ছুটির পরে একই জায়গা থেকে যাতায়াত করে, স্বাভাবিকভাবেই তারা ‘কেন দাঁড়ানো যাবে না’ জানতে চায়। উল্লেখ করা যেতে পারে ইনস্টিটিউটে ভর্তির নূন্যতম যোগ্যতা ¯স্নাতক হলেও এদের অনেকেই ¯স্নাতকোত্তর এবং কেউ কেউ বিভিন্ন সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত। তাদের প্রত্যেকের গলায় ঝোলানো ছিল ইনস্টিটিউটের পরিচয় পত্র এবং হাতে ছিল প্রতিষ্ঠানের ছাপ দেয়া ব্যাগ। পুলিশের এই দলটি তাদের ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বললে সঙ্গত কারণেই তা তাদের ভীষণভাবে আহত করে এবং তারা এই সব অবিমৃষ্যকারী পুলিশের সাথে বচসায় জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তাদের উপর চড়াও হলে তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিউটে অবস্থান নেয়। সেখানে চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান প্রশিক্ষক খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকেরসহ ইনস্টিটিউটের অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তারা উপস্থিত হবার পরে উত্তেজিত পুলিশেরা তাদের সাথেও দুর্ব্যবহার করে।

উল্লিখিত দুটি ঘটনার পরে রাজু ভাস্কর্যের কাছে আমার সাথে পুলিশ কর্তার সামান্য উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কে আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিলাম। এমন কি ২০০৯ সাল থেকে পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধি, মানোন্নয়ন এবং সর্বোপরি ঔপনিবেশিক আচার আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে মানবিকতা ও গণসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষে ইউএনডিপি ও ডিএফআইডির আর্থিক সহায়তায় যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে তার কথাও বেমালুম বিস্মৃত হয়েছিলাম। আমার মনেই ছিল না পুলিশের এই শারীরিক মানসিক উন্নয়নে তিন বছরে ব্যয় করা হয়েছে এক কোটি সত্তুর লক্ষ ডলার, টাকার অংকে যা প্রায় একশ পঁয়ত্রিশ কোটি টাকা।

অভিজিৎ হত্যার পরে পুলিশের দক্ষতা ও তৎপরতার প্রশ্নটি নতুন করে কিছু জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। যখন একদল পুলিশের সদম্ভ উপস্থিতির মধ্যে একটি হত্যাকা- ঘটে এবং খুনি বা খুনিরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যায় তখন প্রশ্ন জাগে পুলিশ কি কেবল নিরস্ত্র নিরিহ জনগণের উপর চড়াও হবার জন্য? দক্ষতা ও মানবিকতা বৃদ্ধির লক্ষে ইউএনডিপি ও ডিএফআইডির বিপুল পরিমাণ ডলার পাউন্ডের পুরোটাই কি পানিতে পড়েছে? বিপুল জন সমাগমের জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা বিধানের জন্য নিয়োজিত পুলিশ যদি নিরাপত্তা না দিতে পারে তাহলে তাদের কি জন্যে রাখা হয়েছে? রাস্তাঘাটে পুলিশের সামনে কোনো ঘটনা ঘটলেও তারা হত্যাকারী বা ছিনতাইকারীকে আটক করতে পারে না কেন? এসব কি তাদের দক্ষতার অভাবে ঘটছে নাকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে তাদের ইচ্ছার অভাবই এর মূল কারণ?

বেশ কয়েক বছর আগে দাপ্তরিক কাজের সূত্রে কয়েকটি জেলায় সফরে যেতে হয়েছিল। সে সময় কয়েকজন জেলা প্রশাসক এবং জেলার পুলিশ প্রধানের সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়েছিল। অন্তত দুটি জেলায় পুলিশের কর্মকর্তার সাথে কথা বলে আমার সন্দেহ হয়েছিল তাঁরা কি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পুলিশ, নাকি আফগান ফেরত জিহাদি যোদ্ধা! আমার সাথে বাক্যালাপে তাঁরা যে ভাষা এবং যে সকল শব্দ ব্যবহার ব্যবহার করেছেন তা স্পষ্টতই তাদের সাম্প্রদায়িক, পশ্চাদপদ ও অসহিষ্ণু মনোভাবের পরিচয় প্রকাশ করেছিল। বর্তমানে তাঁদের অনেকেই পদোন্নতি লাভ করে গোয়েন্দা বিভাগসহ বিভিন্ন জায়গায় উচ্চতর পদে আসীন হয়েছেন। কাজেই তাঁরা একজন মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন ‘বিধর্মী’ উপরন্তু ‘নাস্তিক’ লেখকের হত্যাকারীদের গ্রেফতারে কতটা আন্তরিক হবেন সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়।
ইচ্ছে না থাকলেও অনেক সময় উপরের চাপে এবং নিচের তাপে নড়েচড়ে বসতে হয়। তাছাড়া অনেক সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও পুলিশের মধ্যে নিশ্চয়ই দক্ষ ও পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মুক্তবুদ্ধির মানুষ এখনও আছেন যাঁরা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করতে তৎপর হবেন। পুলিশের আন্তরিকতা ও সক্ষমতা থেকে অন্তত একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। ‘বাংলাদেশ কী অদূর ভবিষ্যতে মানুষের বাসযোগ্য থাকবে নাকি হিংস্র হত্যাকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে?’
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×