গত এপ্রিলে আটচল্লিশে পা দিয়েছেন রফিক সাহেব। টাকের সাথে প্রতিযোগিতা চলছে ভুঁড়ির। পুরো মাথা দখল করেছে টাক আর দেহটা দখল করেছে ভুড়ি! দু;দুর্বৃত্তের আগ্রাসনের দরুন অনেকেই উনাকে ষাটের বুড়ো বলে ভ্রম করেন। এদিকে গিন্নির বেলায় ঘটছে উলটো ঘটনা। সকলেই উনার উনচল্লিশকে আটাশ বলে অনুমান করে।
রফিক সাহেবের সকল কর্মকান্ডকেই গিন্নি বাড়াবাড়ি জ্ঞান করে কঠোর হস্তে দমন করেন। সেই ক্ষেত্রে ভূড়ির বাড়াবাড়িইবা উনি মেনে নেবেন কেন?
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে সকালে দুঘণ্টা হাঁটতে হয় রফিক সাহেবকে। সকালের নাস্তা এক গ্লাস লেবুর শরবত,দুস্লাইস শশা আর দুপিচ টোস্ট বিস্কুট দিয়ে চলছে। দুপুরে ছোট প্লেটে আধামুঠ ভাত। প্রথম দিনের ঘটনা। সকালে শখের পাবদা মাছ আর পুইশাক এনেছেন।বাসায় পাবদা হলে ঝোল দিয়েই উনি দুপ্লেট মেরে দেন।
খেতে বসে ছোট প্লেট দেখে মাথা খারাপ অবস্থা রফিক সাহেবের।
একি! ঘরে প্লেট নেই? এ কিসে ভাত দিলে।
নিরুত্তাপ গিন্নি জানালেন- ডায়েটের নিয়ম ছোট প্লেটে ভাত খাওয়া।
- তাই বলে লবণের বাটিতে ভাত দিবে?
- লবণের বাটি কোথায় দেখলে? এটা হাফ প্লেট।
প্রতিবাদ বৃথা ভেবে ভাতগুলি কয়েক লোকমায় খেয়ে নিলেন, পাবদার দিকে তাকিয়ে প্রায় কান্না চলে আসছিল রফিক সাহেবের। বিষয়টা গিন্নির দৃষ্টি এড়ায়নি। সেটা আমলে না নিয়ে কোন এক মহাপুরুষের উক্তি ঝেড়ে দিলেন তিনি -‘আমি তোমার প্রতি সদয় এ কারণেই কঠোর হচ্ছি’।
আসলে কঠোর না হয়ে গিন্নির উপায় কি! মাথার টাকটা না হয় ক্যাপ দিয়ে ঢেকে দেয়া গেল কিন্তু ভুড়ি? এই ভুড়ি নিয়ে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় তাকে।
এইতো সেদিন বেগুন ভাজা খেয়ে সারা গায়ে চাকা চাকা কি উঠেছে। গিন্নিকে সাথে নিয়ে গেলেন এক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। চেম্বারটা একটা ক্লিনিকে। জনা পঞ্চাশের রোগী ওয়েটিংএ বসে আছে। রফিক সাহেবের সিরিয়াল আটত্রিশ। ডাক্তারের নেমপ্লেটের উপর চোখ পড়ে রফিক সাহেবের, সেখানে লিখা- চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ।হুমায়ুন আহমেদের মত লেখাটা পড়ে কেমন অস্বস্তি বোধ করেন তিনি। এতক্ষণ খেয়াল করেননি। এখন মনে হচ্ছে ওয়েটিংএ থাকা অনেকেই উনার দিকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তাকাচ্ছে। রফিক সাহেবের ধারনা সকলে উনাকে দ্বিতীয় রোগের রোগীই ভাবছেন।
কোথায় আমেরিকা আর কোথায় চামচিকা। কোথায় ডায়রিয়া আর কোথায় পাইওরিয়া! দুটি রোগের ভেতর আকাশ পাতাল তফাৎ তার পরও একই ডাক্তার দুই রোগের বিশেষজ্ঞ হয় কিভাবে? এই চিন্তাটা নিয়ে সবে ভাবতে বসেছেন তিনি এমন সময় দেখেন এক তরুণী ‘আরে নীলা তুই?’ বলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল গিন্নির উপর। পাশে যে একজন বসে আছে সেদিকে দুজনেরই কোন খেয়াল নেই। খলবল করে তারা অনেক কথা বলল।তাদের আলাপচারিতায় বোঝা গেল তরুণী বলে রফিক সাহেব যাকে ভ্রম করেছেন তিনি আসলে গিন্নির কলেজ বান্ধবী।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তরুণী বিচলিত হয়- এইরে আমার সিরিয়াল বোধ হয় এসে গেছে, আমি উপর তলায় গাইনির কাছে যাচ্ছি, অপেক্ষা করিস অনেক কথা আছে বলেই রফিক সাহেবের দিকে নজর দেয়।
- আরে নীলা ইনি কে? তোর শ্বশুর নাকি ? বলেই তরুণী হনহন করে সিঁড়ির দিকে এগুতে থাকে।
গিন্নির মুখ অন্ধকার।ডাক্তার দেখানো শিকেয় উঠল, তরুণী ফিরে আসার আগেই গিন্নি রফিক সাহেবকে টেনে হিঁচড়ে ক্লিনিক থেকে বের করে বাসার পথ ধরলেন।
সেই থেকে চলছে রফিক সাহেবের ডায়েট কন্ট্রোল আর সকালে দু;ঘণ্টা হাঁটা। আজ ডায়েটের একমাস পুর্তি। মাসের প্রথমে এক ডিসপেনসারিতে গিয়ে রফিক সাহেবের ওজন নোট করে রেখেছেন গিন্নি। আজ আবার ওজন নেয়া হবে। দুজনে গেলেন ডিসপেনসারিতে। কঠোর ডায়েট আর দু;ঘণ্টা মর্নিং ওয়াকের ফল হাতে হাতে পাওয়া গেল। দেখা গেল রফিক সাহেবের ওজন দুই কেজি সাতশো গ্রাম বেড়েছে!
বিষয় কি হতে পারে, ভেবে পাচ্ছেননা গিন্নি। রফিক সাহেব খুলে না বললে উনি জানবেন কিভাবে?
গিন্নিতো আর জানেননা, মর্নিং ওয়াকে পার্কে গিয়েই একটা বেঞ্চ দখল করে তিনি জম্পেশ একটা ঘুম দেন। ঘুম সেরে বাসায় আসার পথে মোড়ের দোকানে বসে চারটা শিঙ্গারা টপাটপ পেটে চালান করে দেন। দুপুরে খেতে আসার আগে জব্বার মিয়ার ফুলপ্লেট বিরিয়ানী আর সন্ধ্যার আগে চলে নানরুটি আর গরুর পায়া।
ইদার্নিং শিঙ্গারাকর্মটা পার্কেই সারছেন। ঠোঙ্গায় মুড়ে ছয়টা শিঙ্গারা নিয়ে যান চারটা নিজে খান দুটা ফুলবানুর জন্য।
একদিন পার্কে গিয়ে দেখেন রফিক সাহেবের বেঞ্চটা দখল করে শুয়ে আছে পঁচিশ ছাব্বিশের এক মেয়ে। অপুষ্ট শরীরের মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ধমক দিয়ে জাগালেন- এই মেয়ে এখানে শুয়ে আছো কেন? কে তুমি?
মেয়েটা বলল- আমি নিশীকন্যা।
-কি নাম বললে? নিশী?
-না নিশীকন্যা
- এ আবার কেমন নাম? আসল নাম বল।
- এ নাম আমারে এক সাহেব দিছে, আসল নাম ফুলবানু।
সেই থেকে ফুলবানুর সাথে বেশ খাতির হয়ে যায় রফিক সাহেবের। দুজনে প্রাতরাশ সারেন। কাছে পিঠে চাওয়ালা থাকলে কোন কোন দিন চা’ও খান। ব্রেকফাস্ট সেরে মেয়েটা চলে যায়। এরপর রফিক সাহেব বেঞ্চে মটকা মেরে একটা ঘুম দেন।
মেয়েটা মজার মজার কথা বলে, কারনে অকারণে হাসে। একদিন হাসতে হাসতে রফিক সাহেবের গায়ে ঢলে পড়ছে। এই গায়ে পড়া ভাবটা রফিক সাহেবের পছন্দ নয়, একদিন মেয়েটাকে কড়া ধমক দিতে হবে।
কঠোর ডায়েট আর দুঘণ্টা হাঁটার পরেও ওজন না কমার ব্যাপারটা রফিক সাহেবের গিন্নির মনে খচখচ করছিল। ক্ষীণতর একটা সন্দেহের বশবতি হয়ে একদিন ভোরে নিজেই শার্লকহোমস হয়ে রফিক সাহেবের পিছু নেন।
কথায় বলে সাতদিন ঘুষখোরের একদিন দুদকের। এই ‘একদিন’টা এমন একদিন ঘটলো যেদিন মেয়েটা দ্বিতীয় দিনের মত রফিক সাহেবের গায়ে হাঁসতে হাঁসতে ঢলে পড়ল। দূর থেকে ধৈর্য নিয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন গিন্নি। গায়ে ঢলে পড়া দেখে ধৈর্যটা আর ধরে রাখতে পারেননি, দৌড় দিলেন রফিক সাহেবের দিকে। বেঞ্চের কাছে আসতে আসতে মেয়েটা উঠে গেছে।
বেঞ্চে আয়েশ করে শুয়ে ফুলবানুর চলে যাওয়া দেখছিলেন রফিক সাহেব। হঠাত আশপাশে কোথাও বজ্রপাত হল। খেয়াল করে দেখলেন, এ বজ্রপাত নয়, তার সামনে দাঁড়ানো এক মহিলাই এই বিকট শব্দস্রষ্টা।
আরো খেয়াল করে দেখলেন, শব্দটার লক্ষ্য রফিক সাহেব এবং শব্দের উদ্রেককারী উনার নিজেরই গিন্নি।
পরের ঘটনা বড়ই হৃদয় বিদারক!
কোমর,পিঠ,হাটুর জয়েন্টগুলি সেরে উঠার পর থেকে রফিক সাহেব এখন ঠিক মতই প্রাতঃভ্রমন করেন। রাস্তা,অলিগলিতে, চিপায় চাপায় হাঁটেন। ভুড়ি কমানোর চেয়েও ক্ষীণ একটা আশা তাকে হাঁটতে অনুপ্রানিত করে। দেশে যেভাবে মালিকবিহীন টাকার ব্যাগ, বস্তা পথে ঘাটে পাওয়া যাচ্ছে যদি একটা ভাগ্যে মিলে যায় তাহলে আর পায় কে ?
ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফুটে উঠেনি।অন্যদিনের মত আজকেও হাঁটছেন রফিক সাহেব। ঘণ্টা আধেক হাঁটার পর থমকে দাঁড়ান তিনি। ড্রেনের পাশে ওটা কি পড়ে আছে? চোখে ভুল দেখছেননাতো?
চোখ রগড়ে শিওর হন, না তিনি কল্পনা কিংবা স্বপ্ন দেখছেন না। এইতো সামনেই পড়ে আছে টাকা ভর্তি একটা ব্যাগ! তিনি দৌড়ে যান ব্যাগের দিকে। এখানে খুলবেন না বাসায় গিয়ে খুলবেন এই ভাবতে ভাবতে ব্যাগের চেনটা খুলেই ফেলেন; দেখেন ভিতরে পড়ে আছে একটা সদ্য প্রসূত শিশু!! এখনো জীবন্ত! ,জগতের নিষ্ঠুরতা তাকে স্পর্শ করেনি,তির তির করে কাঁপছে বাচ্চাটির ঠোট।
ইতোমধ্যে কিছু উৎসুক জনতা জুটে গেছে। ভিড়ের মধ্য থেকে একজনের পরামর্শে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন রফিক সাহেব। অভিভাবকের স্থলে নিজে সই করে ভর্তি করিয়ে দিলেন শিশু ওয়ার্ডে।
বাসায় এসে গিন্নির কাছে এডভেঞ্চারাস অভিজ্ঞতার বর্ননা দিচ্ছিলেন রফিক সাহেব।
-আমি দুধওয়ালার কাছে সব শুনেছি বলে মাঝ পরে থামিয়ে দেন গিন্নি। সরু চোখে রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন- ভাবছো আমি কিছুই বুঝিনা? আমি পুরাই নিশ্চিত এই বাচ্চা তোমার, দিয়ে গেছে ফুলবানু। !
(পোস্টে প্রসঙ্গ বর্জিত ছবিটা নিছক ফান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে )
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:২৫